মান্নাদা সারা জীবন মানুষকে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন

মান্না দে-র কাছে নিজের গাওয়া গানের ক্যাসেটটা পৌঁছে দিতে পেরে গৌতম ঘোষালের মনে হল এ যেন স্বপ্নের থেকেও বেশি কিছু ছুঁয়ে ফেলা। হয়তো তিনি গানগুলি শোনার মতো সময় পাবেন না। অনেক দিন আগের কথা। শিল্পী বা গীতিকার-সুরকার হিসেবে তখনও বিশেষ নাম করেনি।

Advertisement

দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:১০
Share:

—ফাইল চিত্র।

মান্না দে-র কাছে নিজের গাওয়া গানের ক্যাসেটটা পৌঁছে দিতে পেরে গৌতম ঘোষালের মনে হল এ যেন স্বপ্নের থেকেও বেশি কিছু ছুঁয়ে ফেলা। হয়তো তিনি গানগুলি শোনার মতো সময় পাবেন না। অনেক দিন আগের কথা। শিল্পী বা গীতিকার-সুরকার হিসেবে তখনও বিশেষ নাম করেনি। তবুও ভাগ্য যদি ভাল থাকে ক্যাসেটটা তাঁর হাতের ছোঁয়া তো পেতে পারে। ক্যাসেট রিলিজ হওয়ার পর থেকে মনের মধ্যে একটা সুপ্ত বাসনা যদি একটা কপি মান্না দে-কে দেওয়া যায়। তখন দেবাশিস বসু মান্না দে-র প্রচুর অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছেন। মান্না দে-র খুবই পছন্দের সঞ্চালক। ব্যক্তিগত সম্পর্কটাও দারুণ। গৌতম ইচ্ছের কথাটা বলে রেখেছিল দেবাশিস বসুকে। একদিন সুযোগটা মিলেও গেল। মহাজাতি সদনে অনুষ্ঠান। গৌতমকে নিয়ে পৌঁছে গেল দেবাশিসদা। মান্নাদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন গৌতমের। পেশায় শিক্ষক শুনে মান্নাদা খুব খুশি হলেন। শিক্ষিত মানুষদের মান্নাদা ভীষণ পছন্দ করতেন। তখন ব্যস্ততার সময়। একটু পরেই তাঁর অনুষ্ঠান। বললেন, ক্যাসেটটা তপা (তপন দে, মান্নাদার ভাইপো)-র কাছে রেখে যেতে। পরে সময় মতো গানগুলি শুনে নেবেন। সে দিন অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে অনেক রাত। পরের দিন খুব ভোরের ফ্লাইটে চলে যাবেন।

Advertisement

পর দিন দেবাশিসদার কাছে তপাদার ফোন। কী ব্যাপার? হ্যাঁ, যাওয়ার সময় মান্নাদা বলে গেছেন, গানগুলো তিনি শুনেছেন, সে কথা জানিয়ে দিতে। দেবাশিসদা তো অবাক। অত রাতে অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে, পর দিন খুব ভোরে ফ্লাইট। তা হলে গানগুলো শুনলেন কখন? তপাদা বললেন, গানগুলো শুনবেন বলে কাকা আরও এক ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠেছেন। যখন উঠেছেন, তখন সূর্যও পুরোপুরি ওঠেনি। জাস্ট একবার ভেবে দেখুন। যত ভাববেন তত অবাক হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো আরও অনেক কিছু বাকি ছিল।

মান্নাদাকে ক্যাসেটটা দেওয়ার মাস ছয়েক পরের ঘটনা। মহাজাতি সদনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল গৌতম ঘোষাল আর দেবাশিসদা। হঠাৎ চোখে পড়ল হলের গায়ে পোস্টার। মান্নাদার অনুষ্ঠান চলছে। এ সুযোগ কি ছাড়া যায় ! ভাগ্যটাও সঙ্গে ছিল। মান্নাদা অন্য কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন। দু’জনকে দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন—‘আপনার গাওয়া গানগুলি শুনেছি। আমার তো বেশ ভাল লেগেছে। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো পাতিয়ালা ঘরানাটা আপনি কার কাছ থেকে পেয়েছেন? আপনার একটা গানে ওই ঘরানার ছোঁয়া আছে।’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। প্রত্যেকটা গান ধরে ধরে বলছেন। গৌতম, দেবাশিসদা তো অবাক হওয়ার শেষ প্রান্তে। মান্নাদা সঙ্গীতের সম্রাট। তিনি একজন অচেনা গায়কের গান এমন ভাবে শুনেছেন যে ছ’মাস বাদেও প্রত্যেকটা গানের কথা মনে রেখেছেন। এমনও হয়! এমন অভিজ্ঞতা আমারও একবার হয়েছিল। ‘ভারততীর্থ’ অ্যালবামের দশটি গান রেকর্ড করার কয়েক মাস বাদে দশটি গানের ভিডিও শ্যুট হয়। মান্নাদা লিপ দিচ্ছেন। দশটাই নতুন গান। চিন্তা করুন, সব ক’টি গান নিখুঁত ভাবে লিপ দিলেন মান্নাদা। ঠিক সময়ে ধরা এবং ছাড়া। প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য পোড়খাওয়া পরিচালক। কাজ করেছেন প্রায় সব বিখ্যাত অভিনেতাকে নিয়ে। মান্নাদার স্মৃতিশক্তি এবং এমন ‘অভিনয়’ দেখে অবাক হয়ে গেলেন।

Advertisement

এ বিষয়ে একটা প্রসঙ্গের উল্লেখ না করে পারছি না। অবশ্যই খুব সংকোচের সঙ্গে বলছি। অনেক আশা নিয়ে সবাই গানের অ্যালবাম করেন। নতুন শিল্পীর গান প্রায় কোনও দোকানই রাখে না। শিল্পী এখন কী করবেন? সি ডি-টি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন প্রতিষ্ঠিত গীতিকার-সুরকারদের। গান শুনে যদি কারও মনে ধরে। বাস্তবে কি হয়? অনেক মিউজিক ডিরেকটরকে বলতে শুনেছি ‘কেন যে আমাকে শুনতে দেয় বুঝতে পারি না। সুর করাবে অন্যকে দিয়ে, আর শুনতে হবে আমাকে, কেন ভাই?’ তবে ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। তখন প্রভাত রায় ই টিভি-তে পর পর টেলিফিল্ম করছেন। ‘কিন্তু কেন’ বলে একটি ছবির কাজ চলছে। দুটি গান। টাইটেল সং গাইবেন নচিকেতা। আর একটা ফিমেল ভয়েসের গান। সুর করছেন চিরদীপ দাশগুপ্ত (এখন ইন্দ্রদীপ)। লর্ডসের মোড়ে প্রভাতবাবুর বাড়িতে আমাদের গানের সিটিং চলছে। চিরদীপ খুব করে প্রভাত রায়কে অনুরোধ করলেন একটি নতুন মেয়েকে গানটা গাওয়ানোর জন্য। এও বলল, কোনও কারণে যদি গাওয়ানো সম্ভব না-ও হয়, অন্তত ওর গানটা একটু শুনবেন, একটা ক্যাসেটে গাওয়া আছে, রেখে যাচ্ছি। ক’দিন বাদে ঢাকুরিয়ার ওম স্টুডিয়োতে নচিকেতার রেকর্ডিং। নচিকেতা এর আগে প্রভাতবাবুর ‘খেলাঘর’ ছবিতে সুর করেছেন। এখানেও একই ব্যাপার। নচিকেতা তার নিজের ভঙ্গিতে প্রভাত রায়কে বলল, ‘একটি মেয়ে দারুণ গায়, ঠিক মতো সুযোগ পেলে অনেক দূর যাবে। তুমি ওকে একটু দেখো।’ সেই মেয়েটিকে প্রভাত রায় পরের টেলিফিল্ম ‘অনুচ্চারিত’-তে গাইয়েছিলেন। গায়িকার নাম শুভমিতা।

ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবে সিডি রিলিজের অনুষ্ঠান। গায়ক ধ্রুব (পুরো নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না)। মান্নাদা কলকাতায়। এমন কয়েক জন এই অ্যালবামটার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যারা মান্নাদার বেশ ঘনিষ্ঠ। সবার অনুরোধে মান্নাদা রাজি হয়েছেন সিডি-টি উদ্বোধন করতে। তবে একটা শর্তে। না, অ্যাপিয়ারেন্স মানি নয়। তিনি চান অনুষ্ঠানের আগে যেন সিডি-টা তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। গানগুলো তো ভাল করে শুনতে হবে। অনুষ্ঠানে গিয়ে শুধু মুখ দেখিয়ে লাভ নেই। যে সিডি-টির উদ্বোধন তার গানগুলো সম্পর্কে একটা ধারণা তো থাকা চাই। হলও তাই। মান্নাদা অনুষ্ঠানে এলেন। শিল্পীর গান নিয়ে তাঁর মতামত দিলেন। সবাই অবাক হয়ে শুনলেন। শিল্পী পেলেন সঙ্গীতের দেবতার আশীর্বাদ।

মান্নাদা সারা জীবন ধরে নানা ভাবে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন মানুষকে। খুব বেশি না হলেও বাপি লাহিড়ির সুরে মান্নাদাও বেশ কয়েকটি ছবিতে অসাধারণ কিছু গান গেয়েছেন। ১৯৭৭-এ ‘প্রতিমা অর পায়েল’, ১৯৭৮-তে ‘সুরক্ষা’, গুজরাতি ছবি ‘জনম জনম কা সাথী’। কিন্তু যে ছবির কথা বিশেষ ভাবে বলতে হয় তার পরিচালক ছিলেন অজিত গঙ্গোপাধ্যায়। এই ছবিতেই বাপী লাহিড়ির সুরে মান্নাদার প্রথম প্লে-ব্যাক। সুরকারের বয়স তখন মাত্র ১৮। রেকর্ডিং শেষে মান্নাদাকে যখন রেমুনারেশন খামটা দেওয়া হল, তিনি সবিনয়ে সেটি ফেরত দিয়ে বললেন, ‘অপরেশবাবুর ছেলে কাজ করছে, এখানে কিছু নেওয়া যায় নাকি?’ সে ছবিতে তো আরও অনেকে গান গেয়েছিলেন। এক নবীন সুরকারকে উৎসাহ দিতে এমন কাজ তো কেউ করলেন না।

একবার নেতাজি ইন্ডোরে মান্নাদার অনুষ্ঠান। এ দিকে মহা বিপদ। অনুষ্ঠানের সময় এগিয়ে আসছে অথচ সঞ্চালকের দেখা নেই। মান্নাদার মুখ ক্রমশ গম্ভীর হচ্ছে। আয়োজকরা তো প্রমাদ গুনছে। মান্নাদা যদি চলে যান? এমন সময়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে সেই সঞ্চালক ঢুকেই জিভ কেটে মান্নাদার হাঁটু জড়িয়ে ধরল। সবাইকে বিস্মিত করে মান্নাদা সস্নেহে তার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘তোমার কোনও বিপদ হয়নি তো?’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন