ভারতের ভাগ্যবদলে ‘নীল অর্থনীতি’তে (ব্লু ইকোনমি) জোর! আর তাই ৫০-এ পা দেওয়া একটি বন্দরকে সামনে রেখে নতুন স্বপ্ন দেখছে কেন্দ্র। ২০৪৭ সালের মধ্যে ৩০ লক্ষ কোটি টাকার অর্থনীতিতে পৌঁছোনোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে নয়াদিল্লি। সেই লক্ষ্যপূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে ওই বন্দর। সে কথা মাথায় রেখে এর জন্মদিনে একসঙ্গে আটটি প্রকল্পের সূচনা করলেন নরেন্দ্র মোদী সরকারের জাহাজ চলাচল এবং জলপথমন্ত্রী সর্বানন্দ সোণোয়াল।
কংগ্রেসশাসিত কর্নাটকের মেঙ্গালুরু সমুদ্রবন্দর। এর পথচলা শুরু হয় ১৯৭৫ সালে। বর্তমানে ওই বন্দর দিয়ে বছরে ৪ কোটি ৬০ লক্ষ ১০ হাজার টন পণ্য আমদানি-রফতানি করে ভারত। এর একটি নতুন কমপ্লেক্স রয়েছে, যা পরিচালনার দায়িত্বভার আছে ‘নিউ মেঙ্গালুরু পোর্ট অথরিটি’ বা এনএমপিএর কাঁধে। সংশ্লিষ্ট বন্দরটির সুবর্ণজয়ন্তীতে একে আরও আধুনিক করতে কেন্দ্রের করা পদক্ষেপকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে মনে করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, প্রথম দিকে শুধুমাত্র কর্নাটকের উপকূলবর্তী এলাকার কিছু পণ্য বিদেশে রফতানি করত মেঙ্গালুরু বন্দর। কিন্তু, সময়ের চাকা ঘুরতেই পশ্চিম ভারতীয় সমুদ্রবাণিজ্যের অন্যতম ‘শক্তিকেন্দ্র’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ওই এলাকা। ফলে সংশ্লিষ্ট বন্দরটিকে নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চড়তে থাকে প্রত্যাশার পারদ। বিশ্লেষকদের দাবি, মেঙ্গালুরুতে আমদানি ও রফতানি সামগ্রীর পরিমাণ ৫ কোটি টন বা তার বেশিতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে প্রশাসনের।
চলতি বছরের ১৫ অক্টোবর মেঙ্গালুরু বন্দরের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করে এনএমপিএ। সেখানে হাজির থেকে একসঙ্গে আটটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সোণোয়াল। সংশ্লিষ্ট বন্দরটিকে ‘পশ্চিম ভারতের প্রবেশদ্বার’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। সেখানে তাঁর শুরু করা প্রকল্পগুলির মধ্যে প্রথমেই থাকছে গুদামঘর নির্মাণ এবং প্রযুক্তিগত পরিকাঠামোর উন্নয়ন।
মেঙ্গালুরু বন্দরের সুবর্ণজয়ন্তীতে ক্রুজ় টার্মিনালে একটি গেট উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সোণোয়াল। বন্দরটির উন্নতিতে যে স্টোরেজ শেড ও লজিস্টিক হাব তৈরি হবে, তার পণ্য মজুত রাখার ক্ষমতা ১৪ হাজার টন হতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে। পাশাপাশি সেখানে ১৫০ শয্যার একটি মাল্টি স্পেশালিটি বন্দর-হাসপাতাল তৈরি করবে কেন্দ্র। এর নির্মাণকাজ দু’ধাপে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
মেঙ্গালুরু বন্দরের উন্নতিকল্পে পর্যটনকে গুরুত্ব দিচ্ছে কেন্দ্র। সেই মোতাবেক পরিকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে ছাড়পত্র দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি পণ্যবাহী লরি ও ট্রাক টার্মিনাল সম্প্রসারণ করার কথাও ঘোষণা করেছেন মোদী মন্ত্রিসভার সদস্য সর্বানন্দ। তাঁর কথায়, ‘‘স্টোরেজ শেড এবং লজিস্টিক হাবের হাত ধরে ভোল বদলাবে এই বন্দরের। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিদেশের বাজারে নিয়ে যাওয়া অনেক সহজ হবে।’’
সূত্রের খবর, একাধিক কম্পার্টমেন্টে বিভক্ত ওই লজিস্টিক হাবে থাকবে খাদ্যদ্রব্য, সার, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মতো পণ্যকে মজুত রাখার সুব্যবস্থা। অন্য দিকে বিদেশি পর্যটকদের টানতে ক্রুজ় টার্মিনালটিকে সাজাবেন মেঙ্গালুরু বন্দর কর্তৃপক্ষ। ওই টার্মিনাল থেকে প্রমোদতরীতে পশ্চিম ভারতীয় উপকূলরেখা ধরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে পারবেন ভ্রমণপিপাসুরা।
মেঙ্গালুরু বন্দরের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সেখানে ‘রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি আইডেনটিফিকেশন’ বা আরএফআইডি প্রযুক্তি ব্যবহার করবে কেন্দ্র। এর মাধ্যমে পণ্যবাহী জাহাজগুলির উপর সহজে নজরদারি করতে পারবেন আইনরক্ষকরা। মিলবে রিয়েল টাইম তথ্য। সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বন্দরটিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআইএসএফের (সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স) ব্যারাক ও দফতর সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদী সরকার।
সোণোয়ালের উদ্বোধন করা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে মেঙ্গালুরু বন্দরে পণ্য বোঝাই ট্রাকের সংখ্যা দৈনিক ৫০ থেকে ৮০টি বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী বন্দর সংলগ্ন রাস্তা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। এই কাজ রাজ্য সরকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে হওয়ার কথা রয়েছে। বর্ষাকালে বন্দরের ভিতরে এবং আশপাশের এলাকা জলমগ্ন হওয়ার জন্য যাতে পণ্যের কোনও লোকসান না হয়, সে দিকেও নজর রাখবে প্রশাসন।
সম্প্রসারণের পর ট্রাক এবং লরি পার্কিং এলাকাটি ২০ হাজার বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে গড়ে উঠবে বলে জানা গিয়েছে। ফলে সেখানে একসঙ্গে ১৮০-২০০টি ট্রাক রাখা যাবে। পাশাপাশি পণ্যবাহী গাড়িগুলির চালকদের খাবার এবং বিশ্রাম নেওয়ার সুব্যবস্থা ওই এলাকায় তৈরি করবে কেন্দ্র।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে মেঙ্গালুরু বন্দর দিয়ে বিদেশে পাঠানো পণ্যের ৩৫ শতাংশই হল পেট্রোলিয়াম সামগ্রী। বাকি পণ্যের মধ্যে লোহা-ইস্পাতের অঙ্ক ২২ শতাংশ এবং অন্যান্য সামগ্রী ১৮ শতাংশ। সার এবং কয়লাও এই বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি করা হয়। এর সম্প্রসারণের কাজ শেষ হলে পণ্যের ক্ষেত্রে বৈচিত্র যে বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
এনএমপিএ জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে এই বন্দরকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক ১২ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে। ফলে সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে ২৫ হাজার জনের। এ ছাড়া অপ্রত্যক্ষ ভাবে কাজ পেয়েছেন ৭৫ হাজার জন। কর্নাটকের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপিতে (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) আড়াই হাজার কোটি টাকার অবদান রয়েছে এই মেঙ্গালুরু বন্দরের।
সোণোয়াল জানিয়েছেন, ‘সবুজ সামুদ্রিক অ্যাজেন্ডা’র মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন করবে সরকার। কারণ, বন্দর সম্প্রসারণ এবং পরিকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের দিকেও নজর রাখাও অত্যন্ত জরুরি। আর তাই ‘হরিৎ সাগর নির্দেশিকা’ মেনে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন দিয়েছেন তিনি। এতে আছে ‘হরিৎ নৌকা প্রকল্প’ এবং গ্রিন করিডর।
বর্তমানে মেঙ্গালুরু বন্দরে যে জাহাজ বা জলযানগুলি ভিড়ছে, সেগুলি মূলত ডিজেলচালিত। ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়া বদলাবে কেন্দ্র। আগামী দিনে বিদ্যুৎ বা তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএমজি (লিকুইড ন্যাচরাল গ্যাস) চালিত জলযান ভিড়বে কর্নাটকের ওই বন্দরে। এ ভাবে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কয়েক গুণ কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাহাজ মন্ত্রক।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেছেন, ‘‘২০২৭ সালের মধ্যে মেঙ্গালুরু বন্দরের প্রায় পুরোটা সবুজ শক্তি দ্বারা পরিচালনা করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেই কারণে পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির (পড়ুন সৌর শক্তি) উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। বর্জ্য এবং পয়ঃনিষ্ক্রমণ একটা সমস্যা। এতে বন্দর সংলগ্ন এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়ে ওঠে। সেটা ঠেকাতে ‘রিসাইক্লেনিং প্ল্যান্ট’ গড়ে তোলা হবে।’’
‘নীল অর্থনীতি’কে মজবুত করতে ইতিমধ্যেই সাগরমালা প্রকল্প গ্রহণ করেছে কেন্দ্র। এর আওতায় রয়েছে ৮৪০টি উন্নয়নমূলক কর্মসূচি। এর জন্য ৫.৮ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করবে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। সাগরমালার মাধ্যমে বন্দরগুলির পাশাপাশি ‘এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জ়োন’-এর সম্পদ আহরণের দিকেও নজর রয়েছে নয়াদিল্লির।
চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর ‘ভারতের নীল অর্থনীতি: গভীর সমুদ্র ও উপকূলীয় মৎস্যসম্পদ ব্যবহার বৃদ্ধির কৌশল’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন নীতি আয়োগের চিফ এক্জ়িকিউটিভ অফিসার (সিইও) বিভিআর সুব্রহ্মণ্যম। সেখানে মৎস্যসম্পদ কী ভাবে এ দেশের অর্থনীতির রং বদলাতে পারে, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি রয়েছে পরিকাঠামোগত উন্নতি সংক্রান্ত একাধিক পরামর্শ।
নীতি আয়োগের রিপোর্ট অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় মৎস্যজীবীরা মূলত নদী, খাল, ভেড়ি, পুকুর বা দিঘির মতো বড় জলাশয় থেকে মাছ শিকার করে অর্থ উপার্জন করে এসেছেন। এ ছাড়া সামুদ্রিক মৎস্যশিকার উপকূল থেকে মাত্র ১২ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ২৩ কিলোমিটার) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। সিইও বিভিআর সুব্রহ্মণ্যমের দাবি, ‘নীল অর্থনীতি’র সুফল পেতে হলে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জ়োন বা ইইজ়েডে ঢুকতে হবে ভারতীয় মৎস্যজীবীদের। কিন্তু সেই পরিকাঠামোর যে অভাব রয়েছে, তা মেনে নিয়েছেন তিনি।
উল্লেখ্য, গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারের জন্য বিশেষ ধরনের জলযানের প্রয়োজন। এর পোশাকি নাম ‘ডিপ সি ভেসেল’। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার কাছে এই ধরনের নৌকা রয়েছে ১,৮৮৩টি। অন্য দিকে ১,২১৬টি ‘ডিপ সি ভেসেল’ ব্যবহার করেন ইরানের মৎস্যজীবীরা। সেখানে ভারতের কাছে সংশ্লিষ্ট জলযানের সংখ্যা মাত্র চার। বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইইজ়েড থেকে রফতানির জন্য প্রয়োজনীয় মাছ শিকারের পক্ষে এই পরিকাঠামো যে অপ্রতুল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
‘নীল অর্থনীতি’তে ভারতের উন্নতির সুযোগের নেপথ্যে রয়েছে এ দেশের ১,১৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা। সেটা ন’টি রাজ্য এবং চারটি কেন্দ্রশাসিত এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। আর তাই এতে বিশ্বনেতা হয়ে ওঠার ক্ষমতা রয়েছে ভারতের। কেন্দ্রীয় জাহাজমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ দেশে নাবিকের সংখ্যা ১৫২ শতাংশ এবং জলপথে পণ্য পরিবহণ ক্ষমতা ৪০৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। জাহাজ পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নয়াদিল্লি।