আইসি ৮১৪ অপহরণ। ভারতের ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার অধ্যায়, যা ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে উৎকণ্ঠায় ফেলে দিয়েছিল সারা দেশকে। অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছিল ভারত। আইসি ৮১৪ বিমানটিকে অপহরণ করে রাখা হয়েছিল সাত দিন ধরে। সেই সময় মানুষের হাতে হাতে ফোন ছিল না, সাধারণের ব্যবহারের জন্য প্রায় ছিলই না ইন্টারনেট পরিষেবা। হাইজ্যাকিংয়ের কথা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই খবর পেতে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখছিল গোটা ভারত।
সাত দিন পর জঙ্গিদের হাত থেকে ওই বিমানের যাত্রীরা মুক্তি পেলেও ভারতকে যে মূল্য দিতে হয়েছিল তা ছিল চরম। বিমানযাত্রীদের বদলে তিন ভয়ঙ্কর জঙ্গিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হতে হয় নয়াদিল্লি।
ওই তিন জনের মধ্যে ছিল কুখ্যাত জঙ্গি তথা পাক জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদের প্রধান মৌলানা মাসুদ আজহারও। সেই ঘটনার স্মৃতি এখনও তাড়া করে অনেক ভারতীয়কে।
১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। বিকাল ৪টে নাগাদ ১৭৯ জন যাত্রী এবং ১১ জন বিমানকর্মীকে নিয়ে নেপালের কাঠমান্ডু থেকে নয়াদিল্লির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে আইসি ৮১৪। সাড়ে ৪টের কিছু ক্ষণ পরে সেই বিমান ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করে। যাত্রীদের জলখাবার দেওয়া শুরু করেন বিমানকর্মীরা।
৫টা নাগাদ হঠাৎ যাত্রীদের পাঁচ জন আসন থেকে উঠে রিভলভার এবং গ্রেনেড হাতে নিয়ে চিৎকার শুরু করেন। এক জন সটান ঢুকে পড়েন ককপিটে। ক্যাপ্টেনের আসনের সামনে থেকেই ঘোষণা করেন যে, বিমানটিকে ছিনতাই করা হয়েছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মতে, পাঁচ জঙ্গিকেই পাকিস্তানি নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তারা ছিল— ইব্রাহিম আতহার, আখতার সঈদ, সানি আহমেদ কাজি, জহুর মিস্ত্রি এবং শাকির।
বলা হয়, এই পাঁচ জনের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিল জহুর। জহুরদের হানায় হকচকিয়ে যান আইসি ৮১৪-এর যাত্রীরা। অনেকে আতঙ্কে কান্নাকাটিও শুরু করেন। এর পরেই আইসি ৮১৪-এর ক্যাপ্টেন দেবী শরণ দিল্লি এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-কে বিমান ছিনতাইয়ের কথা জানান।
তড়িঘড়ি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে এই বিষয়ে অবহিত করা হয়। সঙ্কট মোকাবিলায় ডেকে পাঠানো হয় ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ (সিএমজি)’-কে। কাজ শুরু করে এনএসজিও। দিল্লি এটিসিকে ক্যাপ্টেন জানান যে, বিমানটিতে মাত্র এক ঘণ্টার জ্বালানি অবশিষ্ট রয়েছে। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ বিমানটিকে অমৃতসর বিমানবন্দরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। তত ক্ষণে সশস্ত্র জহুরেরা যাত্রীদের খুনের হুমকি দিতে শুরু করেছে।
সেই সময় জঙ্গিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা শুরু হয় কেন্দ্রের তরফে। কেন্দ্রের লক্ষ্য ছিল বিমানটিকে অমৃতসর বিমানবন্দরেই আটকে রাখা। সিএমজির তরফে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়, কোনও ভাবেই যেন বিমানটি উড়তে না পারে। বিমানের চারপাশে পঞ্জাব পুলিশের সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়।
জঙ্গিদের ক্রমাগত হুমকির কারণে জ্বালানিভর্তি একটি ট্যাঙ্কার বিমানটির দিকে পাঠানো হয়। কিন্তু গোলমালের আঁচ পেয়ে জঙ্গিরা তড়িঘড়ি বিমানটিকে ওড়ানোর নির্দেশ দেয়। ছাড়পত্র না পাওয়া সত্ত্বেও প্রাণের ভয়ে বিমানটি অমৃতসর থেকে উড়িয়ে নিয়ে যান ক্যাপ্টেন। রানওয়েতে থাকা জ্বালানির ট্যাঙ্কারে ধাক্কা দিতে দিতে বাঁচে বিমানটি।
অমৃতসর থেকে পাকিস্তানের লাহৌরে এসে অবতরণ করে ওই বিমান। পাকিস্তানি এটিসি প্রাথমিক ভাবে লাহৌর বিমানবন্দরে বিমানটিকে অবতরণের অনুমতি দেয়নি। বিমানবন্দরের সমস্ত আলোও নিবিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু জ্বালানি কম থাকায় বিমানটির আছড়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে রাত ৮টা নাগাদ বিমানটিকে লাহৌরে অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়। লাহৌরে অবতরণের পর বিমানটি যাতে আর কোথাও না যেতে পারে, তা নিয়ে পাকিস্তানকে অনুরোধ করে ভারত। পাকিস্তানি বাহিনী বিমানটিকে ঘিরে ফেলে এবং নারী ও শিশুদের মুক্তির জন্য জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ পাকিস্তানে থাকা ভারতীয় হাই কমিশনার লাহৌর বিমানবন্দরে পৌঁছোন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার আগেই বিমানটিতে জ্বালানি ভরে লাহৌর ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ভারতের কাছে খবর আসে, বিমানের এক যাত্রী জঙ্গিদের হাতে খুন হয়েছেন। কিন্তু জঙ্গিদের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া আসেনি।
লাহৌর থেকে রওনা হওয়ার পর জঙ্গিরা ক্যাপ্টেনকে নির্দেশ দেয় বিমান কাবুলের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু রাতে অবতরণের অসুবিধার কারণে বিমানটি দুবাইয়ের দিকে উড়ে যায়। রাত দেড়টা নাগাদ দুবাইয়ের আল মিনহাদ বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে আইসি ৮১৪। অনেক আলাপ-আলোচনার পরে ২৭ জন যাত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জঙ্গিরা। দুবাইয়ে ২৭ জন যাত্রীর পাশাপাশি রুপিন কাতিয়াল নামে এক যাত্রীর দেহও পাঠানো হয়। আশঙ্কা সত্যি হয় ভারতের। জঙ্গিদের ছুরির আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল রুপিনের।
পরে জানা যায় রুপিনের মুখে, বুকে, পেটে, গলায় একাধিক ছুরির আঘাত বসিয়েছিল জহুরই। নৃশংস ভাবে খুন করেছিল তাঁকে। ২৫ ডিসেম্বর সকালে বিমানটি তালিবান নিয়ন্ত্রিত কন্দহর বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ভারত এবং জহুরদের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয় তালিব সরকার। তবে তালিবানি শাসনকে ভারত স্বীকৃতি না দেওয়ার কারণে ভারতীয় হাই কমিশনের এক কর্তাকে কন্দহরে পাঠানো হয়।
অন্য দিকে, সশস্ত্র তালিব বাহিনী আইসি ৮১৪ বিমানটিকে ঘিরে ফেলে। তাদের দাবি ছিল, যাত্রীদের সুরক্ষার জন্য ওই ব্যবস্থা করেছিল তারা। তবে কেউ কেউ মনে করেন, ভারতের সামরিক বাহিনীকে ঠেকাতে ওই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ২৫ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত এবং বিমান ছিনতাইকারীদের মধ্যে আলোচনা চলে।
এ দিকে জহুরেরা নিজেদের দাবিদাওয়া জানাতে শুরু করে। প্রাথমিক ভাবে জহুরেরা কয়েক জন যাত্রীর বিনিময়ে মাসুদের মুক্তির দাবি জানালেও ভারত তা প্রত্যাখ্যান করে। পরে জঙ্গিরা ৩৬ জন বন্দির মুক্তি, ১৯৯৯ সালে উচ্চ নিরাপত্তাযুক্ত কোট ভালওয়াল জেল থেকে পালানোর চেষ্টার সময় নিহত জঙ্গি সজ্জাদ আফগানির মৃতদেহ ফেরত এবং ২০ কোটি ডলার নগদের দাবি জানায়।
শেষ পর্যন্ত, মাসুদ আজহার, ওমর শেখ এবং মুশতাক জারগার নামে তিন জঙ্গিকে মুক্তির পরিবর্তে যাত্রীদের ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় জহুরেরা। এই নিয়ে সরকারের মধ্যেও ভিন্ন মত উঠে আসে। ১৯৯৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিন বন্দিকে মুক্তি দিতে রাজি হয় ভারত সরকার। তিন বন্দিকে কন্দহরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর ছিনতাইকারীরা আইসি ৮১৪ বিমানের যাত্রীদের মুক্তি দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র তালিবানের হাতে তুলে দেয়। ভারতকে চমকে দিয়ে বিমান ছিনতাইকারী এবং মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের পাকিস্তানে পালানোর অনুমতি দেয় তালিবান।
যাত্রী এবং বিমানকর্মী মিলিয়ে ১৮৯ জনকে নিয়ে ভারতে ফিরে আসে আইসি ৮১৪। গা-ঢাকা দেয় জহুরেরা। জহুর ছিল জঙ্গি সংগঠন জইশ-এ-মহম্মদের সদস্য। সংগঠনের কাছে সে পরিচিত ছিল ‘ডক্টর’ নামে।
আইসি ৮১৪ অপহরণ ছাড়াও বেশ কয়েকটি নাশকতামূলক কাজে প্রত্যক্ষ যোগ ছিল তার। শেষের দিকে ‘জাহিদ আখুন্দ’ নামে করাচির আখতার কলোনিতে থাকছিল সে। ফেঁদে বসেছিল আসবাবপত্রের ব্যবসা।
২০২২ সালের ১ মার্চের সকাল। করাচিতে নিজের দোকানেই বসেছিল জহুর। এমন সময় একটি বাইক এসে দাঁড়ায় তার দোকানের সামনে। বাইক থেকে নেমে আসেন দু’জন। যিনি বাইক চালাচ্ছিলেন, তাঁর পরনে ছিল জিন্স এবং জামা, মাথায় হেলমেট। পিছনের জনের পরনে ছিল কুর্তা-পাজামা। দু’জনের মুখেই ছিল মাস্ক।
দোকানে ঢুকেই জহুরের মাথা লক্ষ্য করে পর পর গুলি চালান অজ্ঞাতপরিচয় দুই বাইক-আরোহী। তার পরেই সেখান থেকে চম্পট দেন। লুটিয়ে পড়ে জহুর। হাসপাতালে যাওয়ার পথে মৃত্যু হয় তার।
দোকানের বাইরের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল মুখ ঢাকা দুই আততায়ীর চেহারা। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমগুলিতে লেখা হয়, করাচিতে জাহিদ আখুন্দ নামে এক ব্যবসায়ী খুন হয়েছেন। কিন্তু সে-ই যে জহুর, তা নিয়ে কোনও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। অন্য দিকে, সেই ‘ব্যবসায়ী’র শেষ যাত্রায় যোগ দিয়েছিল রউফ অসগর। রউফ, জইশ-এ-মহম্মদের অন্যতম প্রধান এবং মাসুদ আজহারের ভাই। এ ছাড়াও জইশের আরও অনেক নেতা জহুরের শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিল।
জহুরের খুনের পর সতর্ক হয়ে যায় পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। কারণ মনে করা হয়, জহুরকে আশ্রয় দিয়েছিল পাক গুপ্তচর সংস্থাই। আইএসআইয়ের দৌলতেই পাকিস্তানে ভুয়ো পরিচয়ে থাকছিল সে।
ধীরে ধীরে জাহিদ আখুন্দের পরিচয় সামনে আসে। সে-ই যে কুখ্যাত জঙ্গি জহুর তা-ও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। জহুরের মৃত্যুতে ভারতের দিকে আঙুল তোলে পাকিস্তান। আমেরিকার একাধিক সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয় যে, জহুর নিধনের নেপথ্যে ছিল ভারত। ভারতীয় গোয়েন্দারাই বহু দিন ধরে নজরদারি চালিয়ে জহুরকে শেষ করে বলেও ওই প্রতিবেদনগুলিতে লেখা হয়।
বেশ কিছু দিন চুপ থাকার পর বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছিল ভারত। নয়াদিল্লির তরফে স্পষ্ট জানানো হয়, ভারতের তরফে এ-রকম কোনও অভিযান পাকিস্তানে চালানো হয়নি। জহুরকে খুন করার দায়ও অস্বীকার করে নয়াদিল্লি। তবে জহুরকে গুলি করা অজ্ঞাতপরিচয় সেই দুই বন্দুকধারী কারা, তা কখনও জানা যায়নি।