বন্ধু ভেবে ‘বিষধর সাপ’কে গলায় জড়িয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। দুধ-কলা খাইয়ে দিব্যি বড় করছেন তাকে। কিন্তু, স্বভাব যাবে কোথায়! ওই ‘কালসর্প’ই এখন মোক্ষম সুযোগ খুঁজছে মস্কোর কপালে ছোবল বসানোর। ক্রেমলিনের গোয়েন্দা বাহিনীর এ-হেন রিপোর্ট ফাঁস হতেই ‘বাদামি ভালুকের দেশে’ পড়ে গিয়েছে শোরগোল। এর জেরে রুশ বিদেশনীতিতে বদল আসতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের গলায় ফাঁস হয়ে আটকে থাকা ওই ‘বিষধর সাপ’টি হল চিন। মস্কোর গোয়েন্দাদের দাবি, গোপনে মস্কোর চরম ক্ষতি করার ফন্দি আঁটছে বেজিং। আর তাই ক্রেমলিনে পাঠানো ষড়যন্ত্র ফাঁসের রিপোর্টে ড্রাগনকে ‘পয়লা নম্বর শত্রু’ বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা। পাশাপাশি, চিনের সঙ্গে ‘অটুট বন্ধন’-এর ঘোষণা করা রুশ প্রেসিডেন্টকে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে সতর্কও করা হয়েছে।
রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব যে গোয়েন্দা সংস্থার হাতে রয়েছে তার পোশাকি নাম ‘ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস’ বা এফএসবি। রাজধানী মস্কোয় সোভিয়েত আমলের লুবিয়াঙ্কা বিল্ডিংয়ে রয়েছে এর সদর দফতর। সম্প্রতি সেখানকার গোয়েন্দাদের আট পাতার একটি রিপোর্ট ফাঁস করে জনপ্রিয় মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’। রিপোর্টটির ছত্রে ছত্রে রয়েছে চালবাজ চিনের কীর্তিকলাপের কথা।
‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এফএসবির পদস্থ কর্তারা জানিয়েছেন জটিল সামরিক প্রযুক্তি চুরি করতে রুশ গুপ্তচরদের লাগাতার লোভ দেখিয়ে দলে টানছে চিন। মস্কোর প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদেরও একই ভাবে কব্জা করার চেষ্টা চালাচ্ছে বেজিং। পাশাপাশি, গত তিন বছর ধরে ইউক্রেনে চলা ক্রেমলিনের সামরিক অভিযানের উপরেও কড়া নজর রেখেছে ড্রাগন। সেখান থেকে পশ্চিম হাতিয়ার এবং যুদ্ধকৌশল শেখার চেষ্টা করছে তারা।
এফএসবির গোয়েন্দাদের অনুমান, বেজিঙের এ-হেন পদক্ষেপের নেপথ্যে সুনির্দিষ্ট কতগুলি কারণ রয়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, রাশিয়ার পূর্ব প্রান্তের জমি কব্জা করার ছক কষছে ড্রাগন। সেই লক্ষ্যে সুমেরু সাগরেও গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করেছে চিনের ‘মিনিস্ট্রি অফ স্টেট সিকিউরিটি’ বা এমএসএস। সেখানকার খনি সংস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সংস্থাগুলির আ়ড়ালে এই কাজ দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ ফাঁস হওয়া এই গোয়েন্দা রিপোর্টে কোনও সুনির্দিষ্ট তারিখের উল্লেখ নেই। তবে মার্কিন সংবাদমাধ্যমটির দাবি, ২০২৩ সালের শেষের দিকে বা ২০২৪ সালের গোড়ায় সংশ্লিষ্ট রিপোর্টটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। এটিকে প্রকাশ্যে আনার ক্ষেত্রে ‘এরেস লিকস’ নামের সাইবার-অপরাধ গোষ্ঠীর হাত রয়েছে বলে স্পষ্ট করেছে ওই মার্কিন সংবাদমাধ্যম।
অতীতে বহু বার মস্কোর সঙ্গে সীমান্ত বিবাদে জড়িয়েছে চিন। রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তক-সহ একাধিক এলাকার মান্দারিন ভাষায় নামকরণ এবং সেগুলিকে ড্রাগনভূমির অংশ বলে দাবি করেছে ড্রাগন। যদিও ‘সুপার পাওয়ার’ ক্রেমলিনকে কখনওই এই নিয়ে ঘাঁটানোর সাহস দেখায়নি বেজিং। ফাঁস হওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, রুশ গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে এ বার মোক্ষম সময়ে তাদের পিঠে ছুরি বসানোর ছক কষছেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কথায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএর পক্ষে মোটেই কঠিন নয়। কারণ, গত তিন বছর ধরে ইউক্রেন যুদ্ধ চলায় ড্রাগনের দিকের চার হাজার মাইল লম্বা মস্কোর সীমান্ত একরকম অরক্ষিতই রয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে অধিকাংশ বাহিনীকে পশ্চিম রণাঙ্গনে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন পুতিনের অত্যন্ত ভরসার সেনা অফিসারেরা।
এই পরিস্থিতিতে হুড়মুড়িয়ে পিএলএ ফৌজ ভ্লাদিভস্তক-সহ পূর্ব রাশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন এলাকাগুলিতে ঢুকে পড়লে তা পুনর্দখল করা বেশ কঠিন হবে। সে ক্ষেত্রে কোনও রকম প্রতিরোধ ছাড়াই পূর্ব ইউরোপের দেশটির জমি কব্জা করে ফেলবে বেজিং। মস্কোর গোয়েন্দাদের দাবি, এর জন্য ক্রেমলিন-ঘনিষ্ঠ সরকারি আধিকারিক, সংবাদমাধ্যমের মালিক থেকে শুরু করে সেনাকর্তা বা ধনকুবেরদের নানা ভাবে নিজেদের জালে জড়াতে ফাঁদ পাতা শুরু করেছে চিনা গুপ্তচরেরা।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া। এর ঠিক তিন দিন আগে বিশেষ একটি অভিযানে নামে মস্কোর গোয়েন্দা বাহিনী। ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, এফএসবি এর নামকরণ করে ‘এনটেনটে-৪’। সেখানে চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলা রুশ নাগরিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, বেজিঙের গুপ্তচরদের হাতে পড়ার থেকে তাঁদের আগাম সতর্ক করা।
পাশাপাশি, চিনা ম্যাসেজিং অ্যাপ ‘উইচ্যাট’-এর থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন রুশ গোয়েন্দারা। তাঁদের দাবি, সংশ্লিষ্ট অ্যাপটিকে ব্যবহার করে গোপন সামরিক তথ্য হ্যাকিংয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে বেজিং। উচ্চশিক্ষার জন্য ফি বছর মস্কো থেকে ড্রাগন ভূমিতে যান ২০ হাজার পড়ুয়া। গুপ্তচরবৃত্তির জন্য তাঁদেরও কাজ লাগানো হচ্ছে বলে ফাঁস হওয়া রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে।
রুশ গোয়েন্দাদের দাবি, চিনে পাঠরত পড়ুয়াদের একাংশকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে বিয়ে করছেন এমএসএসের মহিলা গুপ্তচরেরা। ফলে মস্কো চলে আসার ক্ষেত্রে আর কোনও বাধাই থাকছে না তাঁদের। রাজধানীতে পৌঁছে দ্বিতীয় পর্যায়ে তাঁরা কোমর বেঁধে লেগে পড়ছেন তথ্য প্রচারের কাজে। এ ব্যাপারে সতর্ক ভাবে পা ফেলার প্রয়োজন রয়েছে বলে স্পষ্ট করেছে এফএসবি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন মোটেই কাঁচা খেলোয়াড় নয়। চিনের চালবাজি ভালই বুঝতে পারেন তিনি। এখন কিছুটা ঠেকায় পড়েই ‘সাপের ছুঁচো গেলার’ মতো করে ড্রাগনের লম্ফঝম্ফ সহ্য করতে হচ্ছে তাঁকে। কারণ, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার উপরে বিপুল নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া।
এই নিষেধাজ্ঞার জেরে রুশ অর্থনীতিকে বাঁচাতে চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কয়েক গুণ বৃদ্ধি করেছেন পুতিন। মস্কোর থেকে বিপুল পরিমাণে খনিজ তেল কিনছে বেজিং। অন্য দিকে ড্রাগনভূমি থেকে ক্রেমলিনকে আমদানি করতে হচ্ছে কম্পিউটার চিপস, বিভিন্ন ধরনের সফটঅয়্যার এবং সামরিক সরঞ্জাম। অত্যাধুনিক হাতিয়ার নির্মাণে সেগুলিকে যথেচ্ছ ব্যবহারও করছে ‘বাদামি ভালুকের দেশ’।
বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন ‘কার্নেগে রাশিয়া ইউরেশিয়া’ গবেষণা সংস্থার ডিরেক্টর আলেকজান্ডার গাবুয়েভ। তাঁর কথায়, ‘‘মুখে জিনপিঙের সঙ্গে সীমাহীন বন্ধুত্বের কথা বললেও এটা যে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ তা ভালই জানেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। মস্কোর বিদেশ মন্ত্রকের অনেকেরই দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু, এখন নিরুপায় হয়ে কাদা রাস্তায় হাঁটতে হচ্ছে তাঁদের।’’
চলতি বছরের ১ জুন ‘আত্মঘাতী’ ড্রোন হামলা চালিয়ে রাশিয়ার পাঁচটি বিমানঘাঁটিকে একরকম তছনছ করে দেয় ইউক্রেন। অতর্কিত ওই আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় মস্কোর ৪০টির বেশি লড়াকু জেট। এর মধ্যে ছিল বেশ কয়েকটি কৌশলগত বোমারু বিমান। কী ভাবে এবং কাদের সাহায্যে সংশ্লিষ্ট বায়ুসেনা ঘাঁটি পর্যন্ত ড্রোন নিয়ে যেতে সক্ষম হল ইউক্রেন? বর্তমানে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন ক্রেমলিনের গোয়েন্দারা।
বিশ্লেষকদের একাংশ এর নেপথ্যে চিনের হাত থাকার সম্ভাবনাকে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তাঁদের যুক্তি, সামরিক দিক থেকে ক্ষতি হলে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে রাশিয়া। তখন পূর্ব দিকে ভ্লাদিভস্তক-সহ একাধিক এলাকায় আগ্রাসন অনেক বেশি সহজ হবে পিএলএর পক্ষে। সেই কারণে অত্যন্ত গোপনে ইউক্রেনকে তথ্য পাচার করে থাকতে পারে বেজিঙের গুপ্তচরেরা।
‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে’ ফাঁস হওয়া সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা রিপোর্ট নিয়ে অবশ্য মুখ কুলুপ এঁটে রয়েছে রাশিয়া। চিনের তরফেও এই নিয়ে কোনও রকমের প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তবে দু’জনের ‘সীমাহীন বন্ধুত্বে’ অবিশ্বাসের হাওয়া যে ঢুকে পড়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, এই ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা রিপোর্টকে প্রেসিডেন্ট পুতিন গুরুত্ব দিলে আখের লাভ হবে ভারতের। অবিশ্বাসের কারণেই চিনকে অত্যাধুনিক কোনও হাতিয়ারের প্রযুক্তি সরবরাহ করে না রাশিয়া। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রেও দু’তরফে প্রচুর মতপার্থক্য রয়েছে। সেখানে নয়াদিল্লি সব সময়ের জন্যই ক্রেমলিনের ভরসার ‘বন্ধু’। ফলে এই দুই ক্ষেত্রে আগামী দিনে আরও কাছাকাছি আসার সুযোগ পাবে ভারত ও রাশিয়া।