ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন দম্পতি। তবুও এক ছাদের তলায় থাকতে কোনও অসুবিধা হয় না। সুখে-শান্তিতে ভরে থাকে তাঁদের জীবন। সন্তান-সন্ততি নিয়ে ভরপুর সংসার নিয়ে সুখে জীবনযাপন করেন গ্রামের দম্পতিরা। কিন্তু বংশপরম্পরায় এক অদ্ভুত শর্তে বাঁধা রয়েছেন গ্রামবাসীরা।
নাইজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বে উবাং নামে একটি গ্রাম রয়েছে। সেই গ্রামের জনসংখ্যা সাড়ে তিন হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজারের কাছাকাছি। উবাং গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে স্ত্রী এবং পুরুষেরা ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন।
নাইজেরিয়ার উবাং গ্রামের বাসিন্দারা উবাং ভাষায় কথা বলেন। ২০১৩ সালের গণনা অনুযায়ী, উবাং ভাষাভাষী লোকের সংখ্যা ১১ হাজারের কাছাকাছি। এক অদ্ভুত শর্ত মেনে চলেন গ্রামবাসীরা।
গ্রামের স্ত্রী এবং পুরুষেরা ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন। প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার্য জিনিসপত্রগুলিকে ভিন্ন শব্দে সম্বোধন করেন স্ত্রী এবং পুরুষেরা। যেমন, জলকে পুরুষেরা ‘বামুইয়ে’ বলে ডাকেন। আবার স্ত্রীরা ‘আমু’ বলেন।
অন্য দিকে, জামাকাপড়কে ‘নাকি’ বলেন পুরুষেরা। কিন্তু একই জিনিসকে ‘আরিগা’ বলে উল্লেখ করেন মহিলারা। গাছকে পুরুষেরা ‘কিচি’ বলে ডাকেন এবং মহিলারা ডাকেন ‘ওকওয়েং’ নামে।
একই গোষ্ঠীর স্ত্রী এবং পুরুষ জাতির ভাষা ভিন্ন হওয়ার আসল কারণ অবশ্য সঠিক ভাবে জানেন না গ্রামবাসীরাও। যুগ যুগ ধরে নাকি এই প্রথাই চলে এসেছে তাঁদের গ্রামে।
গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, আদম এবং ইভ নাকি ভিন্ন ভাষায় কথা বলত। সেই ধারণা থেকেই গ্রামের স্ত্রী এবং পুরুষ জাতি আলাদা ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু গ্রামের সকলেই একে অপরের ভাষা সম্পর্কে অবগত।
সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর সেই গ্রামের মহিলাদের কাছেই তাদের রাখা হয়। প্রায় পাঁচ থেকে ছ’বছর পর্যন্ত গ্রামের শিশুরা মহিলাদের সংস্পর্শে থাকে। ফলে, জন্ম থেকেই মহিলাদের ভাষা শিখতে শুরু করে শিশুরা।
ছেলেদের বয়স যত বাড়তে থাকে, তত তাদের মহিলাদের কাছ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রথা অনুযায়ী বালক বয়সে পা দেওয়া থেকেই গ্রামের পুরুষদের সঙ্গে সময় কাটাতে হয় ছেলেদের। তখন তাদের পরিচিতি ঘটে নতুন ভাষার সঙ্গে।
গ্রামের কন্যাসন্তানেরা যে হেতু আজীবন মহিলাদের সঙ্গে সময় কাটায় তাই তাদের ভাষার কোনও বদল হয় না। তারা ছোট থেকে একই ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
গ্রামের পুত্রসন্তানেরা পুরুষদের ভাষা শিখে রপ্ত করে ফেলে। অন্য দিকে, স্ত্রীজাতির ভাষাও ভুলে যায় না তারা। গ্রামের নিয়ম মেনে ১০ বছর বয়সের মধ্যে সেখানকার বালকদের এমন ভাবেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যে, তারা পুরোপুরি ভাবে পুরুষদের ভাষায় কথা বলতে শুরু করে দেয়।
যে হেতু ব্যাকরণগত ভাবে স্ত্রী এবং পুরুষ জাতির ভাষার মধ্যে গুরুতর বৈসাদৃশ্য নেই, তাই পুরুষদের ভাষাও বোঝেন গ্রামের মহিলারা। ফলে এক ছাদের তলায় থেকে ভাষা ভিন্ন বললেও কোনও সমস্যা হয় না তাঁদের।
গ্রামবাসীদের অনেকে আবার মনে করেন, আদম এবং ইভের কাহিনি লোকমুখে চলে আসছে ঠিকই, তবে তা অনেকটা মনভোলানো গল্পের মতোই। সেই কাহিনি বর্তমানে অনেকেই যুক্তিহীন বলে মনে করেন।
উবাং গ্রামকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নাকি ভিন্ন ভাষায় কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পূর্বপুরুষেরা। একই জিনিসকে ভিন্ন নামে ডাকলে শত্রুরা ধন্দে পড়ে যেতে পারেন বলে কল্পনা করেছিলেন তাঁরা।
আবার ভিন্ন ভাষায় কথা বলার নেপথ্যে একটি ঘরোয়া কারণও রয়েছে। তবে তা নেহাতই ঠাট্টা-তামাশায় বলে থাকেন গ্রামবাসীরা। গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, ভিন্ন ভাষায় কথা বললে অনেক সময় কলহ এড়ানো যায়। সংসারে সুখ-শান্তি বজায় রাখার জন্য নাকি এই পন্থা অবলম্বন করা হয়।
তবে উবাং ভাষাভাষীর লোক যে ক্রমাগত কমে আসছে তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গ্রামবাসীরা। আধুনিক প্রজন্মের অনেকেই নাকি স্থানীয় ভাষা বিসর্জন দিয়ে আন্তর্জাতিক ভাষা আপন করার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। তবুও গ্রামবাসীরা সেই ভাষাকে অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।