প্রকাশ্যে সামাজিক কর্মকাণ্ড। আড়ালে ভয়ঙ্কর ছক। ‘সাদা কলারের’ পেশার আবডালে ধীরে ধীরে জমি তৈরি করছিল একটি গোষ্ঠী। দিল্লির বিস্ফোরণের নেপথ্যকারণ খুঁজতে গিয়ে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর নাম আতশকাচের নীচে আসছে বার বার। উচ্চশিক্ষিত, পেশাদারদের নিয়ে গঠিত একটি বিশেষ মডিউলের ব্যবহার করেছে এই গোষ্ঠীটি।
কাশ্মীরে নাশকতার উদ্দেশ্যে যে বিশেষ গোষ্ঠী সক্রিয় হয়েছে, তারা সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে তৈরি করত নাশকতার ছক। দিল্লির বিস্ফোরণের নেপথ্যে এখনও নাশকতার কোনও স্পষ্ট প্রমাণ না মিললেও আত্মঘাতী হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে।
কাশ্মীরে হামলার উদ্দেশ্যে জড়ো হচ্ছে একটি বিশেষ গোষ্ঠী। এমন খবর কানে আসতেই তদন্তে নামে কাশ্মীর পুলিশ। তিন সপ্তাহ আগে অক্টোবরের শেষের দিকে সেই ঘটনার আঁচ পায় পুলিশ। তল্লাশি চালিয়ে চিকিৎসক আদিল আহমেদ রাঠরকে গ্রেফতার করে কাশ্মীর পুলিশ। অভিযোগ, শ্রীনগরে পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদের সমর্থনে পোস্টার সাঁটিয়েছিলেন তিনি।
আদিলকে জেরা করে আরও দু’জন চিকিৎসকের নাম উঠে আসে। সূত্র ধরে খোঁজ মেলে চিকিৎসক মুজ়াম্মিল আহমেদের। জেরায় প্রকাশ্যে আসে দিল্লির অনতিদূরে হরিয়ানার ফরিদাবাদে বিস্ফোরক মজুতের খবর। তল্লাশি চালাতেই উদ্ধার হয় ৩৬০ কেজি আরডিএক্স তৈরির মশলা।
পরে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, গত কয়েক দিনে দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। সব মিলিয়ে উদ্ধার হয়েছে মোট ২৯০০ কেজি বিস্ফোরক! আদিলকে জিজ্ঞাসাবাদের পর এই গোষ্ঠীটি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জোগাড় করে পুলিশ।
তদন্তে উঠে আসে, বেছে বেছে ব্যক্তিবিশেষকে চিহ্নিত করে গোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি। এই চক্রের তদন্তে বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করে কাশ্মীর পুলিশ। ধৃতেরা হলেন আরিফ নিসর দার, ইয়াসির-উল-আসরফ, মকসুদ আহমেদ দার, ইরফান আহমেদ, জ়ামির আহমেদ। মুজ়াম্মিলের আর এক সহযোগী মহিলা চিকিৎসক শাহিনের হদিস পায় পুলিশ।
বিস্ফোরণের পর প্রশ্ন উঠলেও ফরিদাবাদের বিস্ফোরক মজুতের ঘটনার সঙ্গে দিল্লির কোনও যোগসূত্র রয়েছে তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট তথ্য দেয়নি দিল্লি পুলিশ। গত কয়েক দিন ধরে জম্মু ও কাশ্মীর (শ্রীনগর, অনন্তনাগ, গান্দরবল এবং শোপিয়ান) এবং ফরিদাবাদ জুড়ে অভিযান চালিয়ে পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ‘হোয়াইট কলার’ মডিউলটির হদিস পায়।
সোমবার সন্ধ্যায় যে গাড়িটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেটির নম্বরপ্লেট হরিয়ানার। সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, ওই গাড়িটির বর্তমান ‘মালিক’ ছিলেন পুলওয়ামার এক চিকিৎসক। নাম উমর মহম্মদ। ফরিদাবাদ কাণ্ডে গ্রেফতার দুই চিকিৎসক মুজ়াম্মিল ও আদিলের সঙ্গেও তাঁর যোগসূত্র রয়েছে বলে দাবি উঠছে সংবাদ প্রতিবেদনে। এই তিন চিকিৎসক একই মডিউলের অংশ ছিলেন বলেও দাবি উঠেছে।
উমর, আদিল এবং মুজ়াম্মিল। তিন জনই চিকিৎসক। মুজ়াম্মিলের এক মহিলা সহযোগী লখনউ থেকে গ্রেফতার হওয়া শাহিনও পেশায় চিকিৎসক। আদিল প্রথমে অনন্তনাগের সরকারি মেডিক্যাল কলেজে চাকরি করতেন। তার পর সহারনপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করার জন্য চলে আসেন। মুজ়াম্মিল গত তিন বছর ধরে আল ফালাহ স্কুল অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে সিনিয়র রেসিডেন্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
মুজ়াম্মিল যে হাসপাতালে কাজ করতেন সেখানকারই সহকর্মী মহিলা চিকিৎসক ছিলেন শাহিন। জানা যায়, তিনি মুজ়াম্মিলের সহযোগী ছিলেন। তাঁর গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার হয় একে-৪৭ রাইফেল। পরে লখনউ থেকে ওই মহিলা চিকিৎসককে গ্রেফতার করে পুলিশ। ফরিদাবাদে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন মুজ়াম্মিল। সেই বাড়িতেই ৩৬০ কেজি আরডিএক্সের মশলা উদ্ধার করে পুলিশ।
দুই সহযোগীর গ্রেফতারির পরেই কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন উমর। এমনটাই মনে করছেন তদন্তকারীরা। মুজ়াম্মিল এবং আদিলের গ্রেফতারির পরে তিনি ভয়ে ফরিদাবাদ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন।
সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫২ মিনিটে একটি ছোট গাড়ি গতি কমিয়ে লালকেল্লার কাছে সুভাষ মার্গ সিগনালে দাঁড়ায়। তখনই আচমকা বিস্ফোরণ ঘটে ওই গাড়িতে। সংবাদমাধ্যমের একাংশের দাবি, দিল্লিতে লালকেল্লার কাছে গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনায় সিসি ক্যামেরায় প্রকাশ্যে আসা ফুটেজে দেখা গিয়েছে উমর নামের ওই চিকিৎসককেই।
যদিও দিল্লি পুলিশ বা অন্য কোনও তদন্তকারী সংস্থা এ বিষয়ে সরকারি ভাবে কোনও মন্তব্য এখনও পর্যন্ত করেনি। বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন রয়েছে হরিয়ানার জনৈক মহম্মদ সলমনের নামে। তাঁকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে পুলিশ।
একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ওই গাড়িটির বর্তমান ‘মালিক’ পুলওয়ামার চিকিৎসক উমর মহম্মদ। গাড়িটিকে ঘণ্টা তিনেক এক ভাবে লালকেল্লার কাছে পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। ওই সময়ে গাড়িচালককে এক বারও গাড়ি থেকে নামতে দেখা যায়নি বলে পুলিশের একটি সূত্রের দাবি। এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে দিল্লি পুলিশ।
সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ গাড়িটির মালিকানার রেকর্ড খুঁজে বার করে। গাড়িটি সলমনের নামে নিবন্ধিত বলে জানা যায়। পুলিশ সলমনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি জানান, দেবেন্দ্র নামে এক জনের কাছে গাড়িটি তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। পরে, সেটি হাতবদল করে আমিরের কাছে চলে যায়। তিনি সেটি তারিককে হস্তান্তর করেন। তারিকের কাছ থেকে গাড়িটি উমর মহম্মদের হাতে আসে। গাড়ির নথিপত্রে বদল ঘটেনি বলে সলমন পুলিশকে জানিয়েছেন।
তদন্তে উঠে এসেছে, চিকিৎসকদের মতো উচ্চশিক্ষিত পেশাদার ব্যক্তিদের শনাক্ত করে দল ভারী করে তুলতে সক্রিয় বিশেষ সংগঠনটি। জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ সোমবার জানিয়েছে, ‘হোয়াইট কলার’ গোষ্ঠীটি প্রশিক্ষণ, সমন্বয়, আর্থিক লেনদেন এবং তা সরবরাহের জন্য এনক্রিপ্ট করা চ্যানেল ব্যবহার করেছিল।
সামাজিক ও দাতব্য কাজের আড়ালে পেশাদার এবং শিক্ষাবিদদের ‘নেটওয়ার্কের’ মাধ্যমে তহবিল জোগাড় করেছিল তারা। সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই মডিউলটির সঙ্গে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদের যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ গত ২৬ দিন ধরে এই মডিউলটির উপর নজর রাখছিল।