ভারতীয় চিংড়িচাষিদের পাশে এ বার চিন! ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত থেকে পণ্য আমদানির উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর পর আমেরিকা ছেড়ে এ বার চিনের বাজার ধরায় মন দিয়েছেন ভারতীয় চিংড়ি ব্যবসায়ীরা। তেমনটাই উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে।
ট্রাম্পের শুল্কখাঁড়ার কোপ পড়েছিল ভারতের চিংড়িচাষিদের ঘাড়ে। ক্ষতির মুখে পড়েছিল ভারতীয় সামুদ্রিক খাবার রফতানির ব্যবসা। এর পরেই বিকল্প বাজার ধরতে মরিয়া হয়ে ওঠেন এ দেশের সামুদ্রিক মৎস্যচাষিরা।
আমেরিকা ছাড়া সামুদ্রিক খাবারের চাহিদা রয়েছে এমন দেশ, যেমন রাশিয়া, ব্রিটেন, নরওয়ে, সুইৎজ়ারল্যান্ড, চিন, জাপান এবং পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিতে বিকল্প বাজার খোঁজার চেষ্টা চলছিল।
ভারতীয় চিংড়িচাষিদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে ‘দেবদূত’ হয়ে আগেই এগিয়ে এসেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইতিমধ্যেই ভারতের সামুদ্রিক খাবার রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে অতিরিক্ত ১০২টি ভারতীয় মৎস্য সংস্থাকে রফতানির অনুমোদন দিয়েছে ইইউ।
এ বার ভারতীয় সামুদ্রিক খাবার রফতানিকারকদের আবেদনে চিনও সাড়া দিয়েছে বলে খবর। চিনের অভ্যন্তরে সামুদ্রিক খাবার, বিশেষ করে চিংড়ির চাহিদা ব্যাপক। আর সে কারণেই ভারতীয় চিংড়ি রফতানিকারকদের আবেদনে চিন সাড়া দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। দু’পক্ষের মধ্যে চুক্তি হলে ভারতীয় সামুদ্রিক খাবারের জন্য চিন দ্রুত বর্ধনশীল বাজারে পরিণত হতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, আমেরিকার শুল্কাঘাত ভারতীয় চিংড়ি রফতানিকারকদের জন্য আশীর্বাদ বলে প্রমাণিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। ওয়াকিবহাল মহলের এক জন সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘‘আমেরিকার পরে ভারতীয় চিংড়ির দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক ছিল চিন। এখন সেই চিনের বাজারই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বাজার হিসাবে উঠে আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয় চিংড়ির শীর্ষ আমদানিকারক হয়ে উঠতে পারে চিন।’’
আগে বিকল্প বাজার হিসাবে সে ভাবে গুরুত্ব না দেওয়া হলেও বর্তমানে সামুদ্রিক খাবার প্রক্রিয়াকরণ এবং পুনঃরফতানির জন্য প্রাধান্য পেয়েছে চিন। শুল্কমুক্ত বাজারে সরবরাহের জন্য ভারত থেকে কাঁচা চিংড়ি সংগ্রহ করে চিন। কিন্তু বিগত কয়েক দিনে ভারত থেকে চিনে চিংড়ি আমদানির পরিমাণ বেড়েছে। ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
জানা গিয়েছে, আমেরিকার ক্রেতাদের উপর নির্ভরতা কমাতে চিন ছাড়াও ইউরোপের একাধিক দেশ, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াতেও বাজার ধরার চেষ্টা করছেন ভারতীয় সামুদ্রিক খাবার রফতানিকারকেরা।
এ সবের সূত্রপাত ট্রাম্পের শুল্কখাঁড়ার কোপ ভারতের চিংড়িচাষিদের ঘাড়ে পড়ার পরে। ভারতীয় সামুদ্রিক খাবার রফতানির ব্যবসা প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার। আমেরিকাতেই এত দিন ভারতীয় সামুদ্রিক খাবার সবচেয়ে বেশি রফতানি হত। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর পর প্রশ্ন উঠেছিল ৬০ হাজার কোটির বাজার কি তা হলে ধ্বংস হয়ে যাবে? ঘুম উড়েছিল দেশের সামুদ্রিক মৎস্যচাষিদের।
ভারতের উপর প্রথমে ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। পরে রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে ‘জরিমানা’ হিসাবে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপান নয়াদিল্লির উপর। এর পরেই ভারতের সামুদ্রিক মৎস্যচাষিদের জীবনে আঁধার নেমে আসে। ট্রাম্পের শুল্কনীতির জেরে ভারতের যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ধাক্কা খেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল সামুদ্রিক খাবার রফতানির ব্যবসা। সেই আশঙ্কা সত্যি করে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েন সামুদ্রিক মৎস্যচাষিরা।
ভারতে উৎপন্ন সামুদ্রিক খাবারের যতটা না এ দেশে খাওয়া হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি রফতানি হয়। রফতানি করা হয় মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশেরও বেশি। সামুদ্রিক খাবারের মধ্যে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি যে পণ্য বিদেশে রফতানি করা হয়, তা হল চিংড়ি।
পরিমাণের দিক থেকে এবং মূল্যের নিরিখে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি হওয়া পণ্যগুলির মধ্যেও অন্যতম চিংড়ি। পরিমাণ ভারত থেকে রফতানি হওয়া সামুদ্রিক খাবারের দুই-তৃতীয়াংশ। এত দিন চিংড়ি-সহ যে পরিমাণ সামুদ্রিক খাবার ভারত থেকে রফতানি করা হত, তার মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ যেত আমেরিকায়।
বিগত কয়েক বছরে সামুদ্রিক খাবার রফতানির দিক থেকে ফুলেফেঁপে উঠেছিল ভারত। বাণিজ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবর্ষে ৭৪৫ কোটি ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি) মূল্যের প্রায় ১৭ লক্ষ টন সামুদ্রিক খাবার রফতানি করেছে ভারত। এর মধ্যে চিংড়ি রফতানি থেকে আয় হয়েছিল প্রায় ৫০০ কোটি ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি)।
২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারত থেকে ২৪০ কোটি ডলার মূল্যের চিংড়ি আমদানি করেছিল আমেরিকা। ভারতের সামুদ্রিক মৎস্যচাষকে উদীয়মান ক্ষেত্র হিসাবে দেখা হচ্ছিল এত দিন। সামুদ্রিক খাদ্যপণ্যের উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছিল ভারতের অভ্যন্তরে। বৃদ্ধি পেয়েছিল কৃত্রিম ভাবে ভেড়ি তৈরি করে চিংড়ির চাষ। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কবৃদ্ধির কারণে চাপে পড়েন সামুদ্রিক মৎস্যচাষিরা। ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশে সবচেয়ে বেশি চিংড়ি চাষ হয়। তাই সে রাজ্যের চাষিদের উপরই প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি।
ট্রাম্পের শুল্কনীতির পর চিংড়ি রফতানি ১৫-১৮ শতাংশ কমে। সব মিলিয়ে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্যের রফতানি কমে প্রায় ৫০ শতাংশ। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সামুদ্রিক খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে বাধ্য হন চাষিরা। বিশেষ মুনাফা না হওয়ায় কৃত্রিম ভাবে চিংড়ির চাষও বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল বেশ কিছু জায়গায়। অন্য চাষের দিকে ঝুঁকছিলেন সামুদ্রিক মৎস্যচাষিদের একাংশ।
মনে করা হচ্ছিল, আমেরিকার শুল্কের চাপে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত প্রায় ২ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের জীবনে প্রভাব পড়েছে। আর এই আবহে লাভ হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড, ইকুয়েডরের সামুদ্রিক মৎস্যচাষিদের। কারণ, ভারতের মতো ওই দেশগুলিতেও সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য উৎপাদনের পরিমাণ বেশি।
অথচ এর মধ্যে বেশির ভাগ দেশেই ট্রাম্পের চাপানো শুল্কের পরিমাণ ভারতের উপর চাপানো শুল্কের অর্ধেকেরও কম। আর তাই আমেরিকার বাজার দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ওই দেশগুলির সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য রফতানিকারকেরা। কিছু ক্ষেত্রে সফলও হতে শুরু করেছে তারা।
তাই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ছিল, পরবর্তী কালে শুল্ক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও আমেরিকার বাজারে সামুদ্রিক খাবার নিয়ে ঢোকার ক্ষেত্রে বেগ পেতে হবে ভারতীয় মৎস্যচাষিদের। এর পরেই বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হয় কেন্দ্রীয় সরকার। সামুদ্রিক খাবার রফতানিকারকদের বিকল্প বাজার অনুসন্ধান করার পরামর্শ দেওয়া হয় সরকারের তরফে। আমেরিকা ছাড়া সামুদ্রিক খাবারের চাহিদা রয়েছে এমন দেশগুলিতে বিকল্প বাজার খোঁজার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া মৎস্যচাষে ত্রাণ দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথাও জানায় সরকার। রফতানি ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সামুদ্রিক মৎস্যচাষিরা যাতে উৎপাদন বন্ধ না করেন, সেই আবেদনও জানানো হয় কেন্দ্রের তরফে। রাজ্য সরকারগুলিও এ বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ করতে শুরু করে। অন্ধ্রপ্রদেশে দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা শুরু হয়। সামুদ্রিক খাবার রফতানির চেষ্টা করা হচ্ছিল ইউরোপের বাজারে। এ ছাড়াও যাতে দেশে সামুদ্রিক খাবারের চাহিদা বৃদ্ধি করা যায়, সে চেষ্টাও চলছিল। বিশ্ববাজারে সামুদ্রিক খাবারের চাহিদা বিপুল। তাই চেষ্টা চলছিল সামুদ্রিক খাবারের শিল্প বহুমুখী করারও।
এর পরেই সামুদ্রিক মৎস্যচাষিদের সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে ‘দেবদূতের’ মতো আগমন হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের। ভারতের সামুদ্রিক খাবার রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে অতিরিক্ত ১০২টি মৎস্য ইউনিটকে রফতানির অনুমোদন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
জানা গিয়েছে, জলজ পালন ইউনিট, প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র এবং কোল্ড স্টোরেজের সুবিধা থাকা সংস্থাগুলি এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নে সামুদ্রিক খাবার রফতানি করতে পারবে। বাণিজ্য মন্ত্রকও জানিয়েছে, এই পদক্ষেপের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সামুদ্রিক খাবার রফতানি তাৎক্ষণিক ভাবে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে স্বস্তি ফিরবে ট্রাম্পের শুল্পবাণের আঘাতে ক্ষতির মুখে পড়া ভারতীয় চিংড়িচাষিদের জীবনে।
সামুদ্রিক মৎস্যচাষিদের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের দরজা খোলা এই মুহূর্তে ভারতের ‘বড় জয়’ হিসাবে দেখছিলেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। এই পদক্ষেপ ভারতের উপর মার্কিন শুল্কের প্রভাব কমাতে এবং সামুদ্রিক খাবার রফতানিকারকদের ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশ করতে সাহায্য করবে বলেও আশা করা হচ্ছিল।
এর মধ্যেই এ বার চিনের বাজারে রফতানি বৃদ্ধির খবর নতুন করে আনন্দ এনে দিয়েছে ভারতীয় সামুদ্রিক মৎস্যচাষিদের জীবনে। মনে করা হচ্ছে, তাঁদের সুমসয় আবার ফিরতে চলেছে। উৎসবের মরসুমে চিনের বাজার খোলা ভারতীয় সামুদ্রিক মৎস্যচাষিদের জীবনে ‘ডবল ধামাকা’র মতো বলেও মনে করছেন বিশষেজ্ঞদের একাংশ।
আবার বিশেষজ্ঞদের অনেকে এ-ও মনে করছেন, ইউরোপ এবং চিনের বাজার খোলার কারণে ভারতীয় সামুদ্রিক খাবার রফতানিকারক এবং মৎস্যচাষিদের ভাগ্য খুলবে ঠিকই, তবে ভারতের সামুদ্রিক মৎস্যচাষিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকার বাজারও। ফলে ভারতকে চেষ্টা করতে হবে আমেরিকার বাজারে আবার আধিপত্য বিস্তারের।