বিতর্কের নাম ‘সঞ্চার সাথী’। বিগত কয়েক দিন ধরে অ্যাপটিকে কেন্দ্র করে বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছে দেশ জুড়ে। অ্যাপটি নিয়ে একাধিক যুক্তি দিয়েছেন বিরোধীরা। পাল্টা যুক্তি দিয়েছে কেন্দ্রও।
তবে বিতর্ক মাথাচাড়া দিতেই ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ বাধ্যতামূলক ভাবে স্মার্টফোনে প্রি-ইনস্টল করার বিষয়ে সুর নরম করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার। বুধবার এ সংক্রান্ত পূর্ববর্তী নির্দেশ প্রত্যাহার করার কথাও ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।
কিন্তু কী এই ‘সঞ্চার সাথী’? কী নিয়েই বা এত বিতর্ক? ২০২৩ সালে আইএমইআই ট্যাম্পারিং, ফোন চুরি এবং মোবাইল সংক্রান্ত জালিয়াতি রোধ করার জন্য একটি ভোক্তা-সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে ‘সঞ্চার সাথী’ চালু করেছিল কেন্দ্র।
পরিষেবাটি ব্যবহারকারীদের তাঁদের ফোন আসল কি না তা যাচাই করতে, ফোন হারানোর অভিযোগ জানাতে, ফোনের আইএমইআই নম্বর ব্লক করতে এবং অননুমোদিত সিম শনাক্ত করতে সহায়তা করবে বলেও জানানো হয়েছিল সরকারের তরফে।
এর পর গত ২৮ নভেম্বর ভারতে বিক্রি হওয়া সব ফোনে ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ প্রি-ইনস্টল করা থাকতে হবে বলে কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রক (ডট)-এর তরফে ফোন প্রস্তুতকারী সব সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
যে স্মার্টফোনগুলি ইতিমধ্যে বাজারে এসে গিয়েছে, সেগুলিতেও সফ্টঅয়্যার আপডেটের মাধ্যমে ওই সরকারি অ্যাপটি প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার (ইনস্টল করার) কথা বলেছিল কেন্দ্র। অ্যাপ্ল, স্যামসাং, শাওমি, ভিভো এবং অন্য নির্মাতাদের ৯০ দিনের মধ্যে প্রি-ইনস্টলেশন প্রক্রিয়াটি শেষ করতে এবং ১২০ দিনের মধ্যে প্রি-ইনস্টল নিয়ে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল।
তার পর থেকেই গ্রাহকদের মোবাইলে ‘সঞ্চার সাথী’ ডাউনলোডের লিঙ্ক পৌঁছোচ্ছিল প্রতিনিয়ত। কিন্তু কী কাজ করে অ্যাপটি? কেন্দ্রের দাবি, অসাধু ব্যক্তিদের নাগাল থেকে গ্রাহকদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত এই অ্যাপটি চালু করা হয়েছে এবং গ্রাহকদের ফোনে প্রি-ইনস্টল করার কথা বলা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘‘নাগরিকদের নকল হ্যান্ডসেট কেনা থেকে রক্ষা করার জন্য, সহজে টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত অপব্যবহারের অভিযোগ জানাতে এবং ‘সঞ্চার সাথী’ উদ্যোগের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য ডট এই নির্দেশিকা জারি করেছে।’’
সরকার ‘সঞ্চার সাথী’কে এমন একটি হাতিয়ার হিসাবে দাবি করেছে, যা ফোন চুরি আটকাতে, ফোনের অপব্যবহার রোধ করতে এবং পুলিশকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করবে। কেন্দ্রের দাবি, অ্যাপটির সাহায্যে সকল টেলিকম নেটওয়ার্কে হারিয়ে যাওয়া বা চুরি যাওয়া ফোন ‘ব্লক’ করা সুবিধাজনক হবে। সম্ভব হবে আইএমইআই নম্বরের সত্যতা যাচাইও।
পাশাপাশি, কোনও ব্যবহারকারীর নামে অবৈধ ভাবে কোনও সিম তোলা হয়েছে কি না এবং সেই সিম কোনও প্রতারণামূলক ঘটনা বা কেলেঙ্কারিতে ব্যবহার করা হয়েছে কি না, তা-ও যাচাই করবে অ্যাপটি। সিমগুলি শনাক্ত করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাও সম্ভব হবে।
ভারতের সমস্ত অনুমোদিত মোবাইল ফোনের বিবরণ সংরক্ষণ করে সেন্ট্রাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (সিইআইআর)। ‘সঞ্চার সাথী’ ইনস্টল করার পর অ্যাপটি ফোনের আইএমইআই নম্বরকে সিইআইআর-এর সঙ্গে সংযুক্ত করে।
ফলে ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপের মাধ্যমে সিইআইআর ডেটাবেস ব্যবহার করে চুরি যাওয়া ফোন শনাক্ত করা সম্ভব বলেও কেন্দ্রের দাবি। যদি কোনও ব্যবহারকারী তাঁদের ফোন হারিয়ে গিয়েছে বা চুরি গিয়েছে বলে রিপোর্ট করেন, তা হলে সিইআইআর ওই ফোনের আইএমইআই নম্বর ব্লক করে দেবে। সেই ফোনে নতুন সিম প্রবেশ করালেও ফোনটি কাজ করবে না।
আইফোনে সেই অ্যাপ ইনস্টল করলে ব্যবহারকারীদের ক্যামেরা, ছবি এবং ফাইলগুলিতে ‘অ্যাক্সেস’ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হবে। তবে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কাজের জন্য।
অ্যান্ড্রয়েডে অনুমতিগুলির মধ্যে রয়েছে কল লগ অ্যাক্সেস, রেজিস্ট্রেশনের সময় মেসেজ পাঠানোর ক্ষমতা, লিঙ্কযুক্ত মোবাইল নম্বর শনাক্ত করার জন্য কল করা এবং ক্যামেরা ও ছবির অ্যাক্সেস।
সেই ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপই বাধ্যতামূলক ভাবে স্মার্টফোনে প্রি-ইনস্টল করার নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্র। মোদী সরকারের ওই নির্দেশের পরেই হইচই পড়ে। শুরু হয় বিতর্ক। বিষয়টি নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। ওই অ্যাপের মাধ্যমে নাগরিকদের ‘ব্যক্তিগত পরিসরে’ নজরদারি চালানো হবে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী মঙ্গলবার ইজ়রায়েলি ‘স্পাইঅয়্যার’ পেগাসাসের সঙ্গে তুলনা টেনে ‘সঞ্চার সাথী’কে ‘স্নুপিং অ্যাপ’ বলে চিহ্নিত করেন। তাঁর অভিযোগ, এই অ্যাপের মাধ্যমে ফোন ব্যবহার করা গ্রাহকের গোপনীয়তার সুরক্ষা লঙ্ঘিত হবে।
শুধু বিরোধী দল নয়, শিল্প বিশেষজ্ঞদের অনেকের অভিযোগ, এই অ্যাপের মাধ্যমে আদতে সরকারি নজরদারি বাড়তে পারে গ্রাহকদের উপর। অ্যাপটিকে বাধ্যতামূলক করা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
মোবাইল প্রস্তুতকারী সংস্থা অ্যাপ্ল এই নির্দেশের গোপনীয়তা এবং সুরক্ষার প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইতিমধ্যেই। বর্তমানে যে অবস্থায় নির্দেশটি রয়েছে, অ্যাপ্ল সেই অবস্থায় নির্দেশটি মানতে রাজি নয় বলেও সংবাদসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বৈঠক করতে চলেছে অ্যাপ্ল এবং স্যামসাং। সেখানে নরেন্দ্র মোদী সরকারের নির্দেশিকার কিছু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে সরকারি সূত্রের খবর।
যদিও কেন্দ্র দাবি করে, এত দিন সাধারণত দৈনিক ৬০ হাজারের মতো ডাউনলোড হচ্ছিল এই অ্যাপ। বিতর্কের আবহে মঙ্গলবার হঠাৎই তা ১০ গুণ বেড়ে প্রায় ৬ লক্ষে পৌঁছেছে।
বিতর্কের আবহে কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডে মঙ্গলবার জানান, ফোন ব্যবহারকারী গ্রাহকেরা যদি ওই অ্যাপ ব্যবহার না করতে চান, তা হলে তাঁরা তা মুছে ফেলতে (ডিলিট করতে) পারবেন। তিনি বলেন, ‘‘এটি অ্যাক্টিভেট করবেন না। যদি আপনার ফোনে এটা রাখতে চান, রাখুন। যদি এটা মুছে দিতে চান, তা-ই করুন।’’ ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ নিয়ে বিরোধীদের তোলা নজরদারির অভিযোগ খারিজ করে জ্যোতিরাদিত্য জানান, এটি পুরোপুরি গ্রাহক সুরক্ষার বিষয়। বাধ্যতামূলক কিছু নেই।
এর পর বুধবার ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ বাধ্যতামূলক ভাবে স্মার্টফোনে প্রি-ইনস্টল করার পূর্ববর্তী নির্দেশ প্রত্যাহার করার কথা ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার। বাজারে চালু থাকা স্মার্টফোনের গ্রাহকদের ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ ডাউনলোড করার ‘পরামর্শ’ দিয়ে সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা দেওয়া ছাড়া অ্যাপটির অন্য কোনও কাজ নেই। সরকার স্পষ্ট ভাবে জানাচ্ছে, তাঁরা (গ্রাহকেরা) যখন খুশি অ্যাপটি সরিয়ে ফেলতে পারেন।’’
এখনও পর্যন্ত ১ কোটি ৪০ লক্ষ ব্যবহারকারী এই অ্যাপটি ডাউনলোড করেছেন এবং প্রতি দিন ২০০০টি জালিয়াতির ঘটনার তথ্য প্রদান করছেন বলেও ওই বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে। এটি ৩ কোটিরও বেশি জাল বা প্রতারণামূলক মোবাইল সংযোগ শনাক্ত এবং বন্ধ করতে সাহায্য করেছে বলেও দাবি কেন্দ্রের।