দিল্লি বিস্ফোরণকাণ্ডের নেপথ্যে ২৬/১১ হামলার ‘মূল চক্রী’ হাফিজ় সইদ? হাত রয়েছে পাকিস্তান মদতপুষ্ট কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-এ-ত্যায়বার? ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জোরালো হচ্ছে সন্দেহ। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর বদলা নিতে হাফিজ় উঠেপড়ে লেগেছেন বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় খবর। ঠিক তার পরেই নাশকতার ঘটনা ঘটায়, এর মধ্যে কোনও যোগসূত্র রয়েছে কি না, তার খোঁজ চালাচ্ছেন এ দেশের গোয়েন্দারা। তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই ইস্যুতে কিছু জানায়নি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর পাকিস্তানের খইরুপুর তামেওয়ালি এলাকায় একটি জনসভায় ভার্চুয়াল ভাষণ দেন লশকরের শীর্ষনেতা তথা হাফিজ়-ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত সইফুল্লাহ সইফ। সেখানেই প্রথম বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে ভারতে নাশকতার ছক কষা হচ্ছে বলে জানান কুখ্যাত ওই সন্ত্রাসী। তার ভাষণের ভিডিয়ো হাতে পেতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
সূত্রের খবর, খইরুপুর তামেওয়ালির জনসভায় দেওয়া ভিডিয়োবার্তায় সইফুল্লাহ বলেন, ‘‘হাফিজ় সইদ চুপ করে বসে নেই। উনি বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছেন।’’ পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিতে লশকরের চর এবং জঙ্গিদের সক্রিয় করা হয়েছে বলেও দাবি করেন ওই কুখ্যাত জঙ্গি। শুধু তা-ই নয়, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর বদলা নিতে সেখানে ব্যাপক ভাবে মৌলবাদ এবং ভারত-বিরোধী উগ্রপন্থা ছড়ানো হচ্ছে বলেও খবর পাওয়া গিয়েছে।
লশকরের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, বাংলাদেশের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী ভাবাদর্শ ছড়িয়ে দিতে সেখানে এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে পাঠিয়েছেন হাফিজ়। তিনি নিজেও নাকি বিষয়টির উপর নজর রেখেছেন। ছড়িয়ে পড়া ভিডিয়োয় লশকর নেতা সইফুল্লাহকে বলতে শোনা গিয়েছে, “এখন আমেরিকা আমাদের সঙ্গে রয়েছে। বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানের কাছাকাছি আসছে।” তার ওই মন্তব্যের পর আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি ঢাকা।
সইফুল্লাহের ওই ভাষণের ঠিক ১০ দিনের মাথায় দিল্লিতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটায় সন্দেহের তির ঘুরেফিরে যাচ্ছে লশকরের দিকেই। তবে এই নাশকতার সঙ্গে বাংলাদেশের কোনও যোগসূত্র আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। হাফিজ়ের সংগঠনকে বাদ দিলে গোয়েন্দাদের রেডারে রয়েছে পাক মদতপুষ্ট আরও একটি জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদ। অতীতেও বিস্ফোরকবোঝাই গাড়িতে ফিদায়েঁ হামলা চালাতে দেখা গিয়েছে তাদের।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, সম্প্রতি মহিলাদের জন্য একটি নতুন সন্ত্রাসী শাখা খুলেছে জইশ, নাম ‘জামাত-উল-মুমিনাত’। এতে শুরু হয়েছে নিয়োগপ্রক্রিয়া এবং তহবিল সংগ্রহের কাজ। নারীদের সন্ত্রাসবাদী হিসাবে গড়ে তুলতে একটি অনলাইন কোর্স চালু করছে তারা। সেখানে শিক্ষিকার ভূমিকায় থাকবেন জইশ প্রধান তথা কুখ্যাত জঙ্গিনেতা মাসুদ আজ়হারের দুই বোন সাদিয়া আর সামাইরা এবং ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় সিআরপিএফের উপর হামলার জড়িত জঙ্গিদের স্ত্রীরা।
তদন্তকারীদের দাবি, সংশ্লিষ্ট অনলাইন কোর্সটির লক্ষ্য হল মৌলবাদী এবং জিহাদি শিক্ষাদানের মাধ্যমে মহিলা ব্রিগেডে আরও বেশি সংখ্যক জঙ্গি নিয়োগ। ৮ নভেম্বর থেকে এটি চালু করার কথা ঘোষণা করেছিল জইশ। তবে সেটা শুরু হওয়ার ব্যাপারে আর কোনও তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি। এতে মহিলা ‘শিক্ষার্থীদের’ কাছ থেকে অনুদান হিসাবে ৫০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। উল্লেখ্য, মাসুদের ছোট বোন সাদিয়ার স্বামী জইশ কমান্ডার ইউসুফ আজ়হারকে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ নিকেশ করে এ দেশের ফৌজ।
তবে দিল্লি বিস্ফোরণকাণ্ডে জইশ না কি লশকর, কোন জঙ্গিগোষ্ঠীর হাত রয়েছে, বা আদৌ আছে কি না, সেই ধন্দ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি গোয়েন্দারা। ১০ নভেম্বর নাশকতার দিন এবং তার আগের কয়েক দিন মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত তিন জন চিকিৎসক-সহ মোট আট জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের থেকে মিলেছে প্রায় ২,৯০০ কেজি বিস্ফোরক। ধৃতরা সকলেই ‘আনসার গাজ়ওয়াত-উল-হিন্দ’ নামের একটি গোষ্ঠীর সদস্য বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা, যা প্রকৃতপক্ষে জইশের একটি শাখা সংগঠন।
