বোদ্ধা ব্যক্তিদের কথা আলাদা।
কিন্তু, আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যখন নাটক দেখতে যাই, প্রথমেই টানে গল্পটা। তার পরে অভিনয়। একটা প্রযোজনায় এ দু’য়ের বাইরে আরও নানা উপাদান থাকে। কাউজান নামে এক পণ্ডিত জানিয়েছেন, মোট ১৩টা উপাদান মিলে তৈরি হয়ে ওঠে একটা প্রযোজনা। তার মধ্যে ওয়ার্ড বা লিখিত নাটকের স্থান এক নম্বরে। মঞ্চে যা কিছু দেখানো হয়, যা কিছু শোনানো হয়, তার সব ক’টাই কোনও না কোনও ভাবে আমাকে নাটকটিকে ভাল লাগতে সাহায্য করে।
এখন, একটা গল্প ভাল লাগবে কেন?
‘তাসের দেশ’ নৃত্যনাট্যে রবীন্দ্রনাথ।
নানা কারণের মধ্যে অন্যতম নিশ্চয়ই এই, সে গল্পটা কোথাও তার ভেতরে বুনে দেওয়া বিশেষ চরিত্র বা বিশেষ ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়। অনেক সময়েই তা হয়ে ওঠে আমার গল্প। দেখতে দেখতে বা শুনতে শুনতে মনে হয়, সরাসরি না হোক, এ নাটক অন্তরে অন্তরে আমার জীবনের কথাই বলছে। ঘটনার দিক থেকে হয়তো অনেক সময়েই নয়, কিন্তু অনুভবের দিক থেকে। যারা নাটকটা করছেন তাদের দিক থেকেও একই কথা— এক জন শিল্পী তার বাইরের দক্ষতা দিয়ে নাটক করে দিতে পারেন। কিন্তু, কোথাও এ লেখা সেই শিল্পী মানুষটিকে তাঁর গহনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে তবেই তো তাঁর ভাল লাগার সম্পর্ক তৈরি হবে নাটকের সঙ্গে।
প্রশ্ন হল, রবীন্দ্রনাথের নাটক কি অমন করে আমার সঙ্গে তার সেতু তৈরি করতে পারে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে নানা দিক খতিয়ে দেখা চাই। প্রথম হল, রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে বহু ধরনের নাটক লিখেছেন। তাদের কয়েকটা সেই সময়ের প্রথাগত নাটক লেখার ধরন মাথায় রেখেই। যেমন ‘মায়ার খেলা’, ‘রাজা ও রানী’ বা ‘বিসর্জন’। মনে রাখতে হবে তাঁর নৃত্যনাট্যগুলির কথাও। নাচ আছে, গান আছে, অনেক সময়েই একটা গল্পও আছে। ভেতরের গভীর অর্থ বার করা বা প্রাসঙ্গিক করার কথা মনে না রেখেই দিব্যি তাদের মঞ্চে নিয়ে আসা যেতে পারে। এবং সেই সব প্রযোজনা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কঠিন নয় তা তো আমরা অহরহ দেখতে পাই।
তা ছাড়া, আরও যে অজস্র ধরনের নাটক লিখেছেন তিনি, সেগুলো কি এখনও পর্যন্ত প্রসঙ্গিক হতে পারে আমাদের কাছে?
মনে রাখতে হবে, উনিশ শতকের সাতের দশকের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথ যখন নাটক লেখা শুরু করছেন, তখন যাঁরা নাটক লিখছেন, যেমন গিরিশচন্দ্র, রাজকৃষ্ণ রায়, অমৃতলাল বসু প্রমুখ আজ আর প্রসঙ্গিক নন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে যাঁরা সমকালীন হবেন সেই দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষীরোদপ্রসাদের নাটকও এখন হয় না। এমনকী, রবীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার পরে যাঁরা বাংলা নাটক লিখতে এলেন সেই বিজন ভট্টাচার্য, তুলসী লাহিড়ী, দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়রাও সেকেলের দলে। তা হলে রবীন্দ্রনাথ এখনও টাটকা থাকেন কী করে? এই সূত্রে আরও একটা কথা। রবীন্দ্রনাথের নাটকের সঙ্গে অনেক সময়েই জুড়ে দেওয়া হয়েছে আধ্যাত্মিকতার ধারণাকে। সেই ধারণা তো আমাদের মন থেকে প্রায় মিলিয়ে গিয়েছে বলা যায়।
নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা-র শিল্পীদের নিয়ে দিল্লিতে রবীন্দ্রনাথ। মাটিতে বসে নন্দিতা কৃপালনি ও শান্তিদেব ঘোষ।
রবীন্দ্র সমকালীন যে নাট্যকারদের কথা বললাম, তাঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কিন্তু দু’টি বড় ফারাক আছে। রবীন্দ্রনাথের নাটকের গড়নটা ছিল অন্যদের থেকে একদম আলাদা। নাটকের পক্ষে অভাবিত সব বিষয় নিয়ে লেখা, অদৃষ্টপূর্ব তার প্রকাশভঙ্গি। যে কারণে সেই সময়কার পাবলিক স্টেজ তাঁকে পাত্তাই দেয়নি। অথচ, ঠিক বাস্তবতা বা সম্ভব্যতা দিয়ে ঘেরা নয় বলেই যে কোনও সময়ে, যে কোনও রকম করে উপস্থাপিত করার পরিসর তার মধ্যে থেকে যায়। সম্ভবত সেই জন্যেই, স্বাধীনতার পরে শম্ভু মিত্র উৎপল দত্তেরা নাটক খুঁজতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটকের মধ্যে আধুনিক প্রকাশভঙ্গি এবং বিষয়ের একটা খনি আবিষ্কার করলেন। নাটক ব্যাপারটা এই রকম, এই নিশ্চিন্ততাকে বিষয় আর প্রকাশভঙ্গি দিয়ে ঝাঁকুনি দিতে পারে রবীন্দ্রনাথের নাটক। সে ঝাঁকুনি প্রযোজনাতেও দেওয়া গিয়েছিল, তার উপর ‘বহুরূপী’ বা ‘লিট্ল থিয়েটার’-এর দর্শক তো ঠিক পেশাদার থিয়েটারের দর্শক নন! শিল্প, জীবন বা রাজনীতি সম্পর্কে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি হয়েছে এঁদের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিকে তাঁরাও তাঁদের জীবন বা চারপাশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারছিলেন। সে দেখায় বাধা কম ছিল না। বিশ্বভারতী এই অন্য রকম প্রযোজনাগুলি সম্পর্কে যে খুব প্রসন্ন ছিল না, তা তো সবাই জানেন। উৎপল দত্ত তাঁর ‘অচলায়তন’ বা ‘কালের যাত্রা’কে বেশ স্পষ্ট করে সমকালীন রাজনীতির সঙ্গে মেলান। শম্ভু মিত্র একটু আবছা রাখেন। রবীন্দ্রনাথের অন্য রকম নাটকের সঙ্গে তাঁদের অন্য রকম প্রয়োগ ভাবনার দিব্যি মিলমিশ হয়ে গেল।
আর একটা কাণ্ড হল! রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার একটা জীবন ঘনিষ্ঠ ইহলৌকিক ব্যাখ্যা বেরিয়ে আসছিল এঁদের কাজ থেকে। ‘রাজা’ বা ‘ডাকঘর’-এর রাজাকে কি ভগবান হিসেবেই দেখতে হবে? তাকে এমন কোনও চরিতার্থতা হিসেবে দেখা যায় না, যার দিকে ঈশ্বরবিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী যে কোনও গভীর মনের মানুষ তৃষ্ণার্তের মতো তাকিয়ে থাকেন? বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের ভগবান তো ঠিক মাথার পেছনে গোল জ্যোতিওয়ালা কোনও ছবি নন! তাঁর নাটকগুলোও নয় নিরক্ত কিছু একমেটে বাণী— ঈশ্বরের সঙ্গে নিজের নিরন্তর বোঝাপড়াও করতে চেয়েছেন মানুষটি। তাই রবীন্দ্রনাথের ভগবানকে অন্য ভাবে দেখলে কোথাও ঠেকে যায় না।
যখনকার কথা বলছি, তখনকার থেকে সমাজের চেহারা অনেক পাল্টে গিয়েছে। শিল্প উপভোগের ধরনে বিস্তর বদল এসেছে। সেই বদলের ছাপ তো আজকের রবীন্দ্রনাটকের ব্যাখ্যা বা প্রযোজনাতেও পড়বে। প্রথম বদল, সমাজের আলোকিত অংশ সাধারণ ভাবে এখন আর কোনও উঁচু ভাবনা বা আদর্শে বিশ্বাস করে না, যা কি না পাঁচ ছয় বা এমনকী সাতের দশকেও ছিল। এর পিঠোপিঠি দ্বিতীয় বদল, থিয়েটারের মানুষ হিসেবে এবং অধ্যাপক হিসেবেও বুঝতে পারি, আমাদের গভীর অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। শিল্পের থেকে উঠে আসা কোনও ফুলকি আর মনের মধ্যে তেমন করে আর আগুন ধরাতে পারে না। অথচ রবীন্দ্রনাটকের প্রধান জোর তো এই গুলোই। তা হলে, আজকের দিনে কেমন করে মঞ্চায়িত হবে এই সব নাটক? আর একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তীব্র হয়ে উঠেছে এর মধ্যে। অন্য দিকে রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে কপিরাইটের নিষেধা়জ্ঞাও সরে গিয়েছে। ফলে যে কোনও ভাবেই নাটকগুলোকে তৈরি করা যায়। কোনও প্রতিষ্ঠানের সেখানে বাধা দেওয়ার হকই নেই।
‘বাল্মিকী প্রতিভা’য় অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ।
ফলে, হাল আমলে সুমন, কৌশিক বা মণীশদের হাতে রবীন্দ্রনাটকের যে চেহারা দেখা গেল, তার মধ্যে মূল পাঠকে নানা ভাবে ভেঙে ফেলার স্পর্ধা খুব চোখে পড়ে। এই স্পর্ধা কোথাও কোথাও নিশ্চয়ই ভাল। আমাকে অন্তত কখনও কখনও মনে মনে বাহঃ বলে উঠতে হয়েছে। তবু এ কথাও বলব, অনেক সময় উদ্ভাবিত না হয়ে তাকে খানিকটা আরোপিত বলে মনে না হয়ে পারে না। তবে কি মূল পাঠকে বজায় রেখে প্রযোজনা সাজানোয় কোনও সঙ্কোচ কাজ করছে? যথেষ্ট আধুনিক হয়ে উঠতে পারব না এমন সঙ্কোচ! সুমন যখন কাঁটাতারের বেড়া লাগিয়ে ‘রক্তকরবী’র মঞ্চ বানান তখন মন ভরে যায়। কিন্তু, অধ্যাপককে হুইল চেয়ারে আনার পরিকল্পনা চোখে আঙুল দিয়ে মাস্টারি মনে হয়।
কৌশিক আধুনিক কালের একটি ঘরে অমলকে রাখেন। কিন্তু, দইওয়ালার সূত্রে যে কনজিউমারিজমের অনুষঙ্গ বুনে দেওয়া হয়, তা কি নাটকের সঙ্গে মেশে? আমার তো মনে হয়েছে, এই সময়ের নির্দশকেরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন ‘ডাকঘর’ নিয়ে। লজ্জাবতী লতার মতো এই নাটকটি, যেন বাইরের একটু শ্বাস লাগলেই শুকিয়ে যাবে। ‘ডাকঘর’ যাঁরা করছেন, তাঁরা কি তাই ডাক্তার করজাকের আখ্যান টেনে এনেছেন এর মধ্যে? যাতে নাৎসি অত্যাচারের নাটকীয় অভিঘাতের পশ্চাৎপট একে রক্ষা করতে পারে? মন একটু খুঁতখুঁত করে। জীবন মৃত্যুর সম্পর্ক নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অনুভবকে কি তা হলে করজাক আর তাঁর ছেলের দলের সাহায্য নিয়ে শিখতে হবে আমাদের?