৯০-এর দশকে ব্রিটিশ সরকার টলমল করে উঠেছিল এক ভারতীয় ললনার জন্য। মাত্র ২৭ বছর বয়সি সুন্দরীকে ঘিরে মুচমুচে রসালো যৌন কেলেঙ্কারি নিয়ে একের পর এক খবর বার করতে লাগে ব্রিটিশ ম্যাগাজ়িন ও ট্যাবলয়েডগুলি। সংবাদমাধ্যমগুলির শিরোনামে তখন শুধু একটাই নাম, পামেলা।
মহিলাঘটিত কেলেঙ্কারির জেরে সরকারের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে ওঠা বিদেশে নতুন কিছু নয়। অন্তত দু’বার ব্রিটেন এই ধরনের ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। সেই দ্বিতীয় ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন ভারতেরই প্রাক্তন ‘সেরা সুন্দরী’ পামেলা বোর্দে ওরফে পামেলা চৌধরি বা পামেলা সিংহ। ১৯৮২ সালে ‘ভারতসেরা সুন্দরী’র খেতাব মাথায় উঠেছিল পামেলার।
তার পর থেকে উল্কার গতিতে উত্থান হয় পামেলার। হরিয়ানার এক জাঠ পরিবার থেকে উঠে আসা মেয়েটির জীবনবৃত্তান্ত আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমগুলির। ‘সেরা সুন্দরী’র মুকুট মাথায় ওঠার মাত্র সাত বছরের মধ্যেই পামেলার গায়ে সেঁটে গিয়েছিল অভিজাত সমাজের কলগার্লের তকমা। কারণ তাঁর সঙ্গে নাম জড়িয়েছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এক মহারথীর।
বিভিন্ন সূত্রের খবর, পামেলার ভক্তদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটেনের প্রথম সারির সংবাদপত্রের দু’জন সম্পাদক। এমনকি ব্রিটিশ ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠে বলে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল দেশ জুড়ে। সেই সময় ব্রিটেনের ক্ষমতায় আসীন ছিল কনজ়ারভেটিভ বা টোরি পার্টি।
পামেলা সংক্রান্ত ঘটনাটি প্রথম প্রকাশ পায় একটি ম্যাগাজ়িনে। তারা প্রকাশ করে যে, পামেলা বোর্দে নামে এক মহিলা ব্রিটেনের বুকে দ্বৈত জীবনযাপন করছেন। এক, ক্ষমতাসীন টোরি সাংসদের গবেষণা সহকারী হিসাবে এবং তাঁর অন্য পরিচয়টি হল ‘হাই প্রোফাইল কলগার্ল’। তাঁর গুণমুগ্ধদের তালিকায় বিখ্যাত ও কুখ্যাতেরা সহাবস্থান করে চলতেন। সেই তালিকায় আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মন্ত্রী পরিষদের মন্ত্রী এবং লিবিয়ার এক গোয়েন্দাকর্তাও ছিলেন।
ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলি পামেলার চোখধাঁধানো ছবি এবং নানা ধরনের বিতর্কিত দাবিতে ভরে ওঠে। একটি ম্যাগাজ়িন দাবি করে, পামেলা তাঁদের এক জন প্রতিবেদকের সঙ্গে সপ্তাহের যে কোনও কাজের দিনে ৫০০ পাউন্ড এবং সপ্তাহান্তে ২০০০ পাউন্ডের বিনিময়ে শয্যাসঙ্গী হতে রাজি হয়েছেন।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গোটা বিষয়টিকে অশ্লীল ভাবে চিত্রিত করতে শুরু করে। তখন পামেলা তাঁর কয়েক কোটি টাকার বিলাসবহুল পেন্টহাউস ছেড়ে অজ্ঞাতবাসে চলে যান। ব্যাপারটা হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেত, কিন্তু ১৯৮৯ সালে পামেলা নিজেই সমস্ত গোপনীয়তা ফাঁস করে দিতে উদ্যত হন।
বন্ধু ডেভিড সুলিভানের কাছে পামেলা প্রকাশ করেন, তিনি এমন সব ভয়ঙ্কর গোপন তথ্য জানেন, যেগুলি প্রকাশ করলে ব্রিটিশ সরকারের পতন হতে পারে। বলা হয়ে থাকে লিবিয়ার গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর সমান্তরাল যোগসূত্রই এই কেলেঙ্কারির মূল কারণ।
১৯৬১ সালে হরিয়ানার রোহতকে এক সম্ভ্রান্ত জাঠ পরিবারে জন্ম নেওয়া এই কন্যার নাম পামেলা সিংহ চৌধরি। মাত্র এক বছর বয়সে বাবাকে হারান পামেলা। মেজর মহেন্দ্র সিংহ চিন-ভারত যুদ্ধে নিহত হন। মা শকুন্তলা দেবী। সাহসিকতার জন্য মেজর মহেন্দ্রকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মরণোত্তর মহাবীর চক্র প্রদান করা হয়। জয়পুরে মহারানি গায়ত্রীদেবী স্কুলে পড়াশোনা শুরু হয় পামেলার। তার পর তিনি ভর্তি হন রাজধানীর বুকে অভিজাত লেডি শ্রীরাম কলেজে।
স্বামীর মৃত্যুর পর শকুন্তলা চণ্ডীগড়ের একটি সরকারি কলেজের হোস্টেলের ওয়ার্ডেন হন। হরিয়ানার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বনসিলালের মেয়ে সরোজ সিওয়াচ সেই কলেজে পড়াশোনা করতেন। তাঁর মাধ্যমে শকুন্তলা বনসিলালের সংস্পর্শে আসেন। মুখ্যমন্ত্রীর বদান্যতায় ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে হরিয়ানা পাবলিক সার্ভিস কমিশনে সরাসরি যোগ দেন শকুন্তলা।
মায়ের সঙ্গে কোনও দিনই সম্পর্ক ভাল ছিল না পামেলার। স্কুলের বন্ধুদের কাছে পামেলা গল্প করতেন, মা তাঁর কাছে আতঙ্কের চেয়ে কম কিছু নন।
১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে, পামেলা দিল্লির একটি মডেলিং এজেন্সি ‘অ্যাডওয়েভে’ যোগ দেন। তার মডেলিং কেরিয়ার শুরু হয় তখনই। বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনে মুখ দেখানোর পর বিজ্ঞাপনের দুনিয়ার জমি শক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন পামেলা। ১৯৮১ সালে তিনি মুম্বই পাড়ি দেন। ১৯৮২ সালে এক সর্বভারতীয় সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার খেতাব পাওয়ার পর ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়তে থাকে তাঁর। এর পর তিনি পেরুর রাজধানী লিমায় চলে যান। সেখানে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পর তিনি নিউ ইয়র্কে চলে যান।
নিউ ইয়র্কে যাওয়ার পর তিনি অস্ত্র ব্যবসায়ী আদনান খাশোগির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এমনকি সৌদি আরবের বেশ কয়েক জন ধনকুবেরও তাঁর ভক্ত হয়ে পড়েন। নিউ ইয়র্ক থেকে জাপান হয়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখেন পামেলা। সেখানে ফরাসি প্রযোজক ডোমিনিক বোর্দের সঙ্গে আলাপ হয় পামেলার। ১৯৮৪ সালের জুনে বিয়ে সারেন তাঁরা। পরে ডোমিনিক দাবি করেন, তাঁর কাকা জোর করে পামেলার সঙ্গে তাঁর বিয়ের আয়োজন করেন।
বিয়ের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ফ্রান্স থেকে স্বামীকে ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে আসেন পামেলা। স্বপ্নপূরণের ক্ষেত্র হিসাবে লন্ডনকেই বেছে নেন তিনি। রাজধানী থেকে ফোন করে জানান যে তিনি আর ফিরে আসবেন না। হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন ডোমিনিকও। তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘‘আমি খুব সাধারণ জীবনযাপন করি। পাঁচ বছর আগেও পামেলার কাছে সব সময় টাকা এবং সুন্দর পোশাক থাকত। আমার কোনও ধারণা ছিল না যে সে এত টাকা কোথা থেকে পেত।’’
লন্ডনে এসে পামেলা আবারও ধনী ও ক্ষমতাবানদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেন। সাংসদদের পাশাপাশি তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে রোমানিয়ার প্রিন্স পল, ইটালির কাউন্ট কার্লো কলম্বোটি এবং বিখ্যাত ব্যান্ড ‘দ্য রোলিং স্টোনসের’ রক সুপারস্টার বিল ওয়াইম্যানের সঙ্গে। লন্ডনের একটি নাইটক্লাবে ‘দ্য সানডে টাইমস’-এর অবিবাহিত সম্পাদক অ্যান্ড্রু নীলের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় পামেলার। তাঁদের দু’জনের উদ্দাম প্রেমের সম্পর্ক তিন মাস স্থায়ী হয়েছিল।
১৯৮৮ সালের অগস্টে নীল যখন পামেলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার চেষ্টা করেন তখন নাকি ক্ষুব্ধ হয়ে নীলের পোশাক ছিঁড়ে ফেলেন পামেলা। প্রেমে ধাক্কা খেয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পামেলা নীলের প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদমাধ্যমে ‘দ্য অবজ়ারভার’-এর সম্পাদক ডোনাল্ড ট্রেলফোর্ডের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতান।
নীলের সঙ্গে বিচ্ছেদের কয়েক দিনের মধ্যেই পামেলা ‘বোর্ডরুম’-এর সম্পাদক মার্ক বার্কারের মাধ্যমে টোরি পার্টির সাংসদ ডেভিড শ-এর সঙ্গে দেখা করেন। শ ইতিমধ্যেই তাঁর তিনটি পার্লামেন্ট পাস বিতরণ করেছিলেন। তাই, তিনি তাঁর দলের আর এক সদস্য হেনরি বেলিংহামকে পামেলাকে একটি পাস লিখে দিতে বলেন, যাতে পামেলা তাঁকে পার্লামেন্ট সংক্রান্ত গবেষণায় সহায়তা করতে পারেন। পামেলার পরিচয় হয় ‘রিসার্চার’। পার্লামেন্ট নিয়ে গবেষণা করার জন্য পামেলার জন্য হাউস অফ কমন্সের দ্বার হয়ে যায় উন্মুক্ত।
কমন্সের নিরাপত্তাবিধি লঙ্ঘন করেছেন বলে বিরোধী দলের আক্রমণের মুখে পড়েন টোরি সাংসদদ্বয়। আলোড়ন পড়ে যায় ব্রিটিশ রাজনৈতিক মহলে। বিরোধী লেবার পার্টি অবিলম্বে কনজ়ারভেটিভ পার্টির সরকারের পদত্যাগ দাবি করে। তদন্তে নামে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই ৫। ঘটনায় উদ্বিগ্ন বেলিংহাম সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, ‘‘এই মেয়েটিকে কোনও দোষ ছাড়াই মিডিয়া ক্রুশবিদ্ধ করছে। ওঁকে নিজের হয়ে কথা বলার সুযোগও দেয়নি।’’
মর্মাহত হয়েছিলেন হরিয়ানায় থাকা পামেলার পরিবারের সদস্যেরাও। তাঁরা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে মেয়ের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।
৫৫ বছর বয়সি পামেলা বোর্দে এখন গোয়ার বাসিন্দা। বিলাসবহুল প্রাসাদ ও অভিজাত সমাজের সান্নিধ্য থেকে দূরে। দু’কামরার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন ভারতসুন্দরী। ২০১০ সালে একটি সংবাদপত্র তাঁর ছবি প্রকাশ করে দাবি করে যে তিনি এখন আলোকচিত্রী হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করেন। পামেলার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানিয়েছেন, এখন পামেলা নিজের নামের সঙ্গে সিংহ পদবি ব্যবহার করেন। খ্যাতি অস্তমিত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নামের পাশ থেকে বোর্ডে পরিচয়টি মুছে ফেলতে চেয়েছেন আলোড়ন ফেলে দেওয়া ডাকসাইটে সুন্দরী পামেলা।