‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে ড্রোন ‘যুদ্ধে’ হাত পাকিয়েছে ভারত। দেশি-বিদেশি মানববিহীন উড়ুক্কু যানের সাহায্যে ইসলামাবাদের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) থেকে শুরু করে রেডার স্টেশনের মতো উচ্চ মূল্যের লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করেছে এ দেশের ফৌজ। ফলে আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, তুরস্ক বা ইরানের মতো শক্তিশালী ড্রোন বাহিনীর ক্লাবে ঢুকে পড়েছে নয়াদিল্লির নাম।
সাবেক সেনা অফিসারদের দাবি, আধুনিক লড়াইয়ে ‘গেম চেঞ্জার’-এর ভূমিকা নিচ্ছে মানববিহীন উড়ুক্কু যান। আর তাই ‘যুদ্ধ’ থামলেও এর গবেষণা ও উৎপাদন থেকে সরছে না ভারত। এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে একাধিক দেশীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা। তাদেরই হাত ধরে এ বার বাহিনীর বহরে শামিল হবে হাইড্রোজ়েন ড্রোন। ইজ়রায়েলি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এটি তৈরি করেছে পারস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস টেকনোলজিস লিমিটেড।
বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন পারসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) মঞ্জুল শরদ শাহ। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা দেশের প্রথম হাইড্রোজেন শক্তির ড্রোন তৈরি করেছি। প্রথাগত মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলির চেয়ে এটা অনেকটাই আলাদা। আমাদের ড্রোন কাজে যোগ দেওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। ফৌজি ট্রায়ালের চ্যালেঞ্জ নিতে আমরা মুখিয়ে আছি।’’
উল্লেখ্য, এই ড্রোন তৈরিতে পারসকে সাহায্য করেছে ইজ়রায়েলি সংস্থা হ্যাভেনড্রোন্স। এটি আবার মার্কিন সংস্থা হ্যাভেনের একটি শাখা সংগঠন। তবে ইহুদিভূমিতে স্বশাসিত ড্রোন উৎপাদনকারী সংস্থা হিসাবে কাজ করে হ্যাভেনড্রোন্স। বছর কয়েক আগে হাইড্রোজেন শক্তির মানববিহীন উড়ুক্কু যান তৈরি করতে তাদের সঙ্গে চুক্তি সারে পারস।
ড্রোনকে ওড়াতে যে শক্তির প্রয়োজন হয়, সাধারণত তার জোগান দেয় ব্যাটারি। হাইড্রোজেন শক্তির মানববিহীন উড়ুক্কু যান তার চেয়ে অনেকটাই আলাদা। বর্তমানে এই ধরনের ড্রোন ব্যবহার করে আমেরিকা ও ইজ়রায়েলি বাহিনী। আগামী দিনে তাদের পাশে যে ভারতীয় ফৌজের নাম থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।
পারসের এমডি মঞ্জুল শরদ বলেছেন, ‘‘হাইড্রোজেন শক্তির ড্রোনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, এটি দীর্ঘ সময় বাতাসে থাকতে পারে। যে কোনও অপারেশনে পাঁচ গুণ বেশি সময় ধরে ওড়ার ক্ষমতা রয়েছে এই ড্রোনের।’’ পাশাপাশি, এই মানববিহীন যানগুলিকে স্টেল্থ পর্যায়ের বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। অর্থাৎ, কোনও রেডার সহজে চিহ্নিত করতে পারবে না এই ড্রোনকে।
সেনাবাহিনী ছাড়াও হাইড্রোজেন ড্রোন অসামরিক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন পারসের এমডি। তবে এই মানববিহীন যান আত্মঘাতী হামলা চালাতে পারে কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। ড্রোনটির ভারবহন ক্ষমতাও সংস্থার তরফে এখনও জানানো হয়নি। দীর্ঘ দিন ধরেই মানববিহীন যানের বিশ্ববাজারে পা জমাতে চাইছে পারস। এই হাইড্রোজেন ড্রোন সংস্থাটিকে সেই সুযোগ করে দেবে বলে মত বিশ্লেষকদের একাংশের।
মঞ্জুল শরদ অবশ্য জানিয়েছেন, আপাতত ফৌজি ড্রোনের প্রোটোটাইপ তৈরি করেছেন তাঁরা। বাহিনীতে এর অন্তর্ভুক্তি হলে অসামরিক হাইড্রোজেন ড্রোন তৈরিতে নজর দেওয়া হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েকটা বছর। গত অর্থবর্ষের (পড়ুন ২০২৪-’২৫) শেষ ত্রৈমাসিকে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) পারসের নিট মুনাফার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১৮.৭ কোটি। হাইড্রোজেন ড্রোন এই অঙ্ককে কয়েক গুণ বাড়াতে সাহায্য করবে বলে আশাবাদী তারা।
অন্য দিকে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দু’টি ড্রোন তৈরি করেছে কানপুর আইআইটি। আগামী ২৫ মে সেগুলির প্রথম দফার পরীক্ষা চালাবে ভারতীয় সেনা। সব কিছু ঠিক থাকলে এ বছরের শেষের দিকে বা আগামী বছরের গোড়ায় সেগুলির উৎপাদন শুরু হতে পারে। দু’টির মধ্যে একটি মানববিহীন যান শত্রুর উপর হামলা চালাতে সক্ষম। দ্বিতীয়টিকে মালবাহী ড্রোন বলা যেতে পারে।
সংশ্লিষ্ট ড্রোন দু’টি তৈরি করেছে আইআইটি কানপুরের অ্যারোস্পেস বিভাগ। সেখানকার অধ্যাপকদের দাবি, দু’টি মানববিহীন যানকেই ‘স্টেল্থ’ ক্যাটেগরি, অর্থাৎ রেডারকে এড়িয়ে চলার মতো করে বানানো হয়েছে। এগুলি বাহিনীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে বলে আশাবাদী তাঁরা। প্রথম পরীক্ষায় ড্রোন দু’টি পাশ করলে আরও দুই থেকে তিন বার পরীক্ষা দিতে হতে পারে বলে সূত্র মারফত জানা গিয়েছে।
আইআইটি কানপুরের তৈরি একটি ড্রোনের নাম ফার্স্ট পারসন ভিউ (এফপিভি) কমব্যাট। এটি প্রকৃতপক্ষে স্বল্পপাল্লার আত্মঘাতী ‘কামিকাজ়ে’ মানববিহীন যান। ড্রোনটির ওজন ১০ কেজিরও কম। এতে রয়েছে অত্যাধুনিক ক্যামেরা, যা দিয়ে যুদ্ধের সময় রিয়্যাল টাইম ভিডিয়ো হাতে পাবে ফৌজ। ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে টানা ৩০ মিনিট ওড়ার ক্ষমতা রয়েছে এফপিভি কমব্যাটের।
এই ড্রোনটির নকশা জনবহুল শহর এবং পাহাড়ি রাস্তায় ওড়ার মতো করে নির্মাণ করেছেন আইআইটির অধ্যাপকেরা। এর নেভিগেশনকে জিপিএসের বাইরে রেখেছেন তাঁরা। ফলে জ্যামার বসানো থাকলেও সেখানে দিব্যি কাজ করতে পারবে এই ড্রোন। মূলত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতো অপারেশনের জন্য সংশ্লিষ্ট ড্রোনটিকে বানানো হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
এ ছাড়া লজিস্টিক সরবরাহের জন্য দ্বিতীয় মানববিহীন যানটিকে তৈরি করেছেন আইআইটির অধ্যাপকেরা। সংশ্লিষ্ট ড্রোনটির পাল্লা ৪০ কিলোমিটার। ৩০ কেজি পর্যন্ত পণ্য নিয়ে ওড়ার ক্ষমতা রয়েছে এর। ড্রোনটিতে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন, অটো রিটার্ন এবং প্যারাসুট। যে কোনও পরিবেশে কাজ করতে এটি সক্ষম বলে জানিয়েছে কানপুর আইআইটি।
সীমান্তবর্তী ঘাঁটি এবং দুর্বল পাহাড়ি এলাকায় গোলাবারুদ, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং খাবার ও জল পৌঁছে দিতে এই ড্রোনটিকে ব্যবহার করতে পারবে বাহিনী। সেই কথা মাথায় রেখেই এর নকশা তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে এই কাজে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে ভারতীয় ফৌজ। ভবিষ্যতে এই ড্রোন তার পরিপূরক হয়ে উঠবে বলে দাবি করা হয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে আইআইটি কানপুরের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। এর আগেও বাহিনীকে ৩০টি ড্রোন সরবরাহ করেছে দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেগুলিকে দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে মোতায়েন করেছে ফৌজে। তাদের বহরে এই প্রতিষ্ঠানের তৈরি আরও দু’টি ড্রোন শামিল হয় কি না, সেটাই এখন দেখার।
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ মোট ২৬ জন। ৭ মে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে সেই ঘটনার বদলা নেয় ভারত। পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের (পাকিস্তান অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকে) মোট ন’টি জায়গায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সন্ত্রাসবাদীদের গুপ্ত ঘাঁটি।
সূত্রের খবর, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ‘স্কাই স্ট্রাইকার’ নামের একটি আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করে ভারতীয় ফৌজ। ইজ়রায়েলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট ড্রোনটিকে তৈরি করেছে আদানি গোষ্ঠীর সংস্থা আলফা ডিজাইন টেকনোলজিস। ফলে এর চাহিদা যে আগামী দিনে কয়েক গুণ বাড়তে চলেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এ ছাড়া ইজ়রায়েলের তৈরি ‘হারোপ’ আত্মঘাতী ড্রোনও পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে বহুল পরিমাণে ব্যবহার করেছে ভারতীয় সেনা। সূত্রের খবর, এর সাহায্যেই লাহৌরের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কে ধ্বংস করেছে ফৌজ। প্রসঙ্গত, সেখানে মোতায়েন ছিল চিনের তৈরি এইচকিউ-৯পি নামের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে সেটি ভারতীয় ড্রোনকে আটকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
বিশ্লেষকদের দাবি, ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তার পরবর্তী সময়ে ইসলামাবাদের সঙ্গে সংঘাতে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল ঘরের মাটিতে তৈরি হাতিয়ারের ব্যবহার। আগামী দিনে সেগুলি রফতানিতে জোর দেওয়ার সুযোগ পাবে নয়াদিল্লি। আর এই অস্ত্র ব্যবসার প্রতিযোগিতায় ভারতীয় ড্রোন নির্মাণকারী সংস্থাগুলি বড় জায়গা দখল করতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার।