মিলনের জন্য ডেকে এনে মিলনসঙ্গীকেই উদরসাৎ করা। প্রাণীজগতের একাধিক প্রজাতির মধ্যে এর নজির খুঁজে পেয়েছেন জীববিজ্ঞানীরা। মাকড়সা, ব্যাঙ, ম্যান্টিস, অক্টোপাসের কয়েকটি প্রজাতি মিলনের পর তাদের সঙ্গীকে ভক্ষণ করে। বিজ্ঞানীদের ভাষায়, এই আচরণের নাম ‘সেক্সুয়াল ক্যানিবালিজম’, অর্থাৎ সঙ্গমের পর সঙ্গীকে খেয়ে ফেলা। সেই তালিকায় এ বার যুক্ত হল আরও একটি সরীসৃপের নাম।
যে-সে সরীসৃপ নয়। বিশ্বের সবচেয়ে ভারী সাপ। প্রজাতিটির লাতিন নাম ‘ইউনেক্টেস আকাইমা’। এর অর্থ ‘উত্তরের সবুজ বড় সাপ’। ওজনে মানুষের তিন গুণ। দেহ গাড়ির টায়ারের সমান প্রশস্ত।
এরা গহীন আমাজনের বাসিন্দা। নামটা শুনলেই একটা অন্য রকম কৌতূহল তৈরি হয়। ভয়ও গ্রাস করে। জল-জঙ্গলের ত্রাস হিসাবে তাদের ‘সুখ্যাতি’ও কম নয়! আমাজনের এই দানবাকৃতির সাপটিকে নিয়ে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা কিংবদন্তি। ঘন গভীর আমাজনের ‘মৃত্যুদূত’ হিসাবে পরিচিত অ্যানাকোন্ডা।
এই সরীসৃপটির এক বিরল এবং ভয়ঙ্কর আচরণ হল মিলনের পর স্ত্রী অ্যানাকোন্ডা প্রায়ই নিজের সঙ্গী, অর্থাৎ পুরুষ অ্যানাকোন্ডাকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। দক্ষিণ আমেরিকার এই দৈত্যাকার সাপ মিলনের পর পুরুষ সাপটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় না। সঙ্গমের শেষে নিজের শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করে মিলনসঙ্গী পুরুষ সাপটির। সেই মাংসেই উদরপূর্তি ঘটায় স্ত্রী অ্যানাকোন্ডা।
এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত বিশ্বের বৃহত্তম জীবিত অ্যানাকোন্ডা হল সবুজ অ্যানাকোন্ডা। এর পোশাকি নাম ‘নর্দার্ন গ্রিন অ্যানাকোন্ডা’। বোয়া পরিবারের সদস্য, সবুজ অ্যানাকোন্ডা জীববিজ্ঞানী মহলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাপ বলে পরিচিত। সবুজ অ্যানাকোন্ডা ২৯ ফুটেরও বেশি লম্বা হতে পারে। ওজনে ৫৫০ পাউন্ডেরও বেশি। ১২ ইঞ্চিরও বেশি ব্যাসের হতে পারে এরা। স্ত্রী অ্যানাকোন্ডার আকার পুরুষদের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে বড় হয়।
সবুজ অ্যানাকোন্ডা জলাভূমি এবং ধীর গতিতে বহমান নদীতে বা স্রোতের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। প্রধানত দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন এবং ওরিনোকো অববাহিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বৃষ্টি অরণ্যে দেখা মেলে দৈত্যাকৃতি এই সাপটির।
অ্যানাকোন্ডা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একা থাকতে পছন্দ করে। জুটি বাঁধে একমাত্র যৌনমিলনের সময়। তিন বা চার বছর বয়স হলেই স্ত্রী ও পুরুষ সাপ উভয়েই প্রজননক্ষমতা অর্জন করে। মার্চ থেকে মে মাসের শুষ্ক মরসুম এদের যৌনমিলনের আদর্শ সময়। স্ত্রী অ্যানাকোন্ডারা প্রতি দু’বছর অন্তর সঙ্গমে লিপ্ত হয়। সর্বাধিক ১২টি পুরুষকে আকর্ষণ করতে পারে একটি পূর্ণবয়ষ্ক স্ত্রী অ্যানাকোন্ডা।
মিলনেচ্ছুক স্ত্রী সাপটির দেহ থেকে ফেরোমেন নামের একটি রাসায়নিক নির্গত হয়। সেই গন্ধে আকর্ষিত হয়ে ছুটে আসে একাধিক পুরুষ সাপ। সেই সংখ্যা কখনও কখনও এক ডজনে দাঁড়িয়ে যায়। ‘ব্রিডিং বল’ বলা হয়ে থাকে এটিকে। প্রতিযোগীরা নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে কাঙ্ক্ষিত সঙ্গিনীকে পাওয়ার জন্য। একসঙ্গে একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয় স্ত্রী সাপটি। সঙ্গম প্রক্রিয়া কখনও কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। সঙ্গম শেষ হলেই আসে পুরুষ সাপের আত্মবলিদানের পালা।
দীর্ঘ মিলন শেষে পুরুষ সাপের গতি কমে যায়, পালানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে তারা। যৌনমিলন শেষে সবচেয়ে ক্লান্ত পুরুষটিকে নিজের দেহ আলিঙ্গন করার ছলে নিষ্পেষণ করতে শুরু করে স্ত্রী সাপটি। ধীরে ধীরে সঙ্গীর দেহ দিয়েই পেট ভরায় স্ত্রী অ্যানাকোন্ডা। পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে কাছের ও দুর্বলটিকে বেছে নেয় স্ত্রী সাপটি।
সবুজ অ্যানাকোন্ডা ওভোভিভিপারাস, অর্থাৎ তারা ডিম পাড়ে না, সরাসরি শাবকের জন্ম দেয়। গর্ভাবস্থার সময়কাল প্রায় সাত মাস স্থায়ী হয়। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী অ্যানাকোন্ডাটি সম্পূর্ণ অভুক্ত থাকে। দেহের সঞ্চিত শক্তির উপর নির্ভর করে এই সময়টা বেঁচে থাকে। এই শক্তি সে মিলনের সময়ই সঞ্চয় করে নেয়। নিজের শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টি ও শক্তি সঞ্চয়ের জন্য পুরুষ সাপকে শিকার করে স্ত্রী অ্যানাকোন্ডাটি।
স্ত্রী অ্যানাকোন্ডাটি শরীরের ওজনের ৩০ শতাংশ সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য ব্যয় করে। গর্ভাবস্থায় শিকার ধরার জন্য নড়াচড়া করে না তারা। কারণ একসঙ্গে কয়েক ডজন সন্তান প্রসব করে মা সাপটি। পুরুষ সাপটির দেহটি তাকে প্রোটিন সরবরাহ করে। গর্ভাবস্থায় তাকে ও তার ভ্রূণগুলিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। কারণ একটি পুরুষ অ্যানাকোন্ডার শরীরে থাকে ১৫–২০ কেজি প্রোটিন এবং ১০–১৫ কেজি চর্বি। শিকারের সময় পেটের চাপে ভ্রূণের ক্ষতি হতে পারে। ফলে মা সাপটি শিকার করা থেকে বিরত থাকে।
স্ত্রী গ্রিন অ্যানাকোন্ডা সঙ্গীকে খায় নিজে বাঁচার জন্য নয়, তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য। ৭ মাস পর স্ত্রী সাপটি ২০–৪০টি পর্যন্ত সন্তান প্রসব করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যে স্ত্রী সাপ তার সঙ্গী খেয়েছে তাদের বাচ্চার ওজন যারা সঙ্গীকে খায়নি তাদের বাচ্চার ওজনের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি এবং বেঁচে থাকার হার ৯০ শতাংশ।
গ্রিন অ্যানাকোন্ডার দু’টি ভাগ রয়েছে। আগে বিজ্ঞানীরা গ্রিন অ্যানাকোন্ডাকে একটিই প্রজাতি বলে মনে করতেন। পরে দেখা যায় ইকুয়েডরের আমাজন এলাকায় থাকা সবুজ অ্যানাকোন্ডার সঙ্গে দক্ষিণ আমাজন অববাহিকার সবুজ অ্যানাকোন্ডার জিনগত তফাত রয়েছে। সেই ভিত্তিতেই বিভাজন করা হয়েছে।
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজ়িয়ামের তথ্য অনুসারে, সবুজ অ্যানাকোন্ডা হল বিশ্বের সবচেয়ে ভারী সাপ। এদের একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এখনও পর্যন্ত রেকর্ড করা সবচেয়ে ভারী সাপের ওজন ছিল ২২৭ কেজি (৫০০ পাউন্ড)। সেটি ছিল ৮.৪৩ মিটার লম্বা (২৭.৭ ফুট) এবং প্রস্থে ১.১১ মিটার (৩.৬ ফুট)।
আড়েবহরে বিশাল হয় এরা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাপের মধ্যে গণ্য করা হয় এই প্রজাতিকে। চেহারা ভয়ের উদ্রেক করলেও সাপের এই প্রজাতি কিন্তু একেবারেই নির্বিষ। শিকারকে শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে ভয়াবহ চাপ দিতে থাকে এরা। সেই চাপেই শিকারের হাড়গোড় ভেঙে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। তার পর শিকারকে আস্ত গিলে খায় সাপটি। শিকার ধরার কায়দাও রোমহর্ষক। এদের চলাফেরা প্রায় নিঃশব্দ। তড়িৎগতিতে জল কেটে শিকারকে ঘায়েল করতে ওস্তাদ আমাজনের রাজা।
অ্যানাকোন্ডা ছা়ড়াও বেল প্রজাতির স্ত্রী ব্যাঙের মধ্যে ‘সেক্সুয়াল ক্যানিবলিজ়ম’ লক্ষ করা যায়। সাধারণত যৌনমিলনের জন্য পুরুষ ব্যাঙকে আকৃষ্ট করে স্ত্রী ব্যাঙ। কিন্তু মিলনের ঠিক আগের মুহূর্তে তার মন বদলে যেতে পারে। যে পুরুষ ব্যাঙের সঙ্গে মিলিত হবে বলে ভেবেছিল, তাকেই শিকার করে বসে বেল প্রজাতির স্ত্রী ব্যাঙ।
যৌনমিলনের আগেই শুধু নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে যৌনমিলন চলাকালীনও পুরুষ ব্যাঙকে গিলে ফেলে স্ত্রী ব্যাঙ। যৌনমিলনের পর পুরুষসঙ্গীর সঙ্গে এমন আচরণই করে থাকে এই বিশেষ প্রজাতির স্ত্রী ব্যাঙটি।