আসন্ন মহাপ্রলয়ের দিনের জন্য তৈরি থাকছেন বিজ্ঞানীরা। আধুনিক সভ্যতার বাড়বাড়ন্তে ভবিষ্যতে খাদ্যসুরক্ষায় অভাব দেখা দিতে পারে। মূলত সেই আশঙ্কা থেকেই শস্যদানার বীজ সংরক্ষণের পথে হেঁটেছিলেন দুনিয়ার কিছু দূরদর্শী বিজ্ঞানী। সেই ‘ডুমস্ডে ভল্টের’ আদলে সুইৎজ়ারল্যান্ডে একটি ভান্ডার গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন জীববিজ্ঞানীরা।
ভবিষ্যতের বিপর্যয় এড়াতে সুইস গবেষকেরা মানুষের মল জমা করে রাখছেন ভল্টে। কোনও কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি বা উপন্যাসের শিরোনামের মতো শোনালেও এটি ঘোর বাস্তব। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে এই ভল্ট। প্রকল্পের লক্ষ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জীবাণু সংরক্ষণ।
ভল্টের পোশাকি নাম ‘মাইক্রোবায়োটা ভল্ট’। সেই ভান্ডারে ইতিমধ্যেই হাজার মানুষের মল হিমায়িত করে রাখা হয়েছে। আগামী পরিকল্পনা ২০২৯ সালের মধ্যে ১০ হাজার মানুষের মল ও বর্জ্যের নমুনা সংগ্রহ করা। মলের নমুনা সংরক্ষণকারী ‘ডুমস্ডে ভল্ট’টি বর্তমানে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করা হয়েছে।
‘নেচার কমিউনিকেশনসে’ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে মানুষের মলে কোটি কোটি জীবাণু থাকে। ক্ষুদ্র জীবাণু যা হজম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করতে চান যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই জীবাণুর গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গুলি যেন হারিয়ে না যায়।
ভবিষ্যতের চিকিৎসার জন্য এবং বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের সঙ্কটের মোকাবিলায় এই জীবাণুগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। মানববর্জ্যে কোটি কোটি জীবাণু রয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলায় এই জীবাণুর প্রয়োজন হলে সেগুলি সংরক্ষণ করতে চান বিজ্ঞানীরা।
দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হল মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ এবং পরিবেশে বসবাসকারী জীবাণুর সুরক্ষিত নমুনা সংরক্ষণ করে রাখা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গবেষণা চালাতে পারে। এই নমুনা থেকে জীবাণু খুঁজে বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রয়োজনে চিকিৎসার জন্য নতুন উদ্ভাবনী পদ্ধতি তৈরি করতে পারবেন বিজ্ঞানীরা।
মানুষের মলের পাশাপাশি, সংরক্ষণাগারে ২০০ ধরনের গেঁজে যাওয়া খাবারও রয়েছে। কারণ এগুলি মানুষ ও প্রাণীদের অন্ত্র-বান্ধব জীবাণু দ্বারা পরিপূর্ণ। ভল্টের দায়িত্বে থাকা গবেষকেরা তাঁদের সংগ্রহে পরিবেশগত জীবাণু যুক্ত করারও পরিকল্পনা করছেন। বিজ্ঞানীরা হিমাঙ্কের ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস নীচের তাপমাত্রায় সমস্ত নমুনা সংরক্ষিত করে রাখছেন।
গবেষকেরা ‘নেচার’-এর প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করেছেন যে, বহু জীবাণুই পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে যে কেবল মানুষের জন্যই বিপদ ঘনিয়ে আসছে এমনটা নয়, পরিবেশের জন্য বিপদঘণ্টা বেজে গিয়েছে বলে মনে করছেন জীববিদ্যা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা। মানবস্বাস্থ্য এবং কৃষি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে অ্যালার্জি, অটোইমিউন ব্যাধি এবং পরিবেশের স্থিতিস্থাপকতা প্রভাবিত হচ্ছে।
রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড মেডিসিনের পরিচালক এবং ‘নেচার’-এর প্রবন্ধটির সহ-লেখক মার্টিন ব্লেজ়ার জানিয়েছেন, মানুষের শরীর ও পরিবেশে থাকা মাইক্রোবায়োমগুলি হুমকির মুখে পড়েছে। মানুষের শরীরে থাকা জীবাণু, যেমন অন্ত্রের ভিতরের অণুজীবদের জিনগত উপাদান হল মানুষের মাইক্রোবায়োম।
শিল্প, চাষবাস, জলবায়ু পরিবর্তন, অ্যান্টিবায়োটিক, এমনকি আধুনিক খাদ্যাভ্যাসের মতো বিষয়গুলি বিশ্বব্যাপী জীবাণুর সমৃদ্ধি হ্রাস করছে। এই ক্ষতির সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অটোইমিউন রোগ থেকে শুরু করে বিপাকীয় ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে মানবজাতির মধ্যে।
একই কথা প্রযোজ্য ‘স্বোয়ালবার্ড গ্লোবাল সিড ভল্ট’ বা শস্যবীজের সংরক্ষণাগার ‘ডুমস্ডে ভল্ট’-এর ক্ষেত্রেও। মানব ইতিহাসের ১৩ হাজার বছরের কৃষিকাজের নমুনা জমা রাখা হয়েছে এখানে। খাদ্যসুরক্ষার অভাব দেখা দিলে এই জমানো শস্যভান্ডার খুলে দেওয়া হবে।
প্রযুক্তির উপর ভর করে ফসল ফলানোর কাজ শুরু হওয়ায় খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা আঘাত হেনেছে জীববৈচিত্রে। ১৯০০ সালের শুরুর দিক থেকে আজ পর্যন্ত ৯০ শতাংশের বেশি শাকসব্জি এবং ফলের প্রজাতি হারিয়ে গিয়েছে। ভবিষ্যতে কোনও সময় প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ বা অতিমারির প্রকোপে শস্যের প্রজাতিগুলি চিরতরে বিনষ্ট হয়ে গেলেও যাতে কৃষিকাজ চালিয়ে যাওয়া যায়, সেই চেষ্টাই করছেন বিজ্ঞানীরা।
আধুনিক কৃষিকাজের পদ্ধতি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পারমাফ্রস্ট গলে যাওয়ায় জীবাণুগুলি হারিয়ে যেতে বসেছে। এই পারমাফ্রস্ট হল একটি বিশেষ ভূমিরূপ, যা পাওয়া যায় উত্তর ও দক্ষিণ দুই মেরু-সহ বিশ্বের চিরশীতল অংশে। মাটি, পাথর এবং বালির কণাকে যখন বরফ একসঙ্গে জমাট বেঁধে ধরে রাখে, তখন সেটা পরিণত হয় পারমাফ্রস্টে।
মানবদেহে রোগের বাড়বাড়ন্ত রুখতে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার মাইক্রোবায়োমগুলির এতটাই ক্ষতি করছে যে ভবিষ্যতে তাদের উদ্ধারের প্রয়োজন হতে পারে।
‘মাইক্রোবায়োটা ভল্ট’টি ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী জীবাণুর নমুনা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের জন্য ব্রাজ়িল, ইথিয়োপিয়া, লাওস এবং ঘানার মতো দেশগুলি থেকে মানুষের মল আনা হয়। প্রকল্পটি আড়ে-বহরে বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে এই ভল্টটিকে স্থানান্তর করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
সুইৎজ়ারল্যান্ড বা কানাডার মতো শীতল বা বরফাবৃত কোনও স্বতন্ত্র স্থানে ভান্ডারটি স্থানান্তর করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেও খবরে প্রকাশ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ১০০ বছর পরে এই সংরক্ষিত জীবাণুগুলি দিয়ে বড় কোনও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।