পুলিশ সূত্রে খবর, দিন দশেক আগে হরিয়ানার ফরিদাবাদে কর্মরত কাশ্মীরি চিকিৎসক মুজ়াম্মিল শাকিলকে জালে তোলে যৌথবাহিনী। পুলওয়ামার বাসিন্দা শাকিল সেখানকার আল-ফালহা মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে চাকরি করছিলেন। পরে তাঁর ভাড়াবাড়ি থেকে উদ্ধার হয় ৩৫০ কেজি বিস্ফোরক, ২০টা টাইমার এবং অ্যাসল্ট রাইফেল। উদ্ধার হওয়া বিস্ফোরক অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
পুলিশ সূত্রে খবর, ওই বাড়ি থেকে অন্তত চার কিলোমিটার দূরে আরও একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল শাকিল। সন্ধান পেয়ে সেখানেও তল্লাশি চালায় বাহিনী। ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় ২,৫৬৩ কেজি বিস্ফোরক। আটটি বড় এবং চারটি ছোট সুটকেসে যা ভর্তি করা ছিল। শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদের পর আল ফালহা হাসপাতালের এক মহিলা চিকিৎসককে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার গাড়িতে মেলে একটি একে ৭৪ রাইফেল এবং পিস্তল। দিল্লি বিস্ফোরণের সঙ্গে এদের যোগসূত্র খতিয়ে দেখছে প্রশাসন।
এ ছাড়া গত চার দিনে আরও তিন জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে বেশ কয়েক জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন গোয়েন্দারা। এর মধ্যে তিন জনকে অহমদাবাদ থেকে জালে তোলে গুজরাত এটিএস। জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ এবং উত্তরপ্রদেশের সহারনপুর থেকেও গ্রেফতার হয়েছে সন্ত্রাসী। ধৃতদের কে কোন জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য, সেই সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য অবশ্য প্রকাশ করেনি প্রশাসন।
সোমবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই কেঁপে ওঠে দিল্লির লালকেল্লা সংলগ্ন এলাকা। স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, সন্ধ্যা ৬টা ৫২ মিনিট নাগাদ লালকেল্লার এক নম্বর গেটের উল্টো দিকের রাস্তার সিগনালে হুন্ডাইয়ের ‘আই২০’ মডেলের একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়। কিছু ক্ষণের মধ্যেই বিস্ফোরণ হয় তাতে। এর জেরে আশপাশের একাধিক গাড়িতেও আগুন ধরে যায়। বিস্ফোরণের অভিঘাতে একাধিক ব্যক্তির ছিন্নভিন্ন দেহাংশ রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে।
বিস্ফোরণের পরে আশপাশের এলাকার বিভিন্ন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখতে শুরু করেন তদন্তকারীরা। তাতে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় তিন ঘণ্টা লালকেল্লার কাছে একটি পার্কিংয়ে গাড়িটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। এর আশপাশেই ঘোরাঘুরি করছিলেন নীল-কালো রঙের টি-শার্ট পরা এক ব্যক্তি। তাঁকে কাশ্মীরি চিকিৎসক উমর মহম্মদ বলে দাবি করেছে একাধিক গণমাধ্যম। তাঁকে গাড়ির বর্তমান ‘মালিক’ বলে দাবি করেছে এনডিটিভি।
প্রসঙ্গত, বিস্ফোরণ ঘটা গাড়ির নম্বরপ্লেট অবশ্য ছিল হরিয়ানার। সেই সূত্র ধরে জনৈক মহম্মদ সলমন নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া গাড়িটি তাঁরই নামে রেজিস্ট্রেশন করা আছে বলে জানা গিয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার পর রাতভর দিল্লির পাহাড়গঞ্জ, দরিয়াগঞ্জ এবং আশপাশের এলাকার হোটেলগুলিতে তল্লাশি চালায় বাহিনী। এতে চার জন গ্রেফতার হয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদসংস্থা পিটিআই।
তদন্তকারীদের একাংশের অনুমান, দিল্লিতে নাশকতার জন্য কোনও শাখা সংগঠনকে ব্যবহার করে থাকতে পারে লশকর ও জইশের মতো জঙ্গিগোষ্ঠী। চলতি বছরের ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারান ২৫ পর্যটক-সহ ২৬ জন। সেই ঘটনার দায় স্বীকার করে প্রথমে বিবৃতি দেয় লশকরের শাখা সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্ট ফ্রন্ট’। পরে অবশ্য হামলার কথা অস্বীকার করে তারা।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে বিস্ফোরকবোঝাই গাড়ি নিয়ে ফিদায়েঁ হামলা চালায় এক জইশ জঙ্গি। তাতে প্রাণ হারান আধা সেনার ৪০ জন জওয়ান। দিল্লিতেও একই ধাঁচের নাশকতার ছক ছিল পাক মদতপুষ্ট ওই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর? উঠছে প্রশ্ন।
পহেলগাঁও হামলার বদলা দিতে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকের (পাকিস্তান অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর) একাধিক জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় ভারতীয় ফৌজ। সেই অভিযানের পোশাকি নাম হল ‘অপারেশন সিঁদুর’। সংশ্লিষ্ট অভিযান চলাকালীন পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের অভ্যন্তরে মুরিদকে এবং বাহওয়ালপুরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় এ দেশের বাহিনী। এই দু’টি জায়গায় ছিল লশকর এবং জইশের মূল কার্যালয়।
ভারতের ওই প্রত্যাঘাতের পর পাক জঙ্গিদের নাশকতা কমবে বলে আশা করা হয়েছিল। বাস্তবে তা হয়নি। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ফের বিস্ফোরণে কাঁপল রাজধানী দিল্লি। ইতিমধ্যেই যার তদন্তে নেমেছে ‘ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি’ বা এনআইএ। বিস্ফোরণস্থলের ফরেন্সিক পরীক্ষা হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।