খুব সহজেই আপন করে নিতেন

মিউজিশিয়ানদের খুব সহজেই আপন করে নিতেন মান্না দে—লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীমিউজিশিয়ানদের খুব সহজেই আপন করে নিতেন মান্না দে—লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৬ ০০:০৩
Share:

মিউজিশিয়ানদের অতি সহজেই মান্নাদা আপন করে নিতেন।

সোনায় বাঁধানো সেই সব দিন। ১৯৪০। রবীন্দ্রনাথ তখনও বেঁচে। নিউ থিয়েটার্সকে ঘিরে অসাধারণ প্রতিভাধর সব মানুষের সমাবেশ। চলচ্চিত্র-পরিচালক বিমল রায় তাঁদের মধ্যমণি। তাঁর দুই যোগ্য সহকারী হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় এবং অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। আছেন সংগীতসম্রাট কৃষ্ণচন্দ্র দে। স্টার থিয়েটারে বিরাট জলসা। অনুষ্ঠান শুনতে গেছেন হৃষীকেশবাবু ও অরবিন্দবাবু। কিন্তু এত ভিড় যে হলেই ঢুকতে পারলেন না। অগত্যা গেটে দাঁড়িয়েই দু’জন গান শুনতে লাগলেন। তখন গাইছেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। তাঁর ভাইপো মান্না দে-ও ভিড়ের চাপে হলে ঢুকতে পারেননি। তিন বন্ধু গেটে দাঁড়িয়েই গান শুনছেন। এমন সময় এক বিপত্তি। মাইক গেল খারাপ হয়ে। অত বড় হল। বাইরেও শ্রোতারা গিজগিজ করছে। বেশির ভাগই কৃষ্ণচন্দ্র দে-র গান শুনতে এসেছে। শেষ পর্যন্ত তিনিই হলেন মুশকিল আসান। মাইক ছাড়াই খালি গলায় উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরলেন ‘‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে’’। মাইকের অভাব পূর্ণ করে দিল সেই কণ্ঠ। শ্রোতারা মুগ্ধ। মুগ্ধ মান্না দে অরবিন্দবাবুকে বললেন, ‘‘শুনলে ঢুলু! এমন করে গাইতে শুধু কাকাই পারেন। আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।’’

Advertisement

অমিতকুমারের সঙ্গীত-জীবনের প্রথম দিক। সত্তরের দশক। অমিতের খুব ইচ্ছা ক্ল্যাসিকাল শেখার। ওর বাবা তো হেসেই উড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘‘তার থেকে তুই সায়গলসাহেবের গান ভাল করে কর, তাতেই তোর শেখা হয়ে যাবে।’’ কিন্তু অমিত নাছোড়বান্দা। না, ক্ল্যাসিকাল শিখবই। কিশোরকুমার আর কী করেন, ফোন করলেন মান্না দে-কে। একমাত্র তিনিই উদ্ধার করতে পারেন। মান্নাদা বললেন, ‘পাঠিয়ে দাও’। প্রবল উৎসাহে অমিত গেলেন মান্না দে-র বাড়িতে। অমিত ঠিক কী চাইছে, আর কী হতে পারে, মান্নাদা খুব সুন্দর করে বোঝালেন তাকে। বললেন, ‘‘তুমি তো ক্ল্যাসিকাল গাইয়ে হবে না। যেমন পণ্ডিত অমিতশঙ্কর বা ওস্তাদ অমিতুল্লা। তুমি লাইট গানই গাইবে। সেজন্য যেটুকু দরকার সেটুকুই শেখো। হার্ড নয়, লাইট ক্ল্যাসিকাল।’’

মান্নাদা অমিতকে ভর্তি করিয়ে দিলেন গুলাম মোস্তাফা খান সাহেবের কাছে। যত দিন যায়, অমিতের উৎসাহে ততই ভাঁটা পড়তে থাকে। সব শিক্ষাই যেন মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এভাবে তিন-চার মাস কাটল। শেখা আর এগোলো না।

Advertisement

১৯৮৭তে বাবা মারা যাবার পর আবার অমিতের গান শেখা শুরু। গুরু সত্যনারায়ণ মিশ্র-র কাছে শিক্ষা। সে এক কঠিন অধ্যায়। অনেক সাধ্যসাধনা করে শেখা গেল দশটি ঠাট। অমিতের উপলব্ধি হল, দশটি ঠাট শিখতেই এত বছর লাগল, তাহলে মান্নাদা কী করেছিলেন? কেমন ছিল তাঁর শিক্ষা, সাধনা? অমিত বুঝল, শিক্ষাই নয়, তা গ্রহণ করার মতো ক্ষমতাও থাকতে হবে। অমিতকুমার বলছেন, মান্নাদার গান শুনলেই বোঝা যায় কতটা ক্ল্যাসিকাল শিক্ষা থাকলে এই সব কঠিন গান অত অনায়াসে গাওয়া যায়। নিজে চেষ্টা করেছিলেন বলেই অমিত বেশি করে বুঝতে পারলেন মান্নাদার সংগীত শিক্ষা কত উঁচুস্তরের ছিল।

মান্না দে সম্পর্কে সমসাময়িক এবং পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে আগে কিছু কিছু লিখেছি। এবার অলকা যাজ্ঞিকের কথা বলি। অলকা বলতে গেলে কলকাতার মেয়ে। প্রথম জীবন কলকাতাতেই কেটেছে। তখন থেকেই বেশ ভাল গাইছে। একবার কলকাতায় এক বিশাল অনুষ্ঠান। প্রধান শিল্পী মান্না দে। তখন তাঁর ভারতজোড়া খ্যাতি। সস্নেহে ডেকে নিলেন বালিকা অলকাকে। মেয়ে তো ভয়ে কাঁপছে। যত ছোটই হোক, মান্না দে সম্পর্কে তার একটা ধারণা তখনই তৈরি হয়েছে। তাছাড়া সামনে কত মানুষ। অসীম আত্মবিশ্বাসে মান্নাদা তাকে দিয়ে গাইয়ে নিলেন ‘জোড়ি হামারা জমেগি ক্যায়সে’। অলকা পরম শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, মান্না দে এক মহান শিল্পী। নায়কের কণ্ঠে মূল গান গাইবার বেশি সুযোগ পাননি, তবু ভাললাগা ও শিল্পের বিচারে মান্না দে-র গানই সেরা।

মিউজিশিয়ানদের অতি সহজেই মান্নাদা আপন করে নিতেন। বেবিদা-র (প্রতাপ রায়) কথা বলি। প্রখ্যাত অ্যাকোর্ডিয়ান-বাদক। সব নামী শিল্পীর সঙ্গেই বাজিয়েছেন। এখনও সমান উদ্যমে সুর, যন্ত্রসংগীত আয়োজন, বাজনার কাজ করে চলেছেন। খানিকটা হঠাৎ করেই মান্নাদার সঙ্গে যোগাযোগ। ৩৬-৩৭ বছর আগের ঘটনা। একটা ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হচ্ছে। সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সন্ধ্যায় আবার শ্যামনগরে গানের বিরাট অনুষ্ঠান। ভূপেন হাজরিকা ও আরতি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাজাবেন বেবিদা। হঠাৎই বেবিদার জ্বরমতন হল। শরীরটাও ভাল লাগছে না। হেমন্তবাবু বললেন, তুমি শ্যামনগরে যেতে যেতে ভূপেনবাবুর অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি না বাজালে আরতি খুব অসুবিধার মধ্যে পড়ে যাবে। আমি তোমাকে এখন একটা ওষুধ দিচ্ছি। জ্বরটা নেমে যাবে। ছ’ঘণ্টা বাদে আর একটা ওষুধ খেয়ে নিও।

ওষুধটা খেয়ে সত্যি সত্যি জ্বরটা নেমে গেল। শরীরটাও খানিকটা ভাল বোধ হল। আরতিদি-র সঙ্গে বাজিয়ে বেবিদা বাজনা গোছাচ্ছেন বাড়ি ফিরবেন বলে। মনে হচ্ছে জ্বরটা আবার আসব আসব করছে। এমন সময় পারকাশনিস্ট ভ্যাকাদা (রবীন গাঙ্গুলি) এসে বেবিদাকে ধরলেন। কী ব্যাপার! রাধাকান্ত নন্দী ডাকছেন। রাধুবাবু বললেন, ‘‘তোমাকে আজ মান্নাদার সঙ্গে বাজাতে হবে। অমর রাহা হঠাৎ করে আসতে পারেনি।’’ কার সঙ্গে? মান্না দে? বেবিদা তো আঁতকে উঠলেন। অসম্ভব। তখন মান্নাদা মানেই সবার শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম, একটু ভয়। কী সব গানই না গাইছেন তিনি। কোনও রকম রিহার্সাল ছাড়া মান্নাদার সঙ্গে বাজনো? তখন মান্নাদার সঙ্গে যাঁরা বাজাতেন, তাঁরা ছিলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে কিংবদন্তি—রাধাকান্ত নন্দী, ওয়াই এস মুলকি, খোকন মুখার্জি, রবীন গাঙ্গুলি প্রমুখ। মুলকিসাহেবকে তো বেবিদা গুরু মানতেন। ভাবছেন মানে মানে সরে পড়াই ভাল। কিন্তু কী করে পালাবেন? ওদিকে বিধাতা তো সব কিছু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন। গ্রিনরুম থেকে বেবিদাকে দেখতে পেয়ে মান্নাদা বললেন, ‘‘অমর আজ আসতে পারেনি। আপনাকে একটু বাজিয়ে দিতে হবে। নইলে মুশকিলে পড়ে যাব।’’

অনুষ্ঠান যথারীতি শুরু হল। মান্নাদা গাইছেন মানে তো মঞ্চ ও দর্শকদের পুরো অধিকার করে নিয়েছেন। প্রাথমিক নার্ভাসনেস কেটে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই বেবিদা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন। গাইতে গাইতে মান্নাদা অসম্ভব প্রফেশনাল তৎপরতায় বাদ্যযন্ত্রীদের একাত্ম করে নিতেন। অনুষ্ঠান শেষে বেবিদা বুঝতে পারলেন তিনি ভালভাবেই পরীক্ষায় পাশ করে গেছেন। মান্নাদা বললেন, ‘‘আপনাকে একটু কষ্ট করে আমার সঙ্গে অশোকনগরে যেতে হবে। ওখানে আর একটা অনুষ্ঠান আছে।’’ বেবিদা তো সানন্দে চললেন। অত বড় শিল্পী মান্না দে। কিন্তু সহজ ব্যবহারে এত আপন করে নিলেন যে মনে হল মান্নাদার সঙ্গে কত দিন ধরে বাজাচ্ছেন।

এ বছরও ১ মে মান্না দে-র ৯৭তম জন্মদিনে সারা পৃথিবী জুড়ে নানাবিধ প্রোগ্রাম। খুব সঙ্কুচিত হয়েই বলছি, স্বর্ণযুগের শিল্পীদের মধ্যে ‘বেঁচে’ আছেন একমাত্র মান্না দে। এখনও তাঁর গান সর্বত্র বাজে। শোনে সব বয়সের শ্রোতা। ১ মে গিয়েছিলাম সায়েন্স সিটির অনুষ্ঠানে, ২ মে রবীন্দ্রসদনের অনুষ্ঠানে। সায়েন্স সিটিতে ব্যাক ড্রপে মান্নাদার বিশাল কাটআউট। সামনে সব মিউজিশিয়ান। কুন্দন, মানব, দীপঙ্কর। খানিক আগে ছিল আউলবাউল। এরা সবাই মান্নাদার সঙ্গে বাজাতেন। বেবিদা পিয়ানোয় সুর ধরলেন— ‘ও ললিতা, ওকে আজ চলে যেতে বল না।’

চোখ ঝাপসা হয়ে এল। নতুন করে আবার বুঝলাম, মান্নাদার জীবনে ১ মে আছে, ২৪ অক্টোবর নেই। তিনি অনন্ত। তাঁর গান চিরদিনের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন