পরনে প্যাস্টেলরঙা এলি সাব গাউন। তাতে নেটের কাজ করা ফুল, লতাপাতার অলঙ্করণ। স্ট্র্যাপলেস গাউনে আত্মপ্রকাশ করতেই ফ্যাশন দুনিয়ার নজর কাড়লেন তন্বী। গোটা দুনিয়ার ফ্যাশনের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত লে ব্যাল নামের ‘হাইপ্রোফাইল’ ফ্যাশন উইকের প্রচারের সমস্ত আলো গিয়ে পড়েছে এই তরুণীর উপর।
বিশ্বের রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক এবং বিনোদন জগতের অভিজাত ও প্রভাবশালী পরিবারের পটভূমিকা থেকে আসা তরুণীদের নিয়ে বার্ষিক অনুষ্ঠানটি প্রতি বছরই অনুষ্ঠিত হয়। এই বার্ষিক ফ্যাশন ইভেন্টটির নাম লে ব্যাল দেস ডেবিউট্যান্টেস, যা লে ব্যাল নামেও পরিচিত। ১৯৫৮ সাল থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই লে ব্যাল। সাবেক নাম ক্রিলন বল। আঠারো বছর পেরোলেই এই ফ্যাশন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া যায়।
১৯৫৮ সালে ভার্সাই প্রাসাদে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৫০ জন আমেরিকান তরুণী এবং ২০০ জন ফরাসি ললনা ক্রিশ্চিয়ান ডিওর, ল্যানভিন এবং অন্যান্য কিংবদন্তি ডিজ়াইনারদের পোশাকে সজ্জিত হয়ে উপস্থিত ছিলেন । এর পর থেকে শুধুমাত্র আমন্ত্রিতেরাই অংশ নেন এই অনুষ্ঠানটিতে। অতিথি তালিকা ২০ থেকে ২৫ জনে নেমে এসেছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেই মঞ্চে এ বছর চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে ভারতীয় শিল্পপতি ও ফ্যাশন ডিজ়াইনারের কন্যা। এলা ওয়াদিয়া। ২০২৫ সালের লে ব্যালের মঞ্চে প্রথম বার হাঁটলেন এলা। এলার বাবা-মা ভারতীয় হলেও পড়শি দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র রয়েছে। তিনি পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্নার প্রপ্রৌত্রী।
এই অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আলোচিত অংশগ্রহণকারীদের একজন হলেন এলা। কারণ ভারতের অন্যতম খ্যাতনামী শিল্প পরিবারের সন্তান তিনি। সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক পটভূমি। এলা হলেন জিন্নার পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের উত্তরসূরি। এলার বাবা ভারতের খ্যাতনামী শিল্পপতি। মা ফ্যাশন দুনিয়ার পরিচিত নাম।
‘বম্বে ডাইং’, ‘গো ফার্স্ট’, ‘বম্বে রিয়্যালটি’র কর্ণধার জাহাঙ্গির ওয়াদিয়া এবং ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘সি ফেম’-এর মালিক সেলিনা ওয়াদিয়ার মেয়ে এলা। এলার এই চোখধাঁধানো বংশপরিচয়ই তাঁকে কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে তুলে এনেছে।
জিন্নাভাই পুঞ্জা এবং মিঠিবাইয়ের আট সন্তান ছিল, যাদের মধ্যে মহম্মদ আলি জিন্না ছিলেন সবার বড়। জিন্নার একমাত্র কন্যা ছিলেন দিনা জিন্না। জিন্নার দ্বিতীয় স্ত্রী রত্তনবাঈয়ের সন্তান দিনা। রত্তনবাঈয়ের মা দিনা পেতিতের নাম অনুসারে জন্মের বহু দিন পর জিন্না-কন্যার নাম রাখা হয়। পিসি ফতিমার কাছে তিনি বড় হয়েছিলেন। কারণ ৯ বছর বয়সেই মাকে হারান দিনা।
মা রত্তনবাঈয়ের মতোই পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচন করেছিলেন দিনাও। ১৯৩৮ সালে তিনি বিয়ে করেন পার্সি তরুণ নেভিল ওয়াদিয়াকে। ভারতের প্রাচীন পার্সি পরিবারগুলির মধ্যে ওয়াদিয়ারা ছিলেন অন্যতম। লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ থেকে পড়াশোনা করা উচ্চশিক্ষিত নেভিল ছিলেন পারিবারিক ব্যবসার উত্তরাধিকারী।
এই বিয়েতে অমত ছিল জিন্নার। মেয়ের সঙ্গে মতবিরোধ তৈরি হয় বাবার। দিনার মৃত্যুর পরে তাঁর ডায়েরির পাতা থেকে জানা গিয়েছে, বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শেষ দিকে সহজ হয়ে গিয়েছিল অনেকটাই। দু’জনের শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৪৬ সালে, সাবেক বম্বে শহরে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে জিন্নাও বরাবরের জন্য এ দেশ ছেড়ে চলে যান পাকিস্তানে।
নেভিল ও দিনার এই বিয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ছেলে নুসলি এবং মেয়ে ডায়ানার জন্মের পরে ১৯৪৩ সালে বিচ্ছেদ হয়ে যায় নেভিল এবং দিনার। সম্প্রতি বছর তিনেক আগে, ২০১৭ সালে ৯৮ বছর বয়সে দিনা মারা যান নিউ ইয়র্কে। তাঁর প্রাক্তন স্বামী নেভিল প্রয়াত হন বেশ কিছু বছর আগে, ১৯৯৬ সালে, মুম্বইয়ে।
দিনা-পুত্র নুসলিরই ছেলে হলেন এলার বাবা জাহাঙ্গির। ওয়াদিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন নুসলি। সেই সূত্রে ওয়াদিয়া গ্রুপের উত্তরাধিকারী জাহাঙ্গির। ৫১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে ওয়াদিয়া গ্রুপের হাতে। নুসলির আর এক পুত্র হলেন নেস ওয়াদিয়া। নেসের সঙ্গে প্রীতি জ়িন্টার প্রেম একসময় ছিল আলোচনার কেন্দ্রে।
সেই সূত্রে জাহাঙ্গির ও নেস হলেন মহম্মদ আলি জিন্নার একমাত্র মেয়ে দিনার নাতি। আর এলা হলেন জিন্নার মেয়ে দিনার নাতির কন্যা। এলার একটি সহোদর রয়েছে নাম জেহ। ২০০৩ সালে সেলিনার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন জাহাঙ্গির। সেলিনা আদতে অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা। লন্ডনে তাঁদের প্রথম দেখা ও আলাপ।
বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সুন্দরীদের চাঁদের হাট বসে প্যারিসের এই জমকালো ফ্যাশন ইভেন্টে। এই বল অনুষ্ঠানে রাজপরিবার ও হলিউড তারকাদের ছেলেমেয়েরা অংশ নিয়ে থাকেন। চলতি বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়া লে ব্যালেতে খ্যাতনামী পোশাকনির্মাতা এলি সাবের স্ট্র্যাপলেস গাউনে সজ্জিত হয়ে মঞ্চে অবতীর্ণ হন এলা।
অভিষেকের জন্য যে কাঁধখোলা গাউনটি বেছে নিয়েছিলেন এলা, তা আধুনিকতার সঙ্গে মার্জিত রুচির নিখুঁত মেলবন্ধন ঘটেছিল। একঝাঁক উঠতি তারকার মাঝে সেই এলা যেন আলাদা করে চেনালেন তাঁর ফ্যাশনবোধ। মাটিতে লুটিয়ে থাকা ঝুলের গাউনের সঙ্গে মানানসই করে এলা পরেছিলেন ভরাট একটি নেকলেস। খোলা চুলে মোহময়ী হয়ে বলের মঞ্চে হেঁটেছিলেন এলা।
এলা ছাড়াও ২৯ নভেম্বর বিভিন্ন দেশের রাজপরিবারের কন্যা, ধনকুবের ও শিল্পপতিদের কন্যারাও জড়ো হয়েছিলেন হোটেল শাংরি-লাতে। উইনস্টন চার্চিলের উত্তরসূরি লেডি আরমিন্তা স্পেন্সার-চার্চিল, ফ্যাশন ডিজ়াইনার ক্যারোলিনা হেরেরার নাতনি ক্যারোলিনা ল্যান্সিং, স্পেনের রাজকুমারী ইউলালিয়া ডি অরলিয়ানস-বুরবোঁ–সহ আরও অনেকে।