Russia Ukraine War

ট্রাম্পের সঙ্গে ঝগড়ার চরম মাসুল, কুর্স্কের রণাঙ্গণে রুশ চক্রব্যূহে ‘অভিমন্যু’ জ়েলেনস্কির ফৌজ

ওভাল অফিসে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডার পরই কিভকে যাবতীয় সামরিক সাহায্য দেওয়া বন্ধ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর জেরে কুর্স্কের রণাঙ্গনে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পরাজয় প্রায় নিশ্চিত বলে জানিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৫ ০৯:৫৭
Share:
০১ ১৮

ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে বসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক। রক্ত ঝরিয়ে তারই চরম খেসারত দিচ্ছে ইউক্রেনের সেনা। আরও এক রণাঙ্গনে তাঁদের হার প্রায় নিশ্চিত। শুধু তা-ই নয়, সেখানে ১০ হাজারের বেশি সৈনিক হারানোর আশঙ্কা রয়েছে কিভের। এর জন্য এক জনকেই দায়ী করছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। তিনি আর কেউ নন, যুদ্ধবিধ্বস্ত ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’র প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি।

০২ ১৮

রাশিয়ার সঙ্গে তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইউক্রেনের প্রাপ্তি বলতে একমাত্র কুর্স্ক। সীমান্ত লাগোয়া ওই রুশ ভূখণ্ডকে গত সাত মাস ধরে নিজেদের দখলে রেখেছে কিভ। কিন্তু, আর তা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন ইউক্রেনীয় ফৌজি জেনারেলরা। কারণ, কুর্স্ক পুনরুদ্ধারে আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়িয়েছে মস্কো। সেই সেনা অভিযানের পোশাকি নাম ‘অপারেশন ব্লিৎজ়ক্রিগ’, যা ঠেকাতে চাই অত্যাধুনিক মার্কিন হাতিয়ার। সৈনিকদের কাছে সেই অস্ত্র পৌঁছোনোর যাবতীয় রাস্তা বন্ধ করে ফেলেছেন জ়েলেনস্কি।

Advertisement
০৩ ১৮

অথচ কয়েক মাস আগে কুর্স্কে বেশ সুবিধাজনক জায়গায় ছিল ইউক্রেনীয় ফৌজ। সেখানকার রুশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পূর্ব ইউরোপের দেশটির আরও ভিতরের দিকে ঢুকে যায় তারা। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্পের সঙ্গে জ়েলেনস্কি বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ানোর পর কিভকে যাবতীয় সামরিক সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে ওয়াশিংটন। ফলে চরম অস্ত্রসঙ্কটে পড়ে তাঁর সেনাবাহিনী। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কুর্স্কে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে ধীরে ধীরে চার দিক থেকে ঘিরে ধরেছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের রণপটু সৈনিকেরা।

০৪ ১৮

বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এই অবস্থায় পিছু হটা ছাড়া জ়েলেনস্কির সেনাবাহিনীর কাছে দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই। সেটা না করলে কুর্স্কের রণাঙ্গনে বিপুল পরিমাণে সৈনিক হারাবে কিভ। আর তাই রুশ ভূখণ্ড থেকে ১০ হাজার ফৌজিকে প্রত্যাহারের এক রকম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে ইউক্রেন প্রশাসন। যদিও সরকারি ভাবে এখনও তা ঘোষণা করা হয়নি। কুর্স্ক থেকে পিছু হটলে, সেটা যে জ়েলেনস্কির সবচেয়ে বড় পরাজয় হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

০৫ ১৮

পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির অবশ্য দাবি, রাশিয়ার সঙ্গে আরও ছ’মাস যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত গোলা-বারুদ রয়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাতে। এর মধ্যে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স-জার্মানি-সহ গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কিভের উপর থেকে হাত তুলে না নিলে, নয় থেকে ১০ মাস পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে জ়েলেনস্কির ফৌজ। তবে বিদ্যুৎ গতিতে আক্রমণ শানানোর ক্ষমতা যে তাদের কমছে, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

০৬ ১৮

হাতিয়ারের পাশাপাশি এত দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে গোয়েন্দা তথ্য পাচ্ছিল ইউক্রেন। আর সেগুলিকে কাজে লাগিয়েই রুশ সৈনিকদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল জ়েলেনস্কির ফৌজ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সেটাও বন্ধ করে দেওয়ায় একেবারে আতান্তরে পড়েছে কিভ। কুর্স্কে পুতিনবাহিনীর অগ্রগতির নেপথ্যে একে সবচেয়ে বড় কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

০৭ ১৮

ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭ মার্চ কুর্স্কে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙে দু’দিক থেকে এগিয়েছে রুশ ফৌজ। একটি বাহিনী সুদঝার দিকে ১১ কিলোমিটার এগিয়ে গিয়েছে। অন্য দলটি ইউক্রেনের সুমি ওব্লাস্টে ঢুকতে সক্ষম হয়। এই এলাকা থেকেই কুর্স্কে গোলাবারুদ সরবরাহ করছিল কিভ। ফলে রুশ ভুখণ্ডে থাকা ১০ হাজার সৈনিকের কাছে রসদ বা কোনও রকমের সাহায্য আর পৌঁছে দিতে পারবেন না জ়েলেনস্কির জেনারেলরা।

০৮ ১৮

কুর্স্ক লাগোয়া ইউক্রেন সীমান্তে সরু বারান্দার মতো একফালি জায়গা রয়েছে। এটি লম্বায় প্রায় এক কিলোমিটার। কিন্তু চাওড়ায় ৫০০ মিটারের কম। ওই এলাকা দিয়ে বাহিনী নিয়ে ঢুকে নিজেদের অবস্থান মজবুত করা কিভের পক্ষে বেশ কঠিন। কারণ, সেখানে অতি সহজেই ড্রোন হামলা চালানোর সুযোগ পেয়ে যাবে পুতিন বাহিনী।

০৯ ১৮

কুর্স্কের যুদ্ধ নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য নিউ ইয়র্ক পোস্ট। সেখানে বলা হয়েছে, রুশ ভূখণ্ড থেকে বাহিনী প্রত্যাহার না করলে ইউক্রেনীয় সৈনিকদের রক্ষা করতে পারবে না কিভ। ফলে জ়েলেনস্কির ফৌজি জেনারেলরা ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছেন। তবে কুর্স্ক পুনরুদ্ধারে যুদ্ধের গতি যে ভাবে মস্কো বদলেছে, তা সত্যিই নজিরবিহীন। দ্রুত আরও বেশি পরিমাণে জমি ইউক্রেন হারিয়ে ফেললেও বলার কিছুই নেই।

১০ ১৮

এ বছরের জানুয়ারিতে দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস লেখে, ঝটিতি আক্রমণে কুর্স্কে ঢুকে পড়লেও রুশ প্রত্যাঘাত সহ্য করতে পারছে না জ়েলেনস্কির বাহিনী। ওই সময়ে কিভের হাতে চলে যাওয়া প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় মস্কো। ফলে যে কোনও মূল্যে কুর্স্ক ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে ইউক্রেন। কারণ, তত দিনে শান্তি সমঝোতার সময়ে একে তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা ছকে ফেলেন প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কি।

১১ ১৮

এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিভের এক সেনা অফিসার। তাঁর কথায়, ‘‘এত দিন রুশ সেনার অগ্রগতির আগাম খবর ওয়াশিংটনের থেকে পাচ্ছিলাম। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হওয়ায় আমরা একরকম ‘ব্ল্যাকআউট’-এর মধ্যে আছি। অন্য দিকে কৃত্রিম উপগ্রহকে কাজে লাগিয়ে দিব্যি আমাদের নিশানা করে যাচ্ছে মস্কো।’’

১২ ১৮

এত দিন পর্যন্ত মার্কিন বেসরকারি মহাকাশ সংস্থাগুলি ইউক্রেনকে রুশ ফৌজের গতিবিধি সংক্রান্ত তথ্য আদানপ্রদান করত। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ম্যাক্সার টেকনোলজিস’। এই কাজ যে তারা আর করবে না, তা সরকারি ভাবে জানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা। কুর্স্কের পরাজয় জ়েলেনস্কির পতনের কারণ হবে কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু গিয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কারণ, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের বিরোধীরা গোপনে ওয়াশিংটনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।

১৩ ১৮

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শান্তি সমঝোতা এবং খনি চুক্তি করতে ওয়াশিংটন সফরে যান জ়েলেনস্কি। সেখানে একরাশ সংবাদমাধ্যমের সামনেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন’ বলে অভিযোগ করেন ট্রাম্প। পাল্টা জবাব দেন জ়েলেনস্কিও।

১৪ ১৮

শান্তি সমঝোতা করার আগে প্রকাশ্যে ট্রাম্পের কাছে একটি প্রতিশ্রুতি চান জ়েলেনস্কি। রাশিয়া ফের আগ্রাসী মনোভাব দেখালে যাতে ইউক্রেনবাসীর নিরাপত্তা সুরক্ষিত থাকে, তা নিশ্চিত করতে চাইছিলেন তিনি। অন্য দিকে দ্রুত চুক্তি সেরে কিভের বিরল ধাতুর খনিগুলি কব্জা করার লক্ষ্য ছিল আমেরিকার। ফলে দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে তর্কাতর্কি বাড়তে থাকে।

১৫ ১৮

এ-হেন বাদানুবাদ চলাকালীন হঠাৎ করেই বৈঠক বন্ধ করে দেন ট্রাম্প। গোটা বিষয়টি ভেস্তে গিয়েছে বুঝতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে দ্রুত ব্রিটেন উড়ে যান জ়েলেনস্কি। সেখানে প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের সঙ্গে একপ্রস্ত আলোচনা সারেন তিনি। পরে কিভকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিপুল ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।

১৬ ১৮

অন্য দিকে, ইউক্রেনের সমর্থনে জ়েলেনস্কির পাশে দাঁড়িয়েছে প্রায় গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন। রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে ইতিমধ্যেই ফ্রান্সের তৈরি ‘মিরাজ-২০০০’ যুদ্ধবিমানের ব্যবহার শুরু করেছে কিভের বায়ুসেনা। ৭ মার্চ হওয়া ইইউ-এর বৈঠকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ ইউক্রেনে সহায়তা বাড়ানোর পক্ষে সওয়াল করেছেন। ওই দিনই অন্তত ৫৪টি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে প্রায় ২০০ বার ড্রোন হামলা চালায় পুতিনবাহিনী। এতে পূর্বের খারকিভ থেকে পশ্চিমের টারনোপিল পর্যন্ত ইউক্রেনের জ্বালানি পরিকাঠামোগুলি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

১৭ ১৮

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অবশ্য দাবি, এত কিছুর পরেও কুর্স্ক দখলে রাখা জ়েলেনস্কির বাহিনীর পক্ষে একরকম অসম্ভব। এর জন্য গোলাবারুদ, রসদ এবং গোয়েন্দা তথ্যের পাশাপাশি বিশাল বাহিনীও চাই তাঁর। পূর্ব ইউরোপের রণাঙ্গনে ব্রিটিশ ফৌজের পা পড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্টারমার। তবে এ ব্যাপারে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি ফ্রান্স ও জার্মানি।

১৮ ১৮

অন্য দিকে ইউক্রেনে ফৌজ পাঠানোর বিষয়টি খারিজ করে দিয়েছেন ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। কিভকে আলোচনার রাস্তায় হাঁটার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। জ়েলেনস্কির সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডার পর ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কে সামান্য চিড় দেখা গিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের। ট্রাম্প আবার অনেক বেশি মস্কোর দিকে ঝুঁকে রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেন যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নেয় সেটাই এখন দেখার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement