ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফরের চুলচেরা বিশ্লেষণে মত্ত আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। দু’দিনের জন্য এসে সম্পর্ককে আরও মজবুত করতে নয়াদিল্লির হাতে কী কী ‘কৌশলগত উপহার’ তুলে দিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট? তিনি দেশে ফিরতেই এই নিয়ে কূটনৈতিক মহলে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে বার বার খবরের শিরোনামে এসেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পর্যায়ের ‘বন্ধুত্ব’। প্রায় আড়াই দশক আগে মস্কো সফরে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্বয়ং মোদী।
সালটা ২০০১। ভারত-রুশ সম্পর্ককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সে বছর মস্কো সফর করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। তাঁর সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে যান সদ্য গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়া মোদী। তখনই পুতিনের সঙ্গে প্রথম বার সাক্ষাৎ হয় তাঁর। রুশ প্রেসিডেন্ট দিল্লিতে পা দিতেই আর্কাইভে পড়ে থাকা সেই ছবি নতুন করে সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। স্মৃতি হাতড়ে এই বিষয়ে বিবৃতি দিতে দেরি করেননি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
২৪ বছর আগে মস্কো সফরকালে পুতিনের সঙ্গে বার দুয়েক একই ফ্রেমে ধরা পড়েন মোদী। একটি ছবিতে বাজপেয়ী এবং রুশ প্রেসিডেন্টকে পাশাপাশি চেয়ারে বসে থাকতে দেখা গিয়েছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর উত্তরসূরি। দ্বিতীয় ছবিতে দুই রাষ্ট্রনেতার পাশে বসে একটি সরকারি নথিতে মোদীকে সই করতে দেখা গিয়েছে। গত বছর (পড়ুন ২০২৪) মোদীর রাশিয়া সফরের সময়েও সংশ্লিষ্ট ছবিগুলি সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল।
পরে ওই ঘটনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘২০০১ সালে আমি ছিলাম রাজ্য স্তরের নেতা, সামান্য একজন মুখ্যমন্ত্রী। দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যা কখনওই তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রেসিডেন্ট পুতিন কিন্তু এ সব কিছুর পরোয়া করেননি। আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান তিনি। তাঁর আচরণ ছিল অমায়িক এবং অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ।’’ ফলে পরবর্তী কালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে, সম্পর্ককে ব্যক্তিগত স্তরে নিয়ে যেতে তাঁদের যে কোনও অসুবিধা হয়নি, তা বলাই বাহুল্য।
মোদী জানিয়েছেন, ২০০১ সালের সফরেও ভারতীয় প্রতিনিধিমণ্ডলের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় অংশ নেন পুতিন। সে বছর গুজরাত এবং রাশিয়ার আস্ট্রাকান এলাকার মধ্যে একটি বিশেষ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তাতে পেট্রোকেমিক্যাল, হাইড্রোকার্বন, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শিক্ষা, পর্যটন এবং সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন বৃদ্ধির কথা বলা ছিল। সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটিকে কেন্দ্র করে রুশ প্রেসিডেন্টের কাছে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেননি তৎকালীন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বাজপেয়ীর সঙ্গে সেটাই ছিল মোদীর প্রথম বিদেশ সফর। ২০০৬ সালে ফের রুশ সফরে গিয়ে আস্ট্রাকানের গভর্নর আলেকজ়ান্ডার ঝিলকিনের সঙ্গে পূর্বের চুক্তিটির মেয়াদ বৃদ্ধি করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। ফলে জ্বালানি ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও মজবুত হয় গুজরাত ও মস্কোর গাঁটছড়া। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ক্রেমলিন তথা ‘বন্ধু’ পুতিনকে পাশে পেতে তা তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
বিশেষজ্ঞদের কথায়, সেই জন্যই রুশ প্রেসিডেন্টের প্রসঙ্গ উঠলে বার বার ২০০১ সালের সফরের কথা স্মরণ করেন মোদী। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে চলতি বছরে ‘বন্ধু’ পুতিনের ভারত সফরে একাধিক বার প্রোটোকল ভেঙেছেন তিনি। বর্তমান জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
গত ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে পৌঁছোন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। তাঁকে স্বাগত জানাতে দিল্লির পালমে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হাজির ছিলেন মোদী। রানওয়েতে দাঁড়িয়েই করমর্দনের পরে পুতিনকে আলিঙ্গন করে নয়াদিল্লি-মস্কোর মৈত্রীর বার্তা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তার পর একই গাড়িতে রওনা হন তাঁরা।
সাধারণ প্রোটোকল অনুযায়ী কোনও বিদেশি রাষ্ট্রনেতা ভারত সফরে এলে তাঁকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে হাজির থাকেন বিদেশমন্ত্রী বা বিদেশ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী। কখনও বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য কোনও মন্ত্রী। ‘বন্ধু’ পুতিনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সেই প্রোটোকল ভাঙতে দেখা গিয়েছে। এর আগে আরও দুই রাষ্ট্রনেতার ক্ষেত্রে একই ধরনের পদক্ষেপ করেছেন মোদী। তাঁরা হলেন, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
পুতিনকে নিয়ে একই গাড়িতে যাওয়ার সময়ে দ্বিতীয় বার প্রোটোকল ভাঙেন মোদী। সাধারণত উচ্চ নিরাপত্তাবিশিষ্ট একটি রেঞ্জ রোভার ব্যবহার করেন এ দেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু রুশ প্রেসিডেন্ট আসার পর সেই গাড়িতে না গিয়ে একটি সাদা টয়োটা ফরচুনারে চেপে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে রওনা দেন তিনি। তাঁর সঙ্গে একই গাড়িতে ছিলেন ক্রেমলিনের সর্বময় কর্তা।
গত ৫ ডিসেম্বর দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে ২৩তম ভারত-রাশিয়া শীর্ষবৈঠকে যোগ দেন মোদী ও পুতিন। সেখানে রুশ প্রেসিডেন্টের পাশে দাঁড়িয়ে মোদী বলেন, ‘‘আমরা নিরপেক্ষ নই, তবে আমরা শান্তির পক্ষে রয়েছি।’’ তিন বছর আগে উজ়বেকিস্তানে ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন’ বা এসসিওর পার্শ্ববৈঠকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ‘বন্ধু’ পুতিনকে সতর্ক করেন মোদী। বলেন, ‘‘এটা যুদ্ধের সময় নয়।’’
অন্য দিকে ওই অনুষ্ঠানে অপরিশোধিত খনিজ তেল নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন রুশ প্রেসিডেন্ট। পুতিন বলেছেন, ‘‘ভারতকে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে প্রস্তুত মস্কো। দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করার লক্ষ্যে অনেক চুক্তি স্বাক্ষর করছি আমরা।’’
রাশিয়ার থেকে সস্তা দরে অপরিশোধিত খনিজ তেল কেনার জন্য ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সম্প্রতি এ বিষয়ে বিস্ফোরক দাবি করেন তিনি। ট্রাম্পের যুক্তি, তাঁর হুমকির জেরে মস্কো থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানি হ্রাস করেছে নয়াদিল্লি। এই পরিস্থিতিতে পাশাপাশি বসে মোদী-পুতিনের দেওয়া বার্তাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
জ্বালানির পাশাপাশি ২০৩০ সাল পর্যন্ত দু’দেশের মধ্যে কৌশলগত অর্থনৈতিক বিস্তারে মোদী ও পুতিন সম্মত হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। হায়দরাবাদ হাউসে এই নিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ বৈঠক করেন তাঁরা। আলোচনা শেষে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে বিষয়টি উল্লেখ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এতে আর্থিক দিক থেকে দুই দেশই লাভবান হবে বলে স্পষ্ট করেছেন কূটনীতিদের একাংশ।
যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে পুতিনকে পাশে নিয়ে মোদী বলেন, ‘‘আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি আমরা শীঘ্রই বিনামূল্যে ৩০ দিনের ই-ট্যুরিস্ট ভিসা এবং গ্রুপ ট্যুরিস্ট ভিসা চালু করব। উভয় দেশের জনগণের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করবে।’’ প্রধানমন্ত্রী আরও জানান, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে নয়াদিল্লি ও মস্কো।
ওই অনুষ্ঠানেও ২০০১ সালের সফর এবং পুতিনের সঙ্গে দীর্ঘ ২৫ বছরের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন মোদী। বলেন, ‘‘আমার কাছে এটা আনন্দের যে আপনার সঙ্গে দীর্ঘ আড়াই দশকের নিরবচ্ছিন্ন বন্ধুত্ব রয়ে গিয়েছে।’’ ২০০০ সালে পুতিন তাঁর ভারত সফরের সময় দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত অংশীদারির নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন বলেও জানিয়েছেন মোদী।