কাঠমান্ডু জ্বলছে। ছাত্র-যুবদের বিক্ষোভে সোমবারের পর মঙ্গলবারও উত্তাল নেপাল। সম্প্রতি সমাজমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল নেপাল সরকার। তা ঘিরেই বিতর্কের সূত্রপাত।
সমাজমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে সোমবার পথে নামেন দেশের ছাত্র-যুবরা। তাঁদের বিক্ষোভে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল রাজধানী কাঠমান্ডু। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ গুলি চালায়। তাতে মৃত্যু হয় অন্তত ১৯ জন বিক্ষোভকারীর।
এর পর বিক্ষোভের ঝাঁজ আরও বাড়ে। চাপে পড়ে রাতেই নেপাল সরকার সমাজমাধ্যমের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে বিবৃতি জারি করেছিল। কিন্তু তাতে চিঁড়ে ভেজেনি।
খাতায়কলমে এই আন্দোলনের নেতারা নিজেদের ‘জেন জ়ি’ অর্থাৎ, তরুণ প্রজন্ম বলে পরিচয় দিচ্ছেন। বিভিন্ন পোস্টারে দেখা যাচ্ছে, কেবল ফেসবুকের উপর বিধিনিষেধ আরোপের কারণেই নয়, ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য, সরকারি স্তরে দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণের কারণেও ক্ষুব্ধ নেপালের ছাত্র-যুবদের একাংশ।
সমাজমাধ্যমের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পরেও নেপালে পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত হয়নি। বরং নতুন উদ্যমে পথে নামেন ছাত্র-যুবরা। মঙ্গলবার সকাল থেকে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির পদত্যাগের দাবিতেও বিক্ষোভ শুরু হয়।
ওলির নাম করে মঙ্গলবারও বিভিন্ন মিছিল থেকে স্লোগান ওঠে ‘কেপি চোর, গদি ছোড়’। দিকে দিকে আগুন জ্বলে ওঠে। ক্রমেই তেজ বাড়তে থাকে ছাত্র-যুব আন্দোলনের। অহিংস আন্দোলন হিসাবে শুরু হয়ে আন্দোলন ক্রমশ সহিংস রূপ নেয়।
মঙ্গলবার কাঠমান্ডু এবং সংলগ্ন ললিতপুর ও ভক্তপুর জেলার বেশ কিছু এলাকায় কার্ফু জারি করা হয়। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টা (স্থানীয় সময়) থেকে কার্ফু চলছে কাঠমান্ডুর বিভিন্ন প্রান্তে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য এই কার্ফু চলবে বলে জানায় কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন।
একই নির্দেশিকা জারি করে ভক্তপুর জেলা প্রশাসনও। ললিতপুরের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে সকাল ৯টা (স্থানীয় সময়) থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কার্ফু জারি রাখার সিদ্ধান্ত নেয় জেলা প্রশাসন।
তবে কার্ফু উপেক্ষা করেই মঙ্গলবার পথে নামেন নেপালের ছাত্র-যুবরা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট’ অনুসারে, মঙ্গলবার সকালে কাঠমান্ডুর নিউ বানেশ্বর এবং অন্য এলাকায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন তরুণদল।
কাঠমান্ডু জেলার কালেঙ্কি এবং বানেশ্বরে, ললিতপুর জেলার চাঁপাগাঁও-সহ বেশ কিছু এলাকায় প্রতিবাদ চলে। কালেঙ্কিতে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ হয়। কয়েক জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতারও করে পুলিশ।
এর মধ্যেই মঙ্গলবার সকাল থেকে নেপালের একাধিক নেতা-মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিতে শুরু করেন বিক্ষোভকারীরা। সে দেশের ললিতপুর জেলায় যোগাযোগমন্ত্রী পৃথ্বী সুব্বা গুরুংয়ের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সমাজমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সরকারি নির্দেশিকা জারি করেছিলেন গুরুংই।
বিক্ষোভের মুখে সোমবার রাতেই ইস্তফা দিয়েছেন নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক। মঙ্গলবার সকালে তাঁর বাসভবনেও আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা।
এর পর কাঠমান্ডুর সনেপায় নেপালি কংগ্রেসের সদর কার্যালয়েও আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। অগ্নিসংযোগ করা হয় নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পৌডেলের বাসভবনে।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা সিপিএন নেতা প্রচণ্ডের বাসভবনেও আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। অগ্নিসংযোগ করা হয় নেপালি কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট শের বাহাদুর দেউবার বাড়িতেও। এ ছাড়া ইউএমএল নেতা মহেশ বাসনেত, নেপালি কংগ্রেসের নেতা গগন থাপার বাড়িতেও আগুন ধরানো হয়।
মঙ্গলবার নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি সদর দফতরেও ঢুকে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। কমিউনিস্ট পার্টির সদর দফতরে প্রবেশ করে তাণ্ডব চালান তাঁরা। ভবন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় রাজনৈতিক দলের পতাকা।
বিক্ষোভের মুখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ওলি। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। চাপের মুখে নতিস্বীকার করতে হয়েছে ওলিকে। দেশজোড়া বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছেন তিনি। মেনে নিয়েছেন গণবিদ্রোহের দাবি। সূত্রের খবর, নেপালের সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁকে ইস্তফা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এর পর সেনাবাহিনীর কাছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান ওলি।
তবে ওলির পদত্যাগের পরেও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। নেপালে ওলির ব্যক্তিগত বাসভবনে ইতিমধ্যেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে উত্তেজিত জনতা। সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়া টুডে’ সূত্রে খবর, মঙ্গলবার দুপুরে নেপালের সুপ্রিম কোর্টেও উত্তেজিত জনতা ভাঙচুর চালিয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে নেপালের অ্যাটর্নি জেনারেলের দফতরেও।
বিক্ষোভকারীরা আগুন ধরিয়ে দেন নেপালের পার্লামেন্টেও। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে, গোটা পার্লামেন্ট ভবন ঢেকে যায় কালো ধোঁয়ায়। ফলে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সে দেশের পরিস্থিতি।
নেপালের সঙ্গে ভারতের প্রায় ১,৭৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ভারতের উত্তরাখণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গ-সহ পাঁচ রাজ্য নেপালের সীমান্তবর্তী। নেপালের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পাঁচ রাজ্যেই সীমান্তে তৎপরতা বেড়েছে। বিহারের নেপাল সীমান্তবর্তী সাতটি জেলায় নজরদারি বাড়িয়েছে সশস্ত্র সীমা বল (এসএসবি) এবং বিহার পুলিশ। পশ্চিম চম্পারণ, সীতামারি, মধুবনী, আরারিয়া, সুপৌল, পূর্ব চম্পারণ এবং কিষাণগঞ্জে টহলদারি বেড়েছে।
পাশাপাশি, আশপাশের এলাকায় সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তল্লাশি করা হচ্ছে। কোনও ভাবেই যাতে নেপালের আন্দোলনের আঁচ এ দেশে না পড়ে, সে জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যের তরফে একাধিক ব্যবস্থাপনা নেওয়া হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে জারি হয়েছে ‘হাই অ্যালার্ট’।