একসঙ্গে ফাটানো হবে ২৫০ পরমাণু বোমা! তবে কোনও শত্রু দেশে নয়। ঘরের মাটিতেই বিপজ্জনক বিস্ফোরণের ছক কষেছিল রাশিয়া। এ হেন ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার নেপথ্যে ছিল কোনও ষড়যন্ত্র? দেশের বিপুল সংখ্যক নিরীহ জনতাকে কেন খুন করতে চেয়েছিল মস্কো? ক্রেমলিনের ওই সিদ্ধান্তে বাধ সাধেন কে বা কারা?
গত শতাব্দীর ষাটের দশক। কমিউনিস্ট রাশিয়াকে তখন গোটা বিশ্ব চেনে সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসাবে। পূর্ব ইউরোপ থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত ছিল তার বিস্তার। এর ফলে কাস্পিয়ান সাগরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পান মস্কোর রাজনৈতিক নেতৃত্ব। প্রাকৃতিক হ্রদটির সঙ্গে জলপথে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য এক মারাত্মক পরিকল্পনা করে ফেলেন তাঁরা।
সাবেক সোভিয়েত নেতারা চেয়েছিলেন উত্তর রাশিয়ার পেচোরা নদীর অববাহিকাকে ভল্গার উপনদী কামার অববাহিকার সঙ্গে যুক্ত করতে। এর মাধ্যমে পেচোরা ও ভলগার জলপথকে একীভূত করা যেত। পরে জল পরিবহণকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন তাঁরা। মস্কোর নির্দেশ পেয়ে সেই মতো কোমর বেঁধে লেগে পড়েন সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা।
সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে দিনের আলো দেখাতে একটি বিশাল খাল কাটার সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন রুশ গবেষকেরা। এর জন্য পর পর ২৫০টি পরমাণু বিস্ফোরণের কথা বলেন তাঁরা। এই পদ্ধতিতে খালটিকে তৈরি করা গেলে এক সূত্রে বাঁধা পড়ত কাস্পিয়ান সাগর, ভল্গা এবং পেচোরা নদী। এ কথা ক্রেমলিনের কর্তাদের বোঝাতে সক্ষম হন তাঁরা।
পেচোরা এবং ভল্গার উপনদী কামার মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিল না, তা ভাবলে ভুল হবে। ১৯৩৩ সালের নভেম্বরে ‘ভল্গা এবং তার অববাহিকা পুনর্গঠন’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেন সোভিয়েত নেতারা। এর মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন এবং জলবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা ছিল রুশ বৈজ্ঞানিকদের। প্রকল্পটির নেতৃত্বে ছিলেন সের্গেই ইয়াকোলেভিচ ঝুক নামের এক ইঞ্জিনিয়ার।
কিন্তু, ওই সময়ে ইউরোপের রাজনীতি দ্রুত বদলাচ্ছিল। জার্মানিতে তখন ক্ষমতা দখল করেছেন অ্যাডল্ফ হিটলার। আর ইতালির কুর্সিতে বেনিতো মুসোলিনি। দুই সাম্রাজ্যবাদী নেতার উত্থানে প্রমাদ গোনে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফলে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করতে থাকে মস্কো। অন্য দিকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা ঘরে চলে যায় ‘ভল্গা অববাহিকা পুনর্গঠন’ প্রকল্পের কাজ।
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪১ সালের ২২ জুন হিটলার অনাক্রমণ চুক্তি ভেঙে রাশিয়া আক্রমণ করলে সম্পূর্ণ ঘুরে যায় লড়াইয়ের অভিমুখ। এর জেরে একরকম বাধ্য হয়েই লড়াইয়ে জড়াতে হয় মস্কোকে। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি নিয়ে ফের আলোচনায় বসেন রুশ বৈজ্ঞানিকেরা। তখনই কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত খাল খননের নীল নকশা ছকে ফেলেন তাঁরা।
১৯৬১ সালে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের ছাড়পত্র দেন সোভিয়েত নেতারা। এর পোশাকি নাম ছিল ‘নর্থ রিভার রিভার্সাল’। এর মাধ্যমে উত্তরের নদীর জল বিপরীত মুখে বইয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন রুশ গবেষকেরা। মস্কোর গদিতে তখন নিকিতা সর্গেইভিচ ক্রুশ্চেভ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার বিরুদ্ধে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ (পড়ুন কোল্ড ওয়ার) নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি।
‘নর্থ রিভার রিভার্সাল’-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ চেরডিনস্কি জেলার ভাসিউকোভো গ্রামের কাছে তিনটি ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণ ঘটান রুশ গবেষকেরা। এগুলির প্রতিটি ছিল ১৫ কিলোটন ক্ষমতা সম্পন্ন। বিস্ফোরণের জেরে ৭০০ মিটার লম্বা এবং ৩৮০ মিটার চাওড়া খালের মতো জায়গা তৈরি হয়। এই মিশনের নাম ‘টাইগা’ রেখেছিলেন তাঁরা।
পরমাণু বিস্ফোরণে তৈরি খালের আকার দেখে প্রাথমিক ভাবে খুশিই হন সোভিয়েত গবেষক এবং ইঞ্জিনিয়ারেরা। তাঁরা পরবর্তী পর্যায়ের বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কিন্তু, তত দিনে ওই খালের মতো অংশ থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শুরু হয়ে গিয়েছে। সেটা শুধু রাশিয়ার মধ্যেই থেমে ছিল না। বিকিরণের প্রভাব আশপাশের দেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মস্কোর বিরুদ্ধে তৈরি হয় প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ।
আশির দশক আসতে আসতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে মার্কিন প্রভাব কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এককাট্টা হতে থাকে তারা। এই অবস্থায় বাধ্য হয়ে ১৯৮৬ সালে এই প্রকল্প পুরোপুরি বাতিল করে দেয় মস্কো। তবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের অভিযোগ কখনওই সরাসরি স্বীকার করেনি ক্রেমলিন।
বিশ্লেষকদের দাবি, রুশ বৈজ্ঞানিকদের খাল কাটার পরিকল্পনা খারাপ ছিল না। কারণ, কাস্পিয়ান সাগর তখন থেকেই ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হচ্ছিল। মস্কো সেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় আটকাতে চেয়েছিল। কিন্তু, তা করতে গিয়ে অন্য বিপদ ডেকে আনেন তাঁরা।
তবে এই ঘটনার অন্য যুক্তিও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, সব জেনে বুঝেই একসঙ্গে তিনটি পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন মস্কোর বৈজ্ঞানিক ও ইঞ্জিনিয়ারেরা। কারণ, ৬০ ও ৭০-এর দশকে ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ তীব্র হয়েছিল। আর তাই এই প্রকল্পের মাধ্যমে ক্রুশ্চেভ সোভিয়েতের ক্ষমতা জাহির করতে চেয়েছিলেন।
কেউ কেউ এটাও মনে করেন, তিনটি পরমাণু বিস্ফোরণের পর তৈরি হওয়া খাল আকৃতির গর্ত দেখে মোটেই খুশি হননি রুশ বৈজ্ঞানিক ও গবেষকেরা। অচিরেই তাঁরা বুঝে যান, এ ভাবে বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত খাল কাটা অসম্ভব। সেই কারণে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।
সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাতিলের পাঁচ বছরের মাথায় ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফলে রাশিয়া-সহ মোট ১৫টি দেশ তৈরি হয়েছিল। সোভিয়েতের পতনে কাস্পিয়ান সাগরের দখল হাতছাড়া হয় মস্কোর। ফলে ওই হ্রদ পর্যন্ত খাল তৈরির প্রয়োজনীয়তা আর অনুভব করেননি পরবর্তীকালের রুশ রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
‘মিশন টাইগা’র সব কিছুই যে খারাপ ছিল, তা কিন্তু নয়। এর জেরে ওই এলাকায় স্বল্প পরিমাণে কোবাল্ট পাওয়া গিয়েছিল। এর তেজস্ক্রিয় বিকিরণের থেকে বিপুল পরিমাণে এলাকাবাসীর মৃত্যু হয়েছিল, তা কিন্তু নয়। এর জেরে প্রতিবেশী দেশগুলিরও তেমন লোকসান হয়নি।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি বন্ধ হওয়ার বছরেই (পড়ুন ১৯৮৬) ইউক্রেনের চেরনোবিল পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে হওয়া বিপর্যয়ে আক্রান্ত হন ৩ লক্ষ ৪০ হাজার জন। ঘটনার সময়ে মৃত্যু হয় ৩১ জনের। ইউক্রেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ওই প্রকল্প বন্ধ করা হয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়।
খাল কাটার জন্য পর পর তিনটি ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণে যে গর্তটি তৈরি হয়, বর্তমানে সেটি পরমাণু হ্রদ হিসাবে বিখ্যাত। ওই এলাকায় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। তাই হ্রদের জলে স্নান করা, মাছ ধরা বা মাছ চাষের অনুমতি দেয় না রুশ সরকার।