নামের পাশে ছিল একাধিক উচ্চ পদের সামরিক মর্যাদার মেডেল। দিনের বেলায় উচ্চপদস্থ সামরিক আধিকারিকের সত্তা রাত নামলেই বদলে যেত এক বিকৃত ধর্ষকামী সত্তায়। দিনের পর দিন অতর্কিতে নারীদের উপর হামলা, যৌন নির্যাতন, পোশাক খুলে ফেলা এবং অবমাননাকর ভঙ্গিতে ছবি তোলার মতো কাজে লিপ্ত ছিলেন তিনি।
বিকৃত কামের বশে এক সহকর্মী ও অন্য এক তরুণীকে ধর্ষণ করে হত্যা করতে হাত কাঁপেনি উচ্চপদস্থ এই সামরিক কর্মকর্তার। তাঁর বিরুদ্ধে নারকীয় অপরাধের প্রমাণ পাওয়ার পর কেঁপে উঠেছিল সেনাবাহিনী। জনগণকে নাড়া দিয়েছিল রোমহর্ষক সিরিয়াল কিলারের কাহিনি। রক্ষকই ভক্ষক হয়ে ওঠার জলজ্যান্ত উদাহরণ হলেন কম্যান্ডার রাসেল উইলিয়াম।
কানাডার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সামরিক কমান্ডারদের একজন ছিলেন কর্নেল রাসেল। কানাডার বৃহত্তম সামরিক বিমানঘাঁটি সিএফবি ট্রেন্টনের কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। রাসেলের তত্ত্বাবধানে বিমানে চড়েছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী-সহ ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথও। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে গ্রেফতারের আগে পর্যন্ত এই বিমানঘাঁটির দায়িত্বে ছিলেন রাসেল।
২০১০ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে জেসিকা লয়েড নামে এক তরুণীর অন্তর্ধান রহস্যের তদন্ত করতে গিয়ে সন্দেহ গিয়ে পড়ে রাসেলের উপর। বরফের উপর গাড়ির চাকার দাগ ও বুটের ছাপের প্রমাণ ধরে তদন্ত এগোতেই রাসেলের নাম সন্দেহের তালিকায় উঠে আসে। রাসেলের বাহন নিসান পাথফাইন্ডারের চাকার দাগের সঙ্গে জেসিকার বাড়ির সামনে পাওয়া চাকার দাগ মিলে যায়।
২০১০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রাসেলকে পুলিশ গ্রেফতার করে। টানা ১০ ঘণ্টা জেরার পর রাসেল তাঁর অপরাধের যে খতিয়ান নির্বিকার ভাবে দেন তা শুনতে শুনতে কেঁপে উঠেছিলেন তদন্তকারী আধিকারিকেরা। অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার ফরেন্সিক প্রমাণ সংগ্রহের জন্য রাসেলকে চাপ দেন পুলিশের গোয়েন্দা সার্জেন্ট জিম স্মিথ। সেই মুহূর্তে রাসেল নির্বিকার ভাবে বলেছিলেন, তিনি শুধুমাত্র দু’টি বিষয় নিয়ে বেশি চিন্তিত। তাঁর স্ত্রী ও কর্মক্ষেত্র।
শুধু জেসিকা নন, কানাডার বিমানবাহিনীর কর্পোরাল ও সহকর্মী মেরি-ফ্রান্স কোমোকেও ধর্ষণ করে খুন করেন বলে ভিডিয়ো রেকর্ডিংয়ে স্বীকার করেন রাসেল। বেশ কিছু দিন ধরে হাত ও মুখ বেঁধে ধর্ষণের পর তাঁকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়।
২০০৭ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে একাধিক যৌন অপরাধ, চুরির অভিযোগও যুক্ত হয় মামলায়। জবানবন্দিতে উঠে আসে রাসেলের একের পর এক কুকীর্তি। এক-আধটা নয়, ৮২টি বাড়িতে ঢুকে চুরি করেছিলেন রাসেল। চুরির বস্তু শুনলে আশ্চর্য না হয়ে উপায় নেই। প্রতিটি বাড়ি থেকে মহিলাদের অন্তর্বাস চুরি করে আনতেন তিনি।
রাসেল রাতের বেলা চুপিসারে মহিলাদের শোয়ার ঘরে নিজের ছবি তুলতেন তাদেরই অন্তর্বাস পরে। গোপনে সাবধানে সমস্ত ছবি একটি হার্ড ড্রাইভে ক্যাটালগ করেছিলেন। এমনকি, সমস্ত অন্তর্বাস তাঁর বাড়িতে সংরক্ষণ করেছিলেন রাসেল। মহিলাদের অন্তর্বাসের প্রতি প্রবল যৌন আকর্ষণ অনুভব করতেন ওই সামরিক কর্তা। প্রায়শই হস্তমৈথুন করার সময় এই জিনিসগুলি পরে নিজের ছবি তুলতেন। কিছু ক্ষেত্রে ন’বছরের কম বয়সি মেয়েদের লক্ষ্য করেও তিনি যৌনচাহিদা পূরণ করতেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
তদন্তকারী আধিকারিকদের জেরায় রাসেল জানিয়েছিলেন কী ভাবে তিনি কয়েক মাসের ব্যবধানে পর পর দু’টি খুন করেছেন ও খুনের আগে অকথ্য যৌন নির্যাতন চালিয়েছেন। একটি সামরিক অভিযানে থাকাকালীন সহকর্মী কর্পোরাল কোমোর সঙ্গে আলাপ হয় রাসেলের। প্রথম আলাপেই কথাচ্ছলে রাসেল জানতে পারেন কোমো একা থাকেন। তখন থেকেই নিজের বিকৃত কাম চরিতার্থ করার পরিকল্পনা ছকে ফেলেন কমান্ডার।
২০০৯ সালের নভেম্বরে কর্পোরাল কোমোর বাড়িতে অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাসেল প্রথম বারের মতো সেখানে প্রবেশ করেন। তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘আমি তার অন্তর্বাস নিয়ে খেলছিলাম, সেগুলি পরেছিলাম আর সেখান থেকে কয়েকটি নিজের জন্য নিয়েছিলাম।’’ দ্বিতীয় বারের জন্য ৩৭ বছর বয়সি কোমোর বাড়িতে ঢুকে বেসমেন্টে লুকিয়েছিলেন রাসেল। বিড়াল খুঁজতে গিয়ে কোমোর নজর পড়ে তাঁর উপর।
সঙ্গে সঙ্গে টর্চ দিয়ে মাথায় মেরে অজ্ঞান করে দেওয়া হয় কোমোকে। তাঁকে দড়ি দিয়ে বেঁধে শোয়ার ঘরে নিয়ে যান রাসেল, নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন, ‘‘আমি তাকে বেশ কিছু দিন ধরে ধর্ষণ করেছিলাম।’’ তার পর ডাক্ট টেপ দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়ে কোমোকে। ব্যাপারটা এখানেই শেষ করেননি কানাডার সামরিক কর্তা। ট্রেন্টন বেস উইং কমান্ডার হিসেবে তাঁর সরকারি পদাধিকার বলে রাসেল কোমোর বাবার কাছে একটি জাল শোকপত্র লিখে পাঠিয়েছিলেন।
২০১০ সালের জানুয়ারি নাগাদ রাসেল আরও একটি শিকারের জন্য আকুল হয়ে পড়েন। জানলা দিয়ে এক স্থানীয় তরুণীকে ট্রেডমিলে দৌড়োতে দেখে তাঁর বিকৃত কাম জেগে ওঠে। সেই তরুণী ছিলেন ২৭ বছর বয়সি জেসিকা লয়েড। রাসেলের পরবর্তী শিকার হন এই জেসিকাই।
সেই রাতেই জেসিকার বাড়িতে হানা দেন রাসেল। জেসিকাকে জাগিয়ে তুলে সঙ্গে আনা দড়ি দিয়ে তাঁর হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলেন ধর্ষক রাসেল। থানা ও আদালতে ঠান্ডা ও নিস্পৃহ গলায় অপরাধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছিলেন রাসেল। তিনি বলেন, ‘‘আমি তার পোশাক খুলে ফেলে ধর্ষণ করেছিলাম।” রাসেল জানান, তিনি জেসিকার গলায় জ়িপ টাই পরিয়ে দিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন যে, যদি তাঁর কথামতো জেসিকা না চলেন তবে টাই পেঁচিয়ে হত্যা করা হবে তাঁকে।
অকথ্য অত্যাচারের পর জেসিকাকে নিজের কটেজে নিয়ে যান রাসেল। অন্তর্বাস পরিয়ে ছবি তুলিয়ে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার কথা বলেও মাথায় আঘাত করেন রাসেল। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার পর তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছেন রাসেল নিজেই।
হত্যা করে নিজের গ্যারাজে জেসিকার দেহ রেখে ট্রেন্টনে তাঁর ঘাঁটিতে চলে যান রাসেল। নির্ধারিত উড়ানের পর তিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে অটোয়ার বাড়িতে দেখাও করতে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে জেসিকার মৃতদেহের বন্দোবস্ত করার জন্য একটি ব়ড় পাথরের নীচে ফেলে দেন।
অভিযুক্ত হওয়ার আগে রাসেলকে সেনাবাহিনীতে এক জন উদীয়মান তারকা বলে মনে করা হত। বিচারপর্ব শেষ হতেই তাঁর সমস্ত পদক ও উর্দি কেড়ে নেওয়া হয়। কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পারও ঘটনার ভয়াবহতা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থ ও রাসেলের সবচেয়ে ভাল বন্ধু জেফ ফারকুহার সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, দীর্ঘ কালের বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাসেলের মনের এই অন্ধকার দিকটি সম্পর্কে কোনও কিছুই জানতে পারেননি।
দু’টি নৃশংস হত্যা, ধর্ষণ ও ৮২টি বাড়িতে অনুপ্রবেশের কারণে ২৫ বছরের সাজা দেওয়া হয় রাসেলকে। রাসেল মহিলাদের ১৪০০টি পোশাক চুরি করেন, যার বেশির ভাগই ছিল অন্তর্বাস। প্রতিটি অপরাধই স্বীকার করেছিলেন তিনি। আদালতে এ-ও জানিয়েছিলেন যে তিনি অনুতপ্ত। তিনি যে অপরাধ করেছেন তাতে অনেকগুলি পরিবারের সুখ-শান্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছে।