আবার শিরোনামে ‘কলিযুগের যযাতি’। বয়স ধরে রাখার নানা কলাকৌশল বাতলে প্রায়ই নজর কাড়েন মার্কিন ধনকুবের ব্রায়ান জনসন। প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এবং দীর্ঘায়ুপ্রেমী ব্রায়ান, তাঁর বার্ধক্য-বিরোধী নানা পরিকল্পনা দুনিয়ার সামনে এনে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন।
যৌবনকে হাতের মুঠোয় রাখতে চাওয়া সেই ‘তরুণ’ এ বার প্রেমে পড়েছেন তাঁর থেকে ১৮ বছরের ছোট তরুণীর। নিজের নতুন প্রেমকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরেছেন ব্রায়ান। একটি আবেগঘন পোস্টে বান্ধবী কেট টোলোর সঙ্গে তিন বছরের সম্পর্কের কথা প্রকাশ করেছেন আমেরিকার এই উদ্যোগপতি।
বয়স কমানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার আড়ালে ‘বয়স কমানোর’ ওষুধের ব্যবসা চালাতেন ব্রায়ান। নাম ‘ব্লুপ্রিন্ট’। সেই সংস্থারই সহ-প্রতিষ্ঠাতা কেট। ৩ ডিসেম্বর একটি দীর্ঘ খোলামেলা পোস্টে তাঁর নতুন প্রেমের কাহিনি তুলে ধরেছেন ব্রায়ান। সেই প্রেম, যার জন্য দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে অপেক্ষা করে ছিলেন ‘বাস্তবের যযাতি’।
কেট বসনীয়-অস্ট্রেলীয়-আমেরিকান তরুণী। তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতাও সেই পোস্টে বর্ণনা করেছেন যৌবন ফিরে পেতে চাওয়া ব্রায়ান। তিনি লিখেছেন, “প্রথম যে বার কেটের মুখোমুখি হয়েছিলাম সে বার পেটের মধ্যে হাজার প্রজাপতির ওড়ার অনুভূতি ফিরে এসেছিল।” সারা জীবন এই অভিজ্ঞতার জন্যই নাকি মুখিয়ে ছিলেন ১৮ বছরের যুবক হতে চাওয়া ব্রায়ান।
নিউরোটেকনোলজির প্রতি ভালবাসাই নাকি তাঁদের আরও কাছে এনেছে। ব্রায়ান লিখেছেন, ‘‘কেটের যে গুণ আমায় সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তা হল ওর বিচক্ষণতা এবং চিন্তাভাবনার গভীরতা। সব দিক দেখেশুনে, বিচার করে সিদ্ধান্ত নেয় কেট। সেই তুলনায়, আমি পৃথিবী সম্পর্কে অদূরদর্শী, আমার সচেতনতার অভাব প্রকট।’’
কেটের মতো সঙ্গীই সারা জীবন মনে মনে চেয়েছিলেন ব্রায়ান। এই প্রেম জীবনে আসার জন্য ২৫ বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছেন তিনি। আর সেই সবুরে মেওয়া ফলেছে ধনকুবেরের জীবনে, যা পেয়েছেন তা কল্পনারও অতীত ছিল বলে সমাজমাধ্যমে খোলাখুলি জানিয়েছেন তিনি।
২০২১ সালে ব্রায়ান তাঁর দীর্ঘায়ু হওয়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংস্থা স্টার্টআপ ‘ব্লুপ্রিন্ট’ চালু করেন। কেটকে এই সংস্থার স্তম্ভ বলে অভিহিত করেছেন সংস্থার মালিক। এই জুটির প্রথম দেখা হয়েছিল তাঁর ‘ব্রেন ইন্টারফেস কোম্পানি’র জন্য কাজ করার সময়। সেই আলাপের পরই ব্রায়ান বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের সংযোগ হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে।
কেটের প্রতি আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও, ব্রায়ান তাঁদের সম্পর্ক তত দিন পেশাদারিত্বের পরিসরে আটকে রেখে দিয়েছিলেন, যত দিন না তাঁরা দু’জনেই অনুভব করেছিলেন যে অনুভূতিটি পারস্পরিক। তিন বছর ধরে তাঁরা প্রেমের সম্পর্কের কথা ঘোষণা করেননি। দেড় বছর মেলামেশার পর একে অপরের কাছে তাঁদের অব্যক্ত ভালবাসার কথা প্রকাশ করেছিলেন।
বান্ধবীর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ব্রায়ান জানিয়েছেন, কেটের সাধারণ মানের জীবন যাপনের কথা। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেট কোনও দিনই ব্র্যান্ডেক পোশাকের দিকে হাত বাড়াননি। মাটির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করেন তাঁর প্রেমিকা। তাঁদের মন এখন এতটাই একাত্ম যে কেটকে ছাড়া ব্রায়ান তাঁর জীবন শূন্য বলে মনে করেন।
২০২৩ সালে ‘ডায়েরি অফ আ সিইও’ নামের একটি পডকাস্ট চলাকালীন, ব্রায়ান জানিয়েছিলেন যে তিনি বিবাহবিচ্ছিন্ন। তিনি জানান, সঙ্গী খুঁজে পাওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন। কারণ তাঁর অদ্ভুত আচরণ মেনে নিতে পারেন এমন মানুষ খুবই কম। তিনি এ-ও জানান, স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে তাঁর খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য মহিলাদের সঙ্গে ডেট করা কঠিন হয়ে উঠেছিল।
সম্প্রতি ব্রায়ান জানান যে, জীবনের শুরুতে, তিনি তাঁর পরিবারের কথা মেনে ‘মরমন’ ধর্মের মাধ্যমে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। মরমন ধর্ম, ‘চার্চ অফ জেসাস ক্রাইস্ট অফ ল্যাটার-ডে সেন্টস’ নামেও পরিচিত। জোসেফ স্মিথ এই ধর্মের মূল প্রবক্তা। স্মিথের মস্তিষ্কপ্রসূত এই স্বতন্ত্র ধর্মীয় আন্দোলন মূলধারার খ্রিস্ট ধর্মের তুলনায় ভিন্ন।
১৯৭৭ সালের ২২ অগস্ট আমেরিকার উটার প্রোভোয় জন্ম ব্রায়ানের। বড় হন স্প্রিংভিলেতে। কৃষক পরিবারের সন্তান ব্রায়ানেরা চার ভাইবোন। তবে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর তিনি মা এবং সৎবাবার সঙ্গে থাকতেন। ১৯ বছর বয়সে ইকুয়েডরে চলে গিয়েছিলেন ব্রায়ান। সেখানে দু’বছর কাটিয়ে আবার আমেরিকায় ফিরে যান। আমেরিকায় ফিরে ২০০৩ সালে ব্রিগহাম ইয়ং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। ২০০৭ সালে এমবিএ করেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বুথ স্কুল অফ বিজ়নেস’ থেকে।
সেই বিবাহের ফলে তিন সন্তানের জন্ম হয় ব্রায়ানের। ১৩ বছর বিবাহিত থাকার পর সেই বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসেন তিনি। এর পর আমেরিকান অভিনেত্রী ও বিষয়স্রষ্টা ট্যারিন সাউদার্নের সঙ্গে প্রেম শুরু হয় তাঁর। ২০১৬ সালে তাঁদের প্রথম দেখা হয়। তার পর থেকে ব্রায়ানের প্রভাবে বিলাসবহুল জীবনে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন ট্যারিন। এমনকি ৩৬ বছর বয়সি এই অভিনেত্রীকে ‘মিসেস জনসন’ বলে প্রকাশ্যে সম্বোধন করা শুরু করেছিলেন ব্রায়ান।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে ক্যালিফোর্নিয়ায় একত্রবাস করার সময় বাগ্দান সেরে ফেলেন দু’জনে। ২০১৯ সালে স্তন ক্যানসার ধরা পরে ট্যারিনের। তার পর থেকে সম্পর্কে অবনতি ঘটে দু’জনের। মামলা করে বসেন ব্রায়ানের তৎকালীন প্রেমিকা। মানসিক যন্ত্রণা এবং আর্থিক ক্ষতির জন্য লক্ষ লক্ষ ডলারের ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন ব্রায়ান। প্রেমের সম্পর্কে বিরতি নিয়ে যৌবন পুনরুদ্ধারে মনোনিবেশ করেছিলেন।
ব্রায়ান বার্ধক্য চান না। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একই রকম থেকে যেতে চান। বার্ধক্যকে যেনতেনপ্রকারেণ ঠেকিয়ে রাখার এই যে অদম্য বাসনা, তার জন্য তিনি ভরসা রেখেছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর। বয়সের চাকা উল্টো দিকে ঘোরাতে দেহের প্লাজ়মা বদল করিয়েছেন আমেরিকার বিখ্যাত কোটিপতি ব্রায়ান। কমবয়সিদের রক্তের প্লাজ়মা নিজের শরীরে নিতেন তিনি।
চেহারায় যৌবন ধরে রাখতে সুপার ক্লিন প্লাজ়মাকেই সমস্ত কৃতিত্ব দিতে চান ব্রায়ান। বয়সের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে একটি বিশেষ প্লাজ়মা থেরাপির উপর ভরসা রেখেছেন ব্রায়ান। সারা বছর ধরে বিভিন্ন উপায়ে নিজের বয়স কমানোর হাজারো চেষ্টা চালান তিনি। প্রতি বছরই নিয়ম করে কিছু বিশেষ চিকিৎসার জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করেন।
ওষুধের পাশাপাশি, চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী খাবারেও নজর রাখেন ব্রায়ান। প্রাতরাশে তিনি খান গ্রিন জায়েন্ট স্মুদি। সেই স্মুদিতে থাকে কোলাজ়েনের মতো উপাদান। প্রতি বছর এই বিশেষ চিকিৎসাপদ্ধতির জন্য তিনি ১৬ কোটি টাকা খরচ করেন বলে খবর।
প্রথম দিকে ব্রায়ানের শরীরে তাঁর ছেলের প্লাজ়মা দেওয়া হয়েছিল। ১৭ বছর বয়সি ছেলের প্লাজ়মা নিয়ে যৌবন অটুট রাখার চেষ্টা করেন ব্রায়ান। ব্রায়ানের শরীর থেকে সমস্ত প্লাজ়মা বার করে নেওয়ার পর সমাজমাধ্যমে নিজের প্লাজ়মা হাতে একটি ছবিও পোস্ট করেছিলেন ব্রায়ান। নিজের সেই প্লাজ়মাকে তিনি ‘তরল সোনা’ বলে উল্লেখ করেছেন, এমনটাই শোনা গিয়েছিল সেই সময়।
দীর্ঘায়ু হতে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ‘ব্লুপ্রিন্ট’ চালু করেছিলেন তিনি। ‘ব্লুপ্রিন্ট’-এ প্রতি বছরে প্রায় ২০ লক্ষ ডলার খরচ করে যৌবন ধরে রাখার গবেষণা এবং চিকিৎসা চলে। পাশাপাশি ব্রায়ানের সংস্থা মানুষকে বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়া মন্থর করার নানা পণ্যও বিক্রি করে।
২০২৫ সালের মার্চে ‘ডোন্ট ডাই’ প্রকল্প চালু করেন ব্রায়ান। সেটিকে একটি দার্শনিক ভাবনা হিসাবে চিহ্নিত করেন তিনি। দাবি করেন, বেঁচে থাকাই জীবনের একমাত্র ধর্ম এবং ‘ব্লুপ্রিন্ট’ সেই দর্শনের কথা বলে না। তাই কয়েক মাস আগে ‘ব্লুপ্রিন্ট’ সংস্থাটিকে বন্ধ করে দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছিলেন। ব্রায়ানের বক্তব্য, অমরত্ব পাওয়ার তাঁর যে চেষ্টা বা দর্শন, তাকে কলুষিত করছে ওই ব্যবসা।