২৩ নভেম্বর দেশের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নিলেন বিআর গবই। রবিবার ৬৫ বছরে পা দিয়েই প্রধান বিচারপতির পদ ছাড়লেন বিচারপতি গবই। সেই পদে স্থলাভিষিক্ত হলেন বিচারপতি সূর্য কান্ত। দেশের ৫২তম প্রধান বিচারপতি ছিলেন গবই। তার পরে ৫৩তম প্রধান বিচারপতি পদে শপথ নিলেন বিচারপতি সূর্য কান্ত।
সিজেআই বা চিফ জাস্টিস অফ ইন্ডিয়া। দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান। সেই পদের দায়িত্বে এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে বরিষ্ঠতম বিচারপতি কান্ত। হরিয়ানার এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা বিচারপতি কান্তের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। ২০০০ সালে হরিয়ানার কনিষ্ঠতম অ্যাডভোকেট জেনারেল হন বিচারপতি কান্ত।
বিদায়ী প্রধান বিচারপতি গবই দায়িত্ব গ্রহণ করেন গত ১৪ মে। ছ’মাস দায়িত্ব পালনের পরে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অব্যাহতি নিলেন তিনি। ২০২৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি পদের দায়িত্ব সামলাবেন বিচারপতি কান্ত।
মানুষ কেন শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হন? প্রথমত মানুষ ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্য সবশেষে এই শীর্ষ আদালতের কাছ থেকেই বিচার চাইতে যান। দ্বিতীয়ত, জনসমাজে যাঁরা ক্ষমতাহীন সংখ্যালঘু, তাঁরাও বিচার চাইতে হাজির হন সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারে। তৃতীয়ত, মৌলিক অধিকার ভঙ্গ হলে রাষ্ট্রের নাগরিক আজও মনে করেন আদালতই শ্রেষ্ঠ জায়গা।
দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের শীর্ষ পদাধিকারীর নিয়োগ প্রক্রিয়া কেমন? সিজেআই বা চিফ জাস্টিস অফ ইন্ডিয়াকে কে বা কারা মনোনীত করেন? কত দিনের মেয়াদে এই পদে থাকেন বিচারপতিরা? সেই সমস্ত তথ্যই দেওয়া হল এই প্রতিবেদনে।
ভারতের সংবিধানের ১৪৫ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং ১৯৬৬ সালের সুপ্রিম কোর্টের নীতিমালা অনুসারে, প্রধান বিচারপতি অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে শীর্ষ আদালতের কার্যভার সামলাবেন। ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৪(৪) অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগের পদ্ধতি নির্ধারিত হলেও প্রধান বিচারপতিদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়।
এক বার নিয়োগের পর প্রধান বিচারপতি ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত এই পদে থাকতে পারেন। তবে সংবিধানে এর কোনও সুনির্দিষ্ট মেয়াদ নেই। দেশের প্রধান বিচারপতি হিসাবে বর্তমান প্রধান বিচারপতি কান্তের কার্যকালের মেয়াদ থাকবে এক বছরের কিছু বেশি সময় (১৪ মাস)।
নিয়ম অনুসারে, দেশের প্রধান বিচারপতি অবসরের আগে তাঁর উত্তরসূরি হিসাবে সুপ্রিম কোর্টের অন্য বিচারপতিদের মধ্যে থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারপতির নাম প্রস্তাব করেন। এটিই প্রচলিত রীতি। বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের একাংশের মতে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য এই রীতিটি মান্যতা পেয়েছে।
যদিও ১৯৫৮ সালে ল কমিশন এই প্রথাটির বিরোধিতা করেছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি কমিশনের পরামর্শ ছিল এত দিন ধরে যে রীতিটি চলে আসছে সেই নিয়মের পরিবর্তন ঘটানো হোক। বয়সের বিচারে দেশের সর্বোচ্চ বিচারপতির পদে নিয়োগ না হওয়াই কাম্য। মেধা ও প্রশাসনিক দক্ষতাকে বয়সের উপরে স্থান দেওয়ার জন্য সওয়াল করেছিল আইন কমিশন।
যোগ্যতাই প্রধান বিচারপতির নিয়োগ নির্ধারণের মাপকাঠি হওয়া উচিত বলে মতপ্রকাশ করেছিলেন আইনব্যবস্থার সদস্যদের একাংশ। ‘জ্যেষ্ঠতার নীতি’র মাধ্যমে নিয়োগের ফলে ঘন ঘন বিচারপতি বদল হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
সাধারণত দেশের বিভিন্ন হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতিদের মধ্যে থেকেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণত মেধা, সততা, কর্মদক্ষতা, সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার মতো বিষয়গুলিকে মান্যতা দেওয়া হয়। নিয়ম অনুসারে প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের চার জন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি কলেজিয়াম গঠন করে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতিদের নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে কমিশনের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি সরকার। সরকারের যুক্তি ছিল, এতে বিচারব্যবস্থা নিয়ে দেশের জনগণের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে। মেধার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ শুরু হলে বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হতে পারে।
১৯৫৮ সালের নিয়ম অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বেতন, গ্র্যাচুইটি, পেনশন, ভাতা ইত্যাদি নির্ধারিত হয়। হাই কোর্টগুলির ক্ষেত্রে ১৯৫৪ সালের নিয়ম অনুসরণ করা হয়। বেতন, ভাতা পেনশন সংক্রান্ত সেই নিয়ম সংশোধনের জন্য ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সংসদে একটি সংশোধন বিল উত্থাপন করা হয়েছিল। সংশোধনী বিল আনার প্রস্তাবে ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর অনুমোদন দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা।
রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর সেটি আইনে পরিণত হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে সংশোধিত বেতন কার্যকর হয়েছে সুপ্রিম ও হাই কোর্টের বিচারপতিদের। ১৯৫০ সালের পর মোট চার বার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বেতন সংশোধিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৫০ সালে ভারতের প্রধান বিচারপতির মাসিক বেতন ছিল ৫ হাজার টাকা। ১৯৮৬ সালে সেটি বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়। ১৯৯৬ সালে সেই বেতন বেড়ে ৩৩ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। ২০০৯ সালে বেতন বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ টাকা করা হয়েছিল। আর তার পর ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশমতো শেষ বার ২০১৬ সালে বেতনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
শেষ বার সংশোধিত আইন অনুসারে প্রতি মাসে ২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা বেতন পান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। অবসরের পর বার্ষিক ১৬ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা পেনশন ও মহার্ঘ ভাতা পাবেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বেতন ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। অবসরকালীন পেনশন ও মহার্ঘ ভাতা মিলিয়ে ১৫ লক্ষ টাকা পান বিচারপতিরা। গ্র্যাচুইটি বাবদ ২০ লাখ টাকা পান ভারতের প্রধান বিচারপতি।
এ ছাড়াও গৃহসজ্জার জন্য বার্ষিক ১০ লক্ষ টাকা পান দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি। সুপ্রিম কোর্টের অন্য বিচারপতিরা এই খাতে ৮ লক্ষ টাকা পান। হাই কোর্টের বিচারপতিদের জন্য গৃহসজ্জা বাবদ ৬ লক্ষ টাকা ধার্য করা হয়েছে।
বাড়ির জন্য ‘হাউস রেন্ট অ্যালাওয়েন্স’ হিসাবে মূল বেতনের ২৪ শতাংশ পান ভারতের প্রধান বিচারপতি-সহ সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্টের বিচারপতিরা। এ ছাড়া অতিথি আপ্যায়নের জন্য ৪৫ হাজার টাকা ধার্য রয়েছে বেতনকাঠামোয়।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে ভারতের প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এটি একটি অলিখিত রীতি। সেই রীতি মেনে বর্তমানে দেশের প্রধান বিচারপতি গবইয়ের পর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ হলেন বিচারপতি কান্ত। ফলে তাঁর নামই যে সদ্যপ্রাক্তন বিচারপতি গবই উত্তরসূরি হিসাবে প্রস্তাব করবেন তা নির্ধারিতই ছিল।
এর পর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হওয়ার তালিকায় আছেন যথাক্রমে বিচারপতি বিক্রম নাথ (২০২৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত), বিচারপতি বিভি নাগরত্ন (২০২৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২৯ অক্টোবর), বিচারপতি পিএস নরসিংহ (২০২৭ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২০২৮ সালের ২ মে), বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা (২০২৮ সালের ৩ মে থেকে ২০৩০ সালের ১১ অগস্ট), বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথন (২০৩০ সালের ১২ অগস্ট থেকে ২০৩১ সালের ২৫ মে), বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী (২০৩১ সালের ২৬ মে থেকে ২ অক্টোবর) এবং বিচারপতি বিপুল পাঞ্চোলি (২০৩১ সালের ৩ অক্টোবর থেকে ২০৩৩ সালের ২৭ মে)।