পোশাক ময়লা হয়েছে, পরিষ্কার করার ওয়াশিং মেশিনের বোতাম টেপার অপেক্ষা। কেচে, ধুয়ে, আধশুকনো হয়ে বেরিয়ে আসবে কয়েক মিনিটের মধ্যেই । আর আস্ত মানুষকে ধুয়ে ফেলতে চাইলে? তারও ব্যবস্থা করে ফেলেছেন উদীয়মান সূর্যের দেশের বিজ্ঞানীরা। জাপানের বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম মেধাচালিত এমনই একটি ‘ওয়াশিং মেশিন’ বানিয়ে ফেলেছেন। ১৫ মিনিটের মধ্যে এক জন মানুষকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিতে সক্ষম সে যন্ত্র।
চোখ কপালে ওঠার মতো এই আবিষ্কারটি জাপানের ওসাকায় অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড এক্সপো’ নামের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে হইচই ফেলে দেয়। পরীক্ষামূলক ভাবে সেখানে ‘হিউম্যান ওয়াশার ফর ফিউচার’ নামের যন্ত্রটি প্রদর্শিত হয়েছিল। প্রদর্শনীতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পর এ বার এটি বিক্রির জন্য বাজারে আনা হয়েছে। অদ্ভুত শোনালেও জাপানের একটি সংস্থার তৈরি এই যন্ত্রটি নিয়ে ছ’মাস ধরে বেশ উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল প্রদর্শনীতে।
বড় ক্যাপসুলের মতো একটি পডে সাহস করে ঢুকে পড়ার অপেক্ষা। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় মানবদেহ পরিষ্কার করে দেবে যন্ত্রটি। জাপানি সংস্থা ‘সায়েন্স কোং’-এর তৈরি ওই যন্ত্রের নাম ‘মিরাই নিঙ্গেন সেন্টাকুক’। স্বচ্ছ কাচে ঢাকা যন্ত্রটিতে ঢোকার পর মনে হবে ঠিক যেন স্পা করাচ্ছেন।
যন্ত্রের মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত জলের জেট এবং আণুবীক্ষণিক বুদবুদ রয়েছে। সেগুলির সাহায্যে শরীরের ময়লা দূর করে দেবে যন্ত্রটি। কৃত্রিম মেধার সাহায্য নিয়ে ত্বকের ধরন এবং শারীরিক গঠন অনুযায়ী উষ্ণ জল দিয়ে গ্রাহকের শরীর ধোয়ার ব্যবস্থা করবে যন্ত্রটি। ব্যবহার করা হবে আণুবীক্ষণিক বুদবুদ। পুরো বিষয়টিই ব্যবহারকারীর জন্য খুব আরামদায়ক হবে বলে দাবি নির্মাতা সংস্থার।
শরীর ধোলাইয়ের পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তিরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ‘হিউম্যান ওয়াশিং মেশিনে’। উষ্ণ আরামদায়ক স্পায়ের মতো পরিষেবার সঙ্গে হালকা সঙ্গীতের সাহায্যে মনকে শান্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে যন্ত্রে। কাপড় কাচার যন্ত্রের মতো বাড়তি নড়াচড়া বা ঘূর্ণনের মতো কোনও অসুবিধা সৃষ্টি হবে না এআই পরিচালিত ওই মানবদেহ পরিষ্কারের যন্ত্রটিতে।
ভিতরে ঢুকে হেলান দিয়ে বসার পর, দরজাটি আপনাআপনিই পিছনে বন্ধ হয়ে যাবে। তার পর কাজ শুরু করবে যন্ত্রটি। আণুবীক্ষণিক বুদবুদের স্রোত ব্যবহার করে শরীরের ছিদ্র পর্যন্ত পরিষ্কার করে দেবে। ব্যবহারকারীর শরীরে যদি বিন্দুমাত্র চাপ, আতঙ্ক বা চিকিৎসাগত ঝুঁকি টের পায় বা শনাক্ত করে, তবে প্রক্রিয়াটি ধীর হয়ে যাবে বা বন্ধ হয়ে যাবে।
পুরো শরীর ধোয়ার জন্য তৈরি ২.৩ মিটার লম্বা একটি ঘেরা পডের ভিতরে থাকতে হবে ব্যবহারকারীকে। ধোয়ার পর, যন্ত্রটি ব্যবহারকারীকে স্বয়ংক্রিয় ভাবে শুকিয়ে দেবে। কোনও তোয়ালে বা হাত দিয়ে গা মোছার প্রয়োজন পড়বে না। ব্যবহারকারীর হৃৎস্পন্দন এবং গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক লক্ষণগুলি পর্যবেক্ষণ করার জন্য সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে।
২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জাপানের শহর ওসাকা এক্সপোয় অত্যাধুনিক যন্ত্রটিকে প্রকাশ্যে আনা হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে যন্ত্রটি ১০০০ জনকে পরীক্ষা করার জন্য সুযোগ দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যন্ত্রটি ব্যবহারের পরীক্ষা সফল হলে উৎপাদন শুরু হবে বলে জানিয়েছিল উৎপাদনকারী সংস্থা সায়েন্স কোং। ছ’মাস ধরে প্রদর্শনীতে থাকার পর যন্ত্রটির প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ দেখে উৎপাদন শুরু করে দেয় সংস্থা।
ওসাকায় অনুষ্ঠিত ছয় মাসের ওয়ার্ল্ড এক্সপো গত অক্টোবরে শেষ হয়েছে। সেই প্রদর্শনীতে ২ কোটি ৭০ লাখের বেশি লোকসমাগম হয়েছিল। তার মধ্যে অধিকাংশই ভিড় জমিয়েছিলেন অত্যাধুনিক এই যন্ত্রটি দেখার জন্য। যন্ত্রটির যে একটি নমুনা রাখা হয়েছিল তা চাক্ষুষ করতে দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়।
তবে এই মুহূর্তে মাত্র ৫০টি যন্ত্র উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে নির্মাতা সংস্থা। অত্যাধুনিক এই যন্ত্রটি কিনতে খরচ হবে ৬ কোটি ইয়েন (৩ লাখ ৮৫ হাজার ডলার)!
সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৭০ সালের ওসাকা এক্সপোয় একই ধরনের একটি যন্ত্র প্রদর্শিত হয়েছিল। সেই যন্ত্রটি দেখেই মানুষধোয়ার আধুনিক সংস্করণটি তৈরি করেছে সংস্থাটি। সায়েন্সের মুখপাত্র সাচিকো মায়েকুরা সংবাদসংস্যাকে জানিয়েছিলেন, ৭০-এর দশকে যে যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়েছিল তা দেখে সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সেই সময়ে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর।
সাচিকো জানিয়েছেন, এই যন্ত্রটি শুধু শরীরই পরিষ্কার করে না, আত্মাকেও সতেজ করে। এটির বিশেষ অত্যাধুনিক সেন্সর ব্যবহারকারীর হৃৎস্পন্দন ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়াগুলিও পর্যবেক্ষণ করে।
যন্ত্রটির প্রোটোটাইপ দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি রিসর্ট সংস্থা প্রথম আগ্রহ দেখিয়েছিল। তাঁদের বাণিজ্যিক প্রস্তাবের কারণেই যন্ত্রটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন করার পরিকল্পনা নিয়েছে সায়েন্স। যদিও এই মানবধোলাই যন্ত্রটির প্রথম ক্রেতা ওসাকার একটি হোটেল। অতিথিদের জন্য এই বিশেষ পরিষেবার বন্দোবস্ত করবে তারা।
প্রথম প্রজন্মের ‘মিরাই’ ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নয়। বিলাসবহুল হোটেল, স্পা, রিসর্ট এবং থিম পার্কের জন্যই মূলত তৈরি হয়েছে এটি বলে জানিয়েছে সংস্থা। পরবর্তী কালে কম খরচে ব্যক্তিগত গ্রাহকদের জন্য আরও একটি সংস্করণ তৈরি করা হবে।
এ ছাড়াও ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের খুচরো বিক্রেতা ইয়ামাদা ডেনকিও মিরাই হিউম্যান ওয়াশিং মেশিনটি কিনেছে। উদ্দেশ্য, দোকানে ক্রেতাদের ভিড় বাড়ানো। সংস্থা জানিয়েছে, ২৫ ডিসেম্বর থেকে দোকানে সর্বসাধারণের জন্য এই যন্ত্রটির একটি বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। দর্শক চাইলে যন্ত্রটির কার্যকারিতা পরীক্ষাও করতে পারবেন এই প্রদর্শনীতে।