খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পাহাড়চূড়ায় ওঠা! মোবাইল ফোন নির্মাণকারী সংস্থা নোকিয়ার ‘রাজকীয় প্রত্যাবর্তনে’ প্রযুক্তি জগতে পড়ে গিয়েছে শোরগোল। নতুন যুগের স্মার্টফোনের দাপাদাপিতে একসময় বাজার থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছিল ১৫০ বছরের বেশি পুরনো ফিনল্যান্ডের এই বহুজাতিক কোম্পানি। এর পরই সম্পূর্ণ অন্য দিকে বাঁক নেয় ব্যবসা। ফলে মাত্র এক দশকে ফের ১০০ কোটি ডলারের সম্পত্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে নোকিয়া।
স্মার্টফোন আসার আগে মোবাইলের দুনিয়ার ‘বেতাজ বাদশা’ ছিল ফিনল্যান্ডের এই সংস্থা। কিন্তু, ২১ শতকের প্রথম দশক পেরোতেই অ্যান্ড্রয়েড এবং আইফোনের মতো গ্যাজেটের প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে নোকিয়া। শতাব্দীপ্রাচীন কোম্পানির পক্ষে সেই লড়াইতে জেতা সম্ভব ছিল না। ফলে ২০১৩ সালে মোবাইল ফোন উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় তাঁরা। ফলে প্রযুক্তিক্ষেত্রে নোকিয়ার ‘অপমৃত্যু’ হল বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল।
এ-হেন জটিল পরিস্থিতিতে টেলি পরিষেবার ব্যবসা থেকে ফিনল্যান্ডের সংস্থাটি সরে যায়নি। উল্টে সেখানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ওই সময় ব্যবসার ছক বদলাতে তিনটি সিদ্ধান্ত নেয় নোকিয়া। সেখান থেকেই তিন শতাংশের কম শেয়ার মূল্যের সম্পত্তিকে ১০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার পথের সন্ধান পায় ওই বহুজাতিক কোম্পানি, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
যে তিন জাদুমন্ত্রে নোকিয়ার ভাগ্য ফেরে, সেই তালিকার প্রথমেই আসবে মোবাইল নেটওয়ার্কের সরঞ্জাম নির্মাণ। স্মার্টফোন আসার পর ফিনল্যান্ডের সংস্থাটি বুঝে যায় ডেটা, কল বা ৫জি নেটওয়ার্ক ছাড়া ওই ডিভাইস অচল। আর তাই সেটা উন্নত করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে ভারতী এয়ারটেল, ভোডাফোন এবং রিল্যায়েন্স জিয়োর মতো টেলি যোগাযোগ পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা।
২০১৩ সালের পর মোবাইল নেটওয়ার্কের সরঞ্জাম নির্মাণকে পুরোপুরি পাখির চোখ করে নোকিয়া। ফলে পরবর্তী বছরগুলিতে মোবাইল ফোনের টাওয়ারের যাবতীয় হার্ডঅয়্যার সরবরাহের বরাত পেতে ফিনল্যান্ডের সংস্থাটির তেমন সমস্যা হয়নি। ভারতের বাইরে এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সেগুলি বিক্রি করেছে তারা। মোবাইল ফোন নির্মাণের থেকে যা ছিল অনেক বেশি লাভজনক।
নোকিয়ার ভাগ্যবদলের দ্বিতীয় জাদুকাঠির নাম অপটিক্যাল কেবল। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি বিশেষ ধরনের তার, যার সাহায্যে এক জায়গা থেকে অন্যত্র পৌঁছে যায় ইন্টারনেট পরিষেবা। বর্তমানে টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিতে কোনও একটি দেশ নয়, প্রতিটা মহাদেশে জালের আকারে ছড়িয়ে আছে অপটিক্যাল কেবল।
ইন্টারনেট পরিষেবাকে আরও শক্তিশালী করতে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স বা ভারতের মতো দেশগুলি সমুদ্রের গভীরেও বিছিয়েছে অপটিক্যাল কেবল। এর সিংহভাগটাই সরবরাহ করছে ফিনল্যান্ডের সংস্থা। ফলে এখান থেকে মোটা অর্থ রোজগারের সুযোগ পাচ্ছে নোকিয়া।
এ ছাড়া ফোন উৎপাদন বন্ধ করলেও অন্য কায়দায় ওই ব্যবসাতেও জড়িয়ে আছে ইউরোপের ওই শতাব্দীপ্রাচীন সংস্থা। গত কয়েক বছরে ২০ হাজার রকম স্মার্টফোন প্রযুক্তি তৈরি করেছে নোকিয়া। ফোন নির্মাণকারী বিভিন্ন কোম্পানিকে যা বিক্রি করেছে তারা। ফলে সেখানে রয়্যালটি বাবদ বিপুল অঙ্কের টাকা আসছে তাদের ঘরে।
চলতি বছরের অক্টোবরে মার্কিন টেক জায়ান্ট সংস্থা এনভিডিয়ার সঙ্গে ৬জি নেটওয়ার্ক এবং কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) প্রযুক্তির জন্য একটি অংশীদারি চুক্তি করে নোকিয়া। এতে ১০০ কোটি ডলার লগ্নি করছে ফিনল্যান্ডের ওই সংস্থা। সেই খবর প্রকাশ্যে আসার পর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তাদের স্টকের দাম।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, টেলি যোগাযোগকে কৃত্রিম মেধার সঙ্গে মিশিয়ে বিশ্ব জুড়ে তথ্যের প্রবাহকে অন্য গতি দিতে চাইছে এনভিডিয়া। সেই লক্ষ্যে নোকিয়াকে সঙ্গে নিয়েছে তারা। বর্তমানে অত্যাধুনিক মাইক্রো চিপ তৈরিতে সংশ্লিষ্ট মার্কিট টেক জায়ান্টটির মুনশিয়ানা রয়েছে। কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যা অত্যন্ত প্রয়োজন।
অক্টোবরে অংশীদারি চুক্তির পর যৌথ বিবৃতি দেয় এনভিডিয়া-নোকিয়া। সেখানে দুই সংস্থার পদস্থ কর্তারা বলেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট উদ্যোগটি এআই এবং ৬জি নেটওয়ার্ককে দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করবে। ফলে স্বায়ত্তশাসিত পরিবহণ থেকে শুরু করে দূরবর্তী স্বাস্থ্যসেবার মতো বিষয়গুলির সংজ্ঞা বদলে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।’’ তা ছাড়া মোবাইল ফোন গ্রাহকেরাও ইন্টারনেট ব্যবহারে অন্য স্বাদ পাবেন বলে দাবি করেছেন তাঁরা।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এনভিডিয়ার সঙ্গে চুক্তি টেলি যোগাযোগ দুনিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসাবে নোকিয়াকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। এই অংশীদারি ফিনল্যান্ডের সংস্থাটিকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। তবে তার জন্য গবেষণা এবং উন্নয়ন প্রকল্পে অনেক বেশি খরচ করতে হবে তাদের।
হ্যান্ডসেট উৎপাদন বন্ধ করার মাত্র দু’বছরের মাথায় ফের তা বাজারে ফিরিয়ে আনার এক বার মরিয়া চেষ্টা করেছিল নোকিয়া। ২০১৫ সালে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সেটা ঘোষণা করে দেয় ফিনল্যান্ডের ওই সংস্থা। যদিও গ্রাহকদের উৎসাহ ছিল খুবই কম। এর পর ফোন তৈরির ব্যবসা থেকে দূরত্ব বাড়াতে দ্বিধা করেনি নোকিয়া।
২০১৭ সালে নস্ট্যালজিয়াকে সম্বল করে ৩৩১০ হ্যান্ডসেট মডেলটিকে ফের বাজারে ফিরিয়েছিল নোকিয়া। স্পেনের বন্দর শহর বার্সেলোনায় ‘মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস’ অনুষ্ঠানে মডেলটিকে লঞ্চ করে ফিনল্যান্ডের ওই শতাব্দীপ্রাচীন সংস্থা। ওই সময় অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ছিল আবেগের ঝড়।
১৭ বছরের ‘শীতঘুম’ কাটিয়ে নোকিয়া ৩৩১০ বাজারে এলেও তা মোবাইল ব্যবহারকারীদের মন জয় করতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট মডেলে অবশ্য নতুন ফিচার হিসাবে ছিল ইন্টারনেট। ফোনটিতে ছিল ২জ়ি কানেক্টিভিটি, ৯০০ মেগাহার্টজ় এবং ১,৮০০ মেগাহার্টজ় ব্যান্ড সাপোর্ট। তার পরও গ্রাহকদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি।
বিশ্লেষকদের কাছে অবশ্য সেটা খুব আশ্চর্যের ছিল না। কারণ তত দিনে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, এমনকি ভারতেও ২জি পরিষেবা প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে মোবাইল ফোন গ্রাহকদের কাছে অনেক বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে ৩জি এবং ৪জি পরিষেবা। সেই প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পুরোপুরি ময়দান ছাড়ে নোকিয়া। সেখান থেকে আট বছরের মাথায় স্বমহিমায় টেলি দুনিয়ায় ফিরল ফিনল্যান্ডের ওই সংস্থা।