বাঙালিদের একটি গুণ চমৎকার। লেখক, শিল্পী, কবি, প্রাবন্ধিক বা শিক্ষক... চলতি কথায় যাঁদের ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে, সমাজে তাঁদের আলাদা সম্মান। ভারতের অন্য প্রদেশেও অনেক বিদ্যোৎসাহী আছেন, তাঁদের স্বীকৃতিও নিশ্চয় আছে, কিন্তু একটা সমাজে এই যে বুদ্ধিজীবীদের আলাদা সম্মান, এটা অন্যত্র বিশেষ দেখা যায় না।
এর কারণ কী? বুদ্ধিজীবী মাত্রেই ভাল লোক, এমন নয়। পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের বহু বুদ্ধিজীবী বা শিল্পীর কথা জানায়, যঁারা মানুষ হিসেবে ভাল ছিলেন না। কিন্তু বাঙালি সমাজ একটি অলিখিত নিয়ম তৈরি করে নিয়েছে— যে নিয়ম লেখাপড়াকে ভাল না বাসলে সম্ভব নয়— বুদ্ধিজীবী মাত্রেই তাঁর চর্চাটার জন্যই তাঁকে সমীহ করতে হবে। এই যে অন্যান্য ব্যাপারগুলোর অভিঘাতে প্রকৃত বিষয়টা গুলিয়ে না ফেলে, মানুষটার কাজের প্রতিই গোটা লক্ষটা নিবদ্ধ রাখা— এটা বাঙালি জাতির এক আশ্চর্য গুণ, যা তারা যুগ যুগ ধরে বজায় রেখেছে।
পশ্চিমবঙ্গে এখন শিক্ষার হাল কেমন, সাক্ষরতায় তার স্থান কত নম্বরে— সেগুলি অন্য প্রশ্ন। কিন্তু আমি এক জন আধা-বাঙালি হিসেবে এটুকু জানি, ওই সামাজিক সম্মান এখনও অটুট। কয়েকটি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলমাল হচ্ছে, শিক্ষকরা কোথাও কোথাও আক্রান্ত— এমন কথাও শুনি। কিন্তু সেটি প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলার সমস্যা। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির নয়। বরং, এটাই আরও প্রশংসনীয় যে, শিক্ষাব্যবস্থার কিছু ডামাডোলকে প্রাধান্য দিয়ে এই জাতি কখনওই শিক্ষাব্রতীদের বা শিক্ষাসাধকদের নিচু করেনি।
এটা অবাক হওয়ার, এই ভোগের ধ্বজা-ওড়ানো যুগেও— ধনী থেকে আরও ধনী হওয়া নয়, বরং একটা গোটা সমাজ এখনও বুনো রামনাথের গল্প করে। যিনি রাজাকেও কিনা মুখের ওপরে শুনিয়ে দিয়েছিলেন, বৈভবের লোভ দেখিয়ে কোনও লাভ নেই, তাঁর ঘরে তেঁতুলপাতার ঝোল আর ভাত আছে, গৃহিণী ও ছাত্রদের দু’বেলা চলে যায়, অভুক্ত থাকতে হয় না। এই অন্তরবস্তুর উপাসনার অহংকার বাঙালিকে বিশিষ্ট করেছে। চোখের সামনে নির্মলকুমার বসু এবং যে সব মাস্টারমশাইদের দেখেছি, তাতে এই কথাটাই বারবার মনে হয়েছে। তপন রায়চৌধুরী, অমর্ত্য সেন বা সুখময় চক্রবর্তীর মতো বাঙালি বন্ধুদের মধ্যেও তো দেখেছি সেই কথারই প্রমাণ। সুখময় তখন প্ল্যানিং কমিশনে, কিন্তু সপ্তাহে দু’দিন ভোরবেলায় বেরিয়ে লাইব্রেরি ঘুরে যায়। জিজ্ঞাসা করলে উত্তর, ‘নতুন বইগুলি ঘাঁটতে হবে তো।’ এই যে বই ঘেঁটে আনন্দ, এটি প্রতিভার স্বভাব অবশ্যই। কিন্তু বাঙালি সমাজও তাঁদের নানা ভাবে সম্মান দিয়েছে। অর্থনীতির জটিল তত্ত্ব বুঝুক বা না বুঝুক!