ভাবনায় ছবিটা অবিকল ভাসে। ২০১২। ১৮ জানুয়ারি। নিজের জন্মদিনেই চলে গেছেন ম্যাডাম (মান্নাদার সহধর্মিণী)। একেবারে ভেঙে পড়েছেন মান্নাদা। কিন্তু যেখানে যতই বুকের ভিতরে রক্তক্ষরণ ঘটুক না কেন, সময় তার নিয়ম বদলায় না। সে বছরও দুর্গাপুজো এল যথারীতি, যথা সময়েই। মান্নাদার চোখের জল তখনও এতটুকু শুকোয়নি। বৌদির ছবির দিকে তাকিয়ে শুধু কেঁদেই চলেছেন। বাড়ির লোকেরা প্রায় জোর করেই মান্নাদাকে নিয়ে গেল বানাসয়াবি পুজো মণ্ডপে। বেঙ্গালুরুর মান্নাদার বাড়ি থেকে খুব কাছে। মান্নাদা রইলেন কিছুক্ষণ। কে জানত সে দিনই হবে মান্নাদার শেষ দুর্গাপুজো।
সত্যি কথা বলতে কি মান্নাদার দুর্গাপুজো ছিল একটু অন্য রকম। মান্নাদার কাছে পুজো মানে নতুন নতুন গান। গানই ছিল তাঁর পুজোর মন্ত্র। গানের সুরেই তাঁর দেবীর আরাধনা। ২০১০ সালের আগে পর্যন্ত মান্নাদার রুটিন ছিল একটু আলাদা। মে-জুন মাস নাগাদ চলে যেতেন আমেরিকায়। ঠিকানা সিলিকন ভ্যালি। রমাদির (মান্নাদার বড় মেয়ে) বাড়ি। সারা আমেরিকা জুড়ে অনুষ্ঠান। বেশি ঠান্ডা মান্নাদা একদমই সহ্য করতে পারতেন না। ফিরে আসতেন অগস্ট-সেপ্টেম্বর নাগাদ। অন্য তাড়া থাকত। পুজোর গান রেডি করতে হবে তো!
১৯৯০। ৭১ বছর বয়সে মান্নাদার বাইপাস সার্জারি হল। খুবই ধকল গেছে। চারিদিকে লেখালিখি ও আলোচনা হতে শুরু করল এ বছর মান্নাদা আর পুজোয় গান গাইতে পারবেন না। সে কথা মান্নাদার কানে যেতে বললেন ‘মাথা খারাপ, পুজোর গান গাইব না। তা আবার হয় নাকি! শুনবে বলে সবাই কত আশা করে থাকে।’ কিন্তু এইচএমভি-ও ইতস্তত করছে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। পুজোর মধ্যে গান রেডি করা যাবে না। শুনে মান্নাদা বললেন, ‘কুছ পরোয়া নেই’। এক আত্মীয়ের নামে নিজেই খুলে ফেললেন প্যারামাউন্ট মিউজিক ক্যাসেট। লোগো পিএম— অর্থাৎ প্রবোধ-মান্না। ভেবে দেখুন, শুধু পুজোর গান গাইবেন বলে কোম্পানিই খুলে ফেললেন। অত শরীর খারাপ নিয়েও গাইলেন পুজোর গান— ‘স্নেহ-মায়া-ভালবাসা’। গান বাঁধলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুপর্ণকান্তি। ভাগ্যিস গাইলেন, নইলে আমরা কি পেতাম ‘দশ বছরের বংশী’র মতো গান?
এই গানে গানে দুর্গাপুজো মান্নাদা করে গেছেন প্রায় সারা জীবন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তার ব্যতিক্রম বিশেষ ঘটেনি। ১৯৬৯-এ আর ডি গাইলেন ‘মনে পড়ে রুবি রায়’, মান্নাদা শোনালেন ‘লোলিতা’, ‘রঙ্গিনী কত মন’। ১৯৭৪-এ হৈমন্তীদি গাইলেন ‘ওগো বৃষ্টি আমার’, মান্নাদা ‘একি অপূর্ব প্রেম’, ‘অভিমানে চলে যেও না’, ‘আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে’। তিয়াত্তরে নিজের সুরে কিশোর কুমার শোনালেন ‘নয়ন সরসী কেন’, ‘এই যে নদী’। মান্নাদা ‘বেশ তো তাই হোক’, ‘কথা দাও আবার আসবে’। পঁচাত্তরে ১২টি গানের এলপি করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। নিজের সুরে চারটি গান গাইলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মান্নাদাও সে বছর ছড়িয়ে দিলেন কথা-সুরের মণি-মুক্তো—‘জড়োয়ার ঝুমকো থেকে’, যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’, ‘ও কেন এত সুন্দরী হল’। দুর্গাপুজোর গানে মান্নাদা যেমন দেবীর আরাধনা করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের শ্রবণ।
ক’বছর মান্নাদা একটু বিষয়ধর্মী গান করছিলেন। ২০০৫। মান্নাদার ফোন—শুনুন এইচএমভি খুব করে বলছে একটা পুজোর অ্যালবাম করে দিতে। আমি এ বার আধুনিক গানই গাইব’। বললাম, ‘কী ধরনের গান লিখব মান্নাদা?’ মান্নাদা অবাক হয়ে বললেন, ‘কী ধরনের গান মানে? প্রেমের গান মশায় প্রেমের গান, যে রকম আমি গাই আর কি’। ২০০৭-এ এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হল মান্নাদার শেষ পুজোর অ্যালবাম ‘ঠিক ছবির মতো’। নিউইয়র্কের তপন মাইতি, ইউস্টনের রফিক খান, ক্যালিফোর্নিয়ার সুনন্দার কাছে শুনেছি, আমেরিকার প্রতিটি অনুষ্ঠানে মান্নাদা এই অ্যালবামের গান গাইতেনই—অবধারিত ছিল কাকাকে নিয়ে ‘ঠিক ছবির মতো’। যে গানকে বলতেন নিজের অন্যতম সেরা সুর ‘আকাশ দ্যাখে মুখ’, ‘এক নির্জন সৈকতে’। আরও নিখুঁত করার জন্য রিডাবিং-এর জন্য কলকাতায় এসেছেন। বলতেন, ‘পুজোর গান বলে কথা, ঠিক মতো গাইতে হবে তো।’ মান্নাদা তখন সাতাশি।
পুজোর দিনগুলো কেমন কাটত মান্নাদার? পুজো নিয়ে মান্নাদার আলাদা কোনও আবেগ ছিল বলে মনে হয় না। সারা ভারত থেকে ডাক আসত গান গাইবার জন্য—দিল্লি, মুম্বই, কানপুর, কোথায় নয়? গান শুনিয়েই মান্নাদার আনন্দ। আলাদা করে অঞ্জলি, প্রতিমা দর্শন— মান্নাদার কাছে কোনও বাধ্যহাধকতা নেই। একটা কথা। মান্নাদাকে পুজোর সময়ে কলকাতাতে একটু কমই দেখা যেত।
বেঙ্গালুরুর বাঙালি উদ্যোক্তারা নজর রাখতেন পুজোর সময়ে মান্নাদা বেঙ্গালুরুতে আছেন কিনা। উলসুর লেকের পুজোয় যেতে মান্নাদাও খুব ভালবাসতেন। লেকের মনোরম পরিবেশ মান্নাদার খুব ভাল লাগত। মান্নাদার খুব প্রিয় ছিল বেঙ্গালুরুর আরও দুটো জায়গা—কাব্বনপার্ক আর লালবাগ। এই লালবাগ ঘিরে মান্নাদার অনেক স্মৃতি। বৌদির সঙ্গে সম্পর্কের সূচনায় দু’জনে এখানে কত বার এসেছেন ঘুরতে। পরেও বৌদিকে নিয়ে চলে আসতেন এখানে। মনে করতেন ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।
পুজো নিয়ে মান্নাদার আলাদা আবেগ ছিল না সত্যি, কিন্তু অন্যের আবেগকে মূল্য দিতেন। পুজোর আগে কোথাও অনুষ্ঠানে গেলে বাড়ির সবার জন্য নতুন জামাকাপড় আনতেন। অবশ্য এটি মান্নাদার বরাবরের অভ্যাস। যেখানেই যান না কেন সবার জন্য কিছু কিছু আনবেনই। কলকাতায় মদন ঘোষ লেনের বাড়ির জন্য মান্নাদার ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। কেউ ম্যাট্রিক পাশ করলেই ঘড়ি। আর পুজোর সময় সবার জন্য বরাদ্দ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা। সময়মতো পৌঁছে যেত। মান্নাদার কখনও ভুল হয়নি। বাড়ির সবাই নিজের পছন্দের পোশাক কিনছে—তাতেই মান্নাদার আনন্দ।
মান্নাদার আরাধ্য দেবী ছিলেন মা সরস্বতী। সাদা একটি অপূর্ব মূর্তি। পরনে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। প্রতিদিন রেওয়াজের পর মায়ের পায়ে ফুল রাখতেন। জ্বেলে দিতেন ধূপ। কয়েক মুহূর্ত মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। মনে মনে কী যেন বলতেন। সেই ছিল মান্নাদার পুজো। ২০০০ সাল নাগাদ মান্নাদা যখন মুম্বই থেকে বেঙ্গালুরুতে চলে আসেন, নিজের হাতে মা সরস্বতীর এই মূর্তিটি প্যাক করেছিলেন। সবাইকে বলতেন— ‘খুব সাবধান, দেখো যেন ভেঙে না যায়।’। যারা বেঙ্গালুরুতে মান্নাদার বাড়িতে গেছেন হয়তো এই মূর্তিটি দেখেছেন। এখানেও একই ভাবে মায়ের পুজো করতেন।
মান্নাদার দুর্গাপুজো ভাবলে আমার কানে ভেসে আসে প্রাণ-ভরানো, সব-ভোলানো সেই মধুর মধুর গান। তিল তিল করে তৈরি করা। আর এক ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, বিষণ্ণ মুখ। ২০১২। বৌদি চলে গেছেন। বানাসয়াবির পুজো মণ্ডপে দু’চোখ বুজে কাউকে খুঁজছিলেন মান্নাদা। পরের পুজোয় চলে গেলেন তাঁর কাছে।