স্মার্টফোনগুলি বিশ্বব্যাপী মূলত দু’টি অপারেটিং সিস্টেমে চলে — অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস। দুটিই চালায় আমেরিকার দুই প্রযুক্তি সংস্থা। চিন নতুন অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে বটে, তবে তার ব্যবহার সে দেশের মধ্যেই সীমিত।
অন্য দিকে, ভারতে স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের জন্য নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম নেই। ভারতে যে সমাজমাধ্যমগুলি বহুল ব্যবহৃত, সেগুলির রাশও আমেরিকার হাতেই রয়েছে।
এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছিল, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি ভারতের উপর মার্কিন প্রযুক্তিচালিত প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, তা হলে কী হবে? কী হবে যদি এক্স, গুগ্ল, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক বা চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে না পারেন ভারতীয়েরা?
প্রশ্নটি তুলেছিলেন শিল্পপতি হর্ষ গোয়েন্কা। ওই প্রশ্ন তুলে ভারতের উপর ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারির পরিণাম এবং তার বিকল্প বা ‘প্ল্যান বি’ কী হতে পারে, তা নিয়েও গুরুত্ব সহকারে ভাবার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
গোয়েন্কