লগ্নির পথে

ছুটছে সেনসেক্সের গাড়ি। পিছনে পড়ে ২৮ হাজারের মাইলফলকও। এই চড়া বাজারে কি ইকুইটি ফান্ড থেকে দূরেই থাকবেন? না কি সাহস করে নেমে পড়বেন কোমর কষে? কী হবে লগ্নির কৌশল? ঝুঁকি আর রিটার্নের ভারসাম্যই বা রাখবেন কী ভাবে?ছুটছে সেনসেক্সের গাড়ি। পিছনে পড়ে ২৮ হাজারের মাইলফলকও। এই চড়া বাজারে কি ইকুইটি ফান্ড থেকে দূরেই থাকবেন? না কি সাহস করে নেমে পড়বেন কোমর কষে? কী হবে লগ্নির কৌশল? ঝুঁকি আর রিটার্নের ভারসাম্যই বা রাখবেন কী ভাবে?

Advertisement

নীলাঞ্জন দে

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৩০
Share:

মাঝেমধ্যে সামান্য পড়লেও প্রত্যাশার বিপুল জ্বালানি দৌড় থামতে দিচ্ছে না বাজারের। সেই সব প্রত্যাশা, যা জমতে শুরু করেছিল লোকসভা ভোটের আগে থেকে। মাঝে অনেক জল গড়িয়েছে। বিজেপির একক শক্তিতে সরকার তৈরি। সংস্কারে গতি এনে সরকারের লগ্নি-পরিবেশ চাঙ্গা করার ইঙ্গিত। পরিকাঠামোয় উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধির কিছুটা নীচে নামা। এই সব কিছুই মদত জুগিয়েছে সূচকের উত্থানে। আর এর জেরে এক সময়ে ঝিমিয়ে পড়া শেয়ার নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ডের (ইকুইটি ফান্ড) পারাও চড়ছে। বহু ফান্ডের তহবিল ফুলেফেঁপে উঠেছে। লগ্নিকারীরা বেশ খুশি। এই পর্যন্ত কোনও সমস্যা বা দ্বিধা থাকার কথা নয়। নেইও।

Advertisement

ধন্দ অন্য জায়গায়। এখন অনেকে ভাবছেন, বাজার যেখানে পৌঁছেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে ফান্ডে লগ্নির সিদ্ধান্ত কী হওয়া উচিত। যাঁরা এখনও ইকুইটি ফান্ডে টাকা ঢালেননি, তাঁরাও নতুন করে সেখানে লগ্নি করবেন কি না, তাই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। চলুন, এই দ্বিধা-দ্বন্দ দূর করাই হোক আমাদের আজকের আড্ডার বিষয়।

Advertisement

ফান্ডে লগ্নি নেই

আপনি এখন বিষাদগ্রস্ত এই ভেবে যে, সেনসেক্স ২৯ হাজারের দিকে চলল, অথচ তা থেকে আপনার কোনও লাভ হল না। আগেই বন্ধুরা পইপই করে বলেছিল, “এটাই সুযোগ, ভাল কোনও ইকুইটি ফান্ডের ইউনিট কিনে ফেল।” কান দেননি। এখন আপনার চোখের সামনেই ওরা এই বাজারে ফান্ড ভাঙিয়ে বিপুল রিটার্ন গুনছে। এত দিনে ফান্ডে লগ্নির গরজ হয়েছে আপনার। কিন্তু লগ্নির প্রথম পাঠ যেহেতু নিচু বাজারে টাকা ঢালা আর উঁচু বাজারে মুনাফা তোলা, তাই ২৮ হাজার পেরোনো বাজার ফান্ডে রিটার্নের কতটা নিশ্চয়তা দেবে, তা নিয়ে সন্দেহ জাগছে আপনার।

এ সমস্যা শুধু আপনার নয়, সূচকের যে-কোনও সুদিনেই এতে ভোগেন লাখ লাখ মানুষ। অনেকে বলবে, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম না-বুঝলে এই হয়! আর আমি বলব, একেবারে না-বোঝার তুলনায় একটু দেরিতে বোঝা ভাল। কারণ, আমি মনে করি—

এভারেস্ট বলে কিছু নেই।

মনে পড়ে, ১৫ বা ১৬ হাজারকে এক সময়ে অনেক উঁচু মনে হত? অনেকেই তখন ভাবতেন বাজার আর একটু নামলে লগ্নি করব? তেমনই এখন অনেকে ভাবছেন, বাজার অন্তত ২৫ হাজারে নামলেই লগ্নি করব। কারণ ২৭-২৮-২৯ হাজারের কোঠায় পৌঁছে যাওয়া সেনসেক্সের কাছে ১৫-১৬ হাজার কোন ছার, ২৪-২৫ হাজারটাই নিচু। অর্থাত্‌ শেয়ার বাজারের মজাটা হল, আজ যা উঁচু, পরে তা-ই অনেকটা নীচে ছিল বলে মনে হবে। কাজেই কাল সূচক যেই ৩০-৩২ হাজারে উঠবে, অমনি আপনি ভাববেন, ইস্‌, ফান্ডটা ২৮ হাজারেই কিনে ফেললে হত।


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

বাজার কি সব সময় হুড়মুড়িয়ে নামে?

আর্থিক বা রাজনৈতিক সঙ্কটের জেরে সূচকে অনেক সময়ে ধস নামে। যেমন, ২০০৭-এ সেনসেক্স ২০ হাজার ছুঁয়ে তাক লাগিয়েছিল লগ্নিকারীদের। কিন্তু ২০০৮-এ বিশ্ব জোড়া মন্দার প্রভাবে তা নেমে যায়। ২০০৯-এর মার্চে তলিয়ে যায় প্রায় ৮ হাজারে। তবে এ রকম পরিস্থিতির আশঙ্কায় হাত গুটিয়ে বসে থাকার মানে হয় না।

সুতরাং আমার পরামর্শ এই বাজারেই ইকুইটি ফান্ড কিনে লগ্নি শুরু করে দিতে পারেন আপনি। অবশ্য তার জন্য একটু কৌশলী হওয়া জরুরি।

প্রথম পা

প্রথমেই বলি, সাহসীদের থেকে কিছুটা আলাদা হবে সব সময়ে নিরাপত্তা-প্রিয় লগ্নিকারীদের এগোনোর পথ। সামাজিক বা আর্থিক অবস্থানের দরুনও অনেকে ঝুঁকি নিতে পারেন না। কাজেই লগ্নির সিদ্ধান্তও নিতে হবে সেই নিরিখে। তার পর মাথায় রেখে এগোবেন কিছু বিষয়—

ফান্ড কেনার আগে দেখুন কোথায় কোন কোন শেয়ারে ফান্ডের তহবিল বণ্টন হবে। যে-সব ফান্ড ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন শিল্পের নানা ধরনের সংস্থার শেয়ারে টাকা লাগায়, তাদের অবস্থান তুলনায় নিরাপদ। এগুলি ডাইভার্সিফায়েড ফান্ড। দেখে নিন, আপনার ফান্ড যথেষ্ট ডাইভার্সিফায়েড তো?

অসুবিধা না-থাকলে এক লপ্তে লগ্নি করতে পারেন। আবার একটু একটু করে তহবিল বাড়াতে এসআইপি পদ্ধতিও আছে। ইকুইটি ফান্ডে এসআইপি খুব কাজে দেয়। এতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নির্দিষ্ট সময় অন্তর জমা দিয়ে যেতে হয় নির্দিষ্ট মেয়াদ ধরে।

এসআইপি করলে দীর্ঘমেয়াদে করুন। ৮-১০ বছর বা আরও বেশি।


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

ইকুইটি ফান্ডে রাতারাতি মোটা মুনাফা করা অসম্ভব। শেয়ার বাজারের সঙ্গে এসআইপি-র ন্যাভ যত ওঠা-নামা করবে, তত তহবিল বাড়ার সম্ভাবনা। কারণ ন্যাভ পড়লে হাতে আসবে বেশি ইউনিট। আবার যখন তা উঠবে, তখন ওই ইউনিট থেকেই বেশি টাকা পাবেন আপনি। এটা দীর্ঘমেয়াদে চললে জমানো তহবিল ফুলেফেঁপে উঠবে।

শেয়ার ভিত্তিক ফান্ডে রিটার্নের ক্ষেত্রে কোনও গ্যারান্টি নেই। তবে ঝুঁকির দিক থেকে বলা যায়, বাজারে শেয়ার মূলধনের ভিত্তিতে বড়, নামী সংস্থায় টাকা খাটানো সব সময়েই বেশি নিরাপদ। এই লার্জ ক্যাপ ধোঁকা দেয় কম। সুতারং লার্জ ক্যাপে টাকা খাটায় এমন ফান্ডে ঝুঁকি কম।

রিটার্ন বাড়াতে বেশি ঝুঁকি নিতে চাইলে মাঝারি (মিড ক্যাপ) বা ছোট মাপের (স্মল ক্যাপ) সংস্থার শেয়ারে টাকা খাটাবে এমন ফান্ড বাছুন। ছোট-মাঝারি সংস্থাগুলির শেয়ার দর তুলনায় কম থাকায় সেগুলির বাড়ার সুযোগও বেশি। তবে বাজারে খারাপ কিছু ঘটলে আবার এগুলি বেশি মার খায়। তাই প্রতি মুহূর্তে সতর্ক হয়ে এগোতে হয়।

তবে সাবধান, খারাপ সংস্থায় ফান্ডের তহবিল খাটলে কিন্তু ডুবতে পারেন। কাজেই ফান্ডের পুরনো তথ্য, ফান্ড ম্যানেজারদের অতীতে ফান্ড পরিচালনার রেকর্ড, লেনদেন খরচ, কোথায় কী ভাবে টাকা খাটবে তার বিবরণ ইত্যাদি দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন। এখন ইন্টারনেটে অনেক তথ্য মেলে।

বাজার বেড়েছে, ফান্ডও

ধরা যাক, সূচক ১৮ হাজারে থাকাকালীন ইকুইটি ফান্ড কিনেছিলেন। ফলে ২৮ হাজার পেরোনো বাজারে তা যথেষ্ট হৃষ্টপুষ্ট। এক বার মনে হচ্ছে, ভাল বাজারের সুবিধা নেওয়ার এটাই সেরা সময়। কিন্তু যদি বাজার পড়ে?

আবার পর মুহূর্তেই আপনার মন বলছে, বাজার আরও উঠলে হাত কামড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না। অতএব চুল ছেঁড়া—কী করি?

এ ক্ষেত্রে দুম করে এক কথায় হ্যাঁ বা না বলা যায় না। আমি বরং বলব—

বেশি ঝুঁকি নিতে স্বচ্ছন্দ হলে হাতের ইউনিট আরও কিছু দিন ধরে রাখতে পারেন। আপনার ফান্ডের কিছু ইউনিট কিনতেও পারেন। কারণ বাজারের যা মতিগতি, তাতে সংস্কারের গন্ধে তা অন্তত আরও কিছু দিন চাঙ্গা থাকারই সম্ভাবনা। শ্রম আইন সংস্কার বিল সংসদে পাশও হয়েছে।

তবে খুব লোভী হলে দু’কূলই ডুবতে পারে। লগ্নির লক্ষ্য পূরণ হলে ফান্ড ভাঙিয়ে নেওয়া ভাল। এক সময়ে বাজার ফের কিছুটা নামবেই। তখন আবার ফান্ডের ইউনিট কিনতে পারেন।

ফান্ডের ন্যাভ যখন উঁচুতে অর্থাত্‌ মোটা রিটার্ন নিশ্চিত, তখন তহবিল লিকুইড ফান্ডে সরাতে পারেন। এটি ঋণপত্র নির্ভর স্বল্প মেয়াদের ফান্ড। এতে তহবিল কমার ভয় তেমন নেই। ফান্ডও কিছুটা বাড়ে। এর পর তা ভাঙিয়ে নিতে পারেন। বা বাজার নামলে আবার ইকুইটি ফান্ডে ওই তহবিলেরই একাংশ বা পুরোটা সরিয়ে আনতে পারেন। তবে বিভিন্ন ফান্ডে তহবিল এ দিক-ও দিক করতে এগ্‌জিট লোড লাগতে পারে।

বাজার উপরে, রিটার্ন নীচে

এ বার উল্টো সমস্যা। বাজার লাফিয়ে বাড়ছে কিন্তু আপনার ভাগ্যে শিকে ছেড়েনি। ফান্ডের রিটার্ন তলানিতেই। আর ভাববেন না। স্রেফ বেচে দিন। আপনার বন্ধু এই বাজারে ইকুইটি ফান্ডে লগ্নি করে লাভের গুড় রাখার জায়গা পাচ্ছেন না। আর আপনি হাত কামড়াচ্ছেন। এই পরিস্থিতি অসহ্য। ভুল ফান্ড বেছেছেন। বা ফান্ড ম্যানেজাররা তা খারাপ চালাচ্ছে। বরং ফান্ড বেচে পাওয়া টাকা অন্য ভাল ফান্ডে লাগান।

লেখক মিউচুয়াল ফান্ড বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন