রবীন্দ্রনাথের শেষ ছবি। ১৯৪১-এর জুলাইয়ে বিনোদ কোঠারির তোলা।
আমরা ও তোমরা, এই যে বিভাজন রাজনীতি থেকে ধর্ম সবখানে আজ ছড়িয়ে গিয়েছে, এর বিপদটা বহু আগেই বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পঁচিশে বৈশাখকে ঘিরে তাঁর সাহিত্য-শিল্প নিয়ে যত মাতামাতি আমরা করি সে তুলনায় তাঁর এই সমাজ-ভাবনা না-ছোঁয়াই থেকে যায়। ধর্ম এবং তার সূত্র ধরে যে অসহিষ্ণুতার আবহ আজ গোটা দেশ জুড়ে তার উল্টো দিকে দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে চেনার এটাই বোধহয় সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সময়।
২১ জৈষ্ঠ্য ১৩৩৮, রবীন্দ্রনাথ হেমন্তবালা দেবীকে লিখছেন, ‘বৈষ্ণব যেখানে বোষ্টম নয় সেখানে আমিও বৈষ্ণব, খৃষ্টান যেখানে খেষ্টান্ নয় সেখানে আমিও খৃষ্টান’।
হেমন্তবালা দেবী তাঁর নিজস্ব বিশ্বাসের জগত থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চিঠি-বিনিময় করেছিলেন। সমাজ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি নিয়ে বড় বড় গালভরা কথা তিনি বলেননি। আর সেই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের ধর্মবোধের সহনশীলতা এবং উদারতা অনেক সহজ করে পাওয়া যায় সেই সব চিঠিপত্রে। যেমন আর একটি চিঠিতে,
‘...যেখানে মন্দিরের দেবতা মানুষের দেবতার প্রতিদ্বন্দ্বী, যেখানে দেবতার নামে মানুষ প্রবঞ্চিত সেখানে আমার মন ধৈর্য্য মানে না।...দেশের লোকের শিক্ষার জন্যে অন্নের জন্যে, আরোগ্যের জন্যে এরা কিছু দিতে জানে না, অথচ নিজের অর্থ-সামর্থ্য সময় প্রীতি ভক্তি সবই দিচ্চে সেই বেদীমূলে যেখানে তা নিরর্থক হয়ে যাচ্চে। মানুষের প্রতি মানুষের এত নিরৌৎসুক্য, এত ঔদাসীন্য অন্য কোনো দেশেই নেই, এর প্রধান কারণ এই যে, এ দেশে হতভাগা মানুষের সমস্ত প্রাপ্য দেবতা নিচ্চেন হরণ করে।...’
এই চিঠি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ১৯৩১-এ, অর্থাৎ মৃত্যুর দশ বছর আগে। তত দিনে তাঁর সমাজবোধ অনেক পরিণতি পেয়েছে। আর তার জন্য তাঁকে চক্ষুশূল হতে হয়েছে সনাতনীদের, তীব্র প্রতিরোধ, এমনকী ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও সইতে হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় যেটা সেটা হল কোমর বেঁধে নিজের বক্তব্য নিয়ে ঝগড়া করতে নামেননি তিনি। মানুষকে তিনি ধর্মের উপরে তো বটেই, এমনকী দেশের উপরেও জায়গা দিয়েছেন। হেমন্তবালা দেবীকেই লিখেছিলেন, ‘আমার কথা ব্রাহ্মসমাজের কথা নয়, কোনো সম্প্রদায়ের কথা নয়, য়ুরোপ থেকে ধার-করা বুলি নয়। য়ুরোপকে আমার কথা শোনাই, বোঝে না; নিজের দেশ আরো কম বোঝে। অতএব আমাকে কোনো সম্প্রদায়ে বা কোনো দেশখণ্ডে বদ্ধ করে দেখো না। আমি যাঁকে পাবার প্রয়াস করি সেই মনের মানুষ সকল দেশের সকল মানুষের মনের মানুষ, তিনি স্বদেশ স্বজাতির উপরে। আমার এই অপরাধে যদি আমি স্বদেশের লোকের অস্পৃশ্য, সনাতনীদের চক্ষুশূল হই তবে এই আঘাত আমাকে স্বীকার করে নিতেই হবে’।
জোড়াসাঁকোয় বিশ্বভারতী সম্মেলনীর প্রথম অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ।
সাহস করে পীরালি ব্রাহ্মণের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন ঠাকুরবংশের পূর্বপুরুষ। আমরা ও তোমরা-র এই বিভাজনটা স্বীকার করেই রবীন্দ্রনাথের জন্ম। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার পরেও বিয়ে ইত্যাদির ক্ষেত্রে সমস্যাটা যায়নি। কিন্তু এর প্রতিবাদে রাতারাতি কোনও বিপ্লব ঘটাতে চাননি রবীন্দ্রনাথ। তিনি বিশ্বাস করতেন, সেটা করা যায় না। বরং তিনি নিজেকেই তাঁর সহিষ্ণু বিশ্বাসে অটল থাকার কথা বলছেন, ‘ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে যে মঙ্গলের ধারা প্রবাহিত হইতেছে তাহাকে পদে পদে “আমরা” ও “তোমরা” বাঁধের দ্বারা বিভক্ত করিয়া ধর্ম্মকে ও সাম্প্রদায়িক জয়পরাজয়ের আস্ফালনের সামগ্রী করিয়া অকারণে যাঁহারা কল্যাণকে বাধাগ্রস্ত করিয়া তোলেন তাঁহারা কেবলমাত্র ব্রাহ্ম নামটাকে গ্রহণ করিয়া উপবীতধারী অথবা অন্য কাহারও চেয়ে আপনাকে শ্রেষ্ঠ কল্পনা করিবার অধিকারী নহেন। তাঁহাদের ব্রাহ্ম নামই উপবীতের অপেক্ষা অনেক প্রবল ভেদচিহ্ন, এবং তাহার অহঙ্কারও বড় সামান্য নহে। অহঙ্কারের দ্বারা অহঙ্কারকে মথিত করিয়া তোলা হয়, সেই অহঙ্কারের বাধাই সকলের চেয়ে বড় বাধা এই কথা মনে নিশ্চয় জানিয়া সর্ব্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক চাপল্যের মাঝখানে অবিচলিত থাকিয়া আমরা যেন এই প্রার্থনাকেই চিত্তের মধ্যে বিনম্রভাবে ধরিয়া রাখিতে পারি যে স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনক্তুঃ।’
আজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে সমষ্টি বা ইনক্লুসিভনেস-এর কথা বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের সমাজ-ভাবনায় তার একটা পরিচয় বার বার পাওয়া যায়। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েই যে কাজের কাজ হয় সেটা রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বাস করতেন না এটাও যে অসহিষ্ণুতার আবহ থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড় করিয়ে রাখলেই প্রলয় বন্ধ থাকে। আদি ব্রাহ্মসমাজ থেকে তাঁর পদত্যাগের দাবি যখন উঠল তখন রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,
‘আমি বরঞ্চ সমাজের অশ্রদ্ধাভাজন হইতে রাজি আছি কিন্তু সমাজকে অশ্রদ্ধা করিতে সম্মত নহি। অব্রাহ্মণকে বেদীতে বসাইলে সমাজ অশ্রদ্ধা করিবে এ কথাকে শ্রদ্ধা করিলে সমাজকে অশ্রদ্ধা করা হয়। যুক্তিহীন অর্থহীন আচারই যে হিন্দু সমাজের প্রকৃতিগত এ কথাকে আমি শেষ পর্য্যন্তই অস্বীকার করিব।...কোনমতে ব্রাহ্মণকে বেদীতে বসাইয়া দিলেই অদ্যকার হিন্দুসমাজ যদি আমাকে শ্রদ্ধা করে তবে সেই শ্রদ্ধা গ্রহণ করিয়া মানবসমাজের চিরকালীন সত্যধর্ম্মকে অশ্রদ্ধা করিতে পারিব না।’ আবার, এক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ইংরাজ ও ভারতবাসী’ প্রবন্ধটি পড়েছিলেন। তার সভাপতি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ সম্রাট আকবরের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মনির্বিশেষে প্রজার কল্যাণের প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু সভাপতির সমাপ্তি ভাষণে বঙ্কিমচন্দ্র বললেন, ‘আকবরের নামে দেশের লোক এত নাচে কেন?’
মহাজাতি সদনের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরত্চন্দ্র বসু, সুভাসচন্দ্র বসু এবং অন্যরা।
এই ভাবে বার বার সহিষ্ণুতার পক্ষে একলা দাঁড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্কিমচন্দ্রের বিপক্ষতা করেছেন। মহাত্মা গাঁধীকে গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করলেও তাঁর সব কথা মেনে নেননি। কিন্তু সেই না-মানার মধ্যেও একটি শান্ত সহনশীলতা বজায় রেখেছেন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা তাঁর ‘সত্যের আহ্বান’ আজও রবীন্দ্রনাথের সেই একলা মূর্তিটি মনে পড়ায়। আবার গাঁধীর দৈববাণীতে বিশ্বাসের বিপক্ষে বলেছেন, ‘যুক্তির পরিবর্তে উক্তি তো কোনোমতেই চলবে না। মানুষের মুখে যদি আমরা দৈববাণী শুনতে আরম্ভ করি তা হলে আমাদের দেশে, যে হাজার রকমের মারাত্মক উপসর্গ আছে এই দৈববাণী যে তারই মধ্যে অন্যতম এবং প্রবলতম হয়ে উঠবে।’
সেই উপসর্গই এই সময়ের গভীর, গভীরতর অসুখের চিহ্ন।
ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে