king cobra in Nepal

এভারেস্টের পাদদেশে শঙ্খচূড়, কেউটের ফোঁসফোঁসানি! উষ্ণায়নই কি ‘শাপে বর’ হচ্ছে মাঠেঘাটে ঘোরা শীতল রক্তের প্রাণীদের?

ধানখেত, জলাভূমি এবং ম্যানগ্রোভ বনের মতো গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়া এবং আর্দ্র অঞ্চলে বসতি তৈরি করে শঙ্খচূড়েরা। শীতল রক্তের প্রাণী হওয়ায় এরা পাহাড়ি ঠান্ডা অঞ্চল এড়িয়ে চলতেই ভালবাসে। তরাই অঞ্চলে শঙ্খচূড়ের দেখা মিললেও নেপালের শীতল, উঁচু অঞ্চলে ঘন ঘন এদের দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২৫ ০৭:৫৬
Share:
০১ ১৯

প্রাণ কাড়তে এক ছোবলই যথেষ্ট। ভয়ঙ্কর বিষধর সাপের মধ্যে অন্যতম। নাম শুনলেই শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরে। বিষধর সাপের রাজা কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়। একটি প্রমাণ আকারের শঙ্খচূ়ড়ের বিষে নিউরোটক্সিন থাকে। এই সাপের কামড়ে হৃৎস্পন্দন থেমে যেতে পারে। মানুষ তো কোন ছার, পূর্ণবয়স্ক হাতিকেও তিন ঘণ্টার মধ্যে মেরে ফেলতে পারে শঙ্খচূড়ের বিষ। ওফিয়োফ্যাগাস হ্যানা বা শঙ্খচূড় এমন একটি সাপ যারা নিজেদের প্রজাতিকেও খাদ্য হিসাবে বেছে নেয়।

০২ ১৯

শঙ্খচূড়ই হল বিশ্বের দীর্ঘতম বিষধর সাপ। এই সাপকে বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান সাপ বলেও ধরা হয়ে থাকে। শিকার কেমন, তা দেখে এরা শিকারের কৌশল পাল্টে ফেলে। এদের প্রিয় খাদ্য হল গোখরো, ছোট অজগর, দাঁড়াশ। সেই খাবারের অভাব দেখা দিলে এরা পাখি, টিকটিকি কিংবা মেঠো ইঁদুরও বাদ দেয় না। টিকে থাকার লড়াইয়ে নিজের গোষ্ঠীর সদস্যদেরও গিলে খেতে কসুর করে না শঙ্খচূড়।

Advertisement
০৩ ১৯

ধানখেত, জলাভূমি এবং ম্যানগ্রোভ বনের মতো গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়া এবং আর্দ্র অঞ্চলে বসতি তৈরি করে শঙ্খচূড়েরা। শীতল রক্তের প্রাণী হওয়ায় এরা পাহাড়ি ঠান্ডা অঞ্চল এড়িয়ে চলতেই ভালবাসে। রক্তে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাপ তাদের চারপাশের বস্তু থেকে তাপ গ্রহণ করে।

০৪ ১৯

সাপ ঠান্ডা রক্তের প্রাণী। প্রকৃতির তাপমাত্রা যেমন হবে, তাদের দেহের তাপমাত্রাও তেমন হবে। ফলে খুব শীত পড়লে গর্ত খুঁজে দেহের তাপমাত্রা ঠিক রাখে তারা। খুব শীতে সাপেদের বাইরে দেখা মেলে না। সে কারণে শীতকাল এলেই সাপেদের বেশির ভাগ প্রজাতি শীতঘুমে চলে যায়। তবে বলে রাখা ভাল সব সাপ শীতঘুমে যায় না। বিশেষ করে চন্দ্রবোড়া এবং ময়াল। এদের প্রজনন ঋতু হল শীতকাল।

০৫ ১৯

বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা বিষাক্ত সাপ শঙ্খচূড় সাধারণত ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ফিলিপিন্সের সমতলের ঘন অরণ্যে বাস করে। সেই চিরপরিচিত ধারণা সম্পূর্ণ বদলাতে চলেছে। আর এই ঘটনা কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে পরিবেশবিদ ও সর্পবিদদের মনে।

০৬ ১৯

মোনোক্লেড কোবরা, সাদা বাংলায় আমরা যাকে কেউটে বলে থাকি, ফণার একটি গোলাকার চিহ্ন দ্বারা এদের চেনা যায়। এদের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাওয়া যায়। সাধারণত নিম্নভূমি, জলাভূমি এবং ধানখেতে এদের দেখা মেলে, পাহাড়ি অঞ্চলে সাধারণত দেখা যায় না। ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালের তরাই অঞ্চলে শঙ্খচূড়ের দেখা মিললেও সে দেশের শীতল, উঁচু অঞ্চলে এদের দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে।

০৭ ১৯

সেই বিরল ঘটনারই সাক্ষী হয়েছেন এভারেস্ট সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা। নেপালের সংবাদমাধ্যম ‘কাঠমান্ডু পোস্ট’-এর এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে এক অদ্ভুত ঘটনা। মাউন্ট এভারেস্টের কাছে দেড় মাসের মধ্যে ন’টি শঙ্খচূড় এবং পদ্মগোখরো মিলিয়ে কোবরা প্রজাতির মোট ১০টি সাপের সন্ধান মিলেছে। স্থানীয়েরা একটি জঙ্গলে শঙ্খচূড়ের বাসা ও কয়েকটি ডিম উদ্ধার করেছেন বলে প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।

০৮ ১৯

গোপালেশ্বর, ভাঞ্জিয়াং, সোখোল এবং ফুলচকের মতো এলাকা থেকে সাপগুলিকে পাওয়া গিয়েছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, প্রতিটি সাপই স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়ির ভিতরে ও উঠোনের মধ্যে আস্তানা গেড়েছিল। এক সাপ উদ্ধারকারী ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে ১০টি বিষধর সাপকে উদ্ধার করে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় পুরসভার ওয়ার্ড চেয়ারম্যান জয় থাপা।

০৯ ১৯

জনকপুরের মিথিলা ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্টে সুবোধ আচার্য নামে এক সাপ উদ্ধারকারী এবং সাপ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, ট্রাকে করে কাঠ এবং খড় নিয়ে আসার সময় সাপগুলি উপত্যকায় চলে আসতে পারে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল এভারেস্টের পাদদেশের শীতল আবহাওয়ায় তারা নিজেদের বসবাস করার মতো পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছে।

১০ ১৯

কয়েক বছর ধরে সারা পৃথিবীর সঙ্গে বাড়ছে হিমালয়ের তাপমাত্রাও। আরও বেশি করে গলছে এভারেস্টের বিভিন্ন হিমবাহ। জলবায়ু সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা গিয়েছে উষ্ণায়নের প্রভাবে গলে গিয়েছে হিমালয়ের বিভিন্ন হিমচূড়া ও পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের বিভিন্ন হিমবাহও। নেপালে পাহাড় ও পর্বতের তাপমাত্রা প্রতি বছর ০.০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১১ ১৯

উষ্ণায়নের জন্য নেপাল, তিব্বত ও চিন হিমালয়ের জলবায়ু কী ভাবে দ্রুত বদলাচ্ছে, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়েছে। গবেষণা থেকে নেপাল, তিব্বত হিমালয়ের ভয়াবহ ভবিষ্যতের অশনি সঙ্কেত মিলেছে। দ্রুত উষ্ণায়নের দরুন নেপাল, তিব্বত ও চিনের হিমালয়ে বর্ষার মরসুমটাই বদলে গিয়েছে। তা আগের চেয়ে অনেকটাই দীর্ঘায়িত হয়েছে। ইদানীং ওই সব এলাকায় যখন-তখন বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ফলে আর্দ্র আবহাওয়ায় উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজে পাচ্ছে সাপেরা। বংশবৃদ্ধিও করতে শুরু করেছে বিষাক্ত সাপের প্রজাতি।

১২ ১৯

দ্রুত বদলাতে থাকা পরিবেশ নিয়ে কপালে ভাঁজ পড়েছে বিশেষজ্ঞদের। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে নেপাল অন্যতম বলে গণ্য হয়েছে। গত ১৫ বছরে এখানে ধীরে ধীরে উষ্ণ আবহাওয়া দেখা দিয়েছে। তথ্য বলছে, নেপালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রতি বছর ০.০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৩ ১৯

মাউন্ট এভারেস্ট থেকে কাঠমান্ডুর দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটার। সেখানে শঙ্খচূড়ের মতো বিষধর সাপের খোঁজ পাওয়ার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, তাদের আশ্রয়স্থল বদলের সংযোগ দেখছেন পরিবেশবিদদের একাংশ।

১৪ ১৯

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাহাড় এবং পাহাড়ি জেলাগুলি তরাইয়ের তুলনায় দ্রুত গতিতে উষ্ণ হচ্ছে। সেই উষ্ণতার কারণে সম্ভবত এই সাপগুলি নতুন অঞ্চলে অভিযোজিত হতে পারছে। উপত্যকার বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে শঙ্খচূড় উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শ্যুচাতর, গোকর্ণ, গোদাবরী এবং মকওয়ানপুরের সিসনেরি এলাকা। নেপালের স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করছেন, ঠান্ডা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে সাপগুলি।

১৫ ১৯

উষ্ণায়নের ফলেই যে শঙ্খচূড় পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বা বংশবৃদ্ধি করতে চাইছে এই ধরনের দ্রুত ও সহজ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে রাজি নন সরীসৃপবিদ অনির্বাণ চৌধুরী। তিনি আনন্দবাজার ডট কমকে জানিয়েছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন আজ বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি জ্বলন্ত সমস্যা। উষ্ণায়ন বন্যপ্রাণীদের প্রজননে বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন, অভিবাসনের ধরন, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি গভীর ভাবে প্রভাব ফেলেছে একথা অনস্বীকার্য। তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই যে সাপের প্রজাতিটি পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয় নিতে চাইছে তা একমাত্র কারণ বলা ঠিক হবে না।

১৬ ১৯

এই প্রজাতিটির সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫০ মিটার থেকে ২ হাজার মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় বাস করার নজির রয়েছে। ভারতের সিকিমে (১৮২০ মিটার, ইউকসুম গ্রাম), উত্তরাখণ্ডে (২১৮১ মিটার, মুসৌরি এবং ২৪০০ মিটার, মুক্তেশ্বর) এবং অরুণাচল প্রদেশে (২০০৫ মিটার, পশ্চিম কামেং) শঙ্খচূড়ের অস্তিত্ব রয়েছে বলে রেকর্ড করা হয়েছে।

১৭ ১৯

প্রতিবেশী দেশ নেপালেও পাহাড়ি উচ্চতায় প্রজাতিটির সন্ধান মেলার কথা রেকর্ডে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। পরিসংখ্যান তুলে ধরে অনির্বাণ জানিয়েছেন নেপালে ৭৭টি জেলার মধ্যে ৪১টি জেলায় (পূর্বে ৭৭টির মধ্যে ৩৭টি) শঙ্খচূড়ের দেখা মিলেছে। এর মধ্যে প্রায় ২১টি তরাই এবং অভ্যন্তরীণ তরাই অঞ্চলের এবং বাকিগুলি কাঠমান্ডু-সহ পাহাড়ি জেলা। ২০০৪ সালেই নেপালে মাকওয়ানপুর জেলার সিম্বাঞ্জিয়াং এই প্রজাতির উপস্থিতির খবর পাওয়া গিয়েছে। সেই অঞ্চলের উচ্চতা ২৫৬৬ মিটার। কাঠমান্ডুতে সাম্প্রতিক দেখা যাওয়ার চেয়ে অনেকটা উত্তরঘেঁষা এবং হিমালয়ের কাছাকাছি অবস্থিত।

১৮ ১৯

বছরের পর বছর ধরে সুউচ্চ পাহাড়ি অঞ্চলে এই প্রজাতির দেখা, বাসা, বাচ্চা, এমনকি প্রজননের কথা রেকর্ড করা হয়েছে। শঙ্খচূড়ের দর্শন মেলা ঘন ঘন না হলেও একেবারে বিরল নয় বলেই জানিয়েছেন সর্পবিদ। নেপালের উঁচু অঞ্চলগুলিতে শঙ্খচূড়ের পরপর দেখা যাওয়ার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে কারণ তাদের কাছাকাছি বাসস্থানগুলি বিঘ্নিত হয়েছে অথবা তারা শিকারের জন্য বেরিয়ে এসেছিল এবং সাপগুলি সংলগ্ন গ্রামগুলিতে আশ্রয় নিয়েছিল।

১৯ ১৯

২০২২ সালে ল্যানসেটের রিপোর্ট জানিয়েছিল, নেপালের তরাই অঞ্চলে সাপের কামড় এবং এর ফলে মৃত্যু যেন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার ৭০০ জন মারা যান। শিশু ও নারীরাই সবচেয়ে বেশি মারা যান সাপের কামড়ে। স্থানীয় অধিবাসীদের সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা আরও বাড়তে থাকার কারণে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা মন্ত্রক পাহাড়ি এলাকায় এক ডজনেরও বেশি স্থানে সাপের কামড় চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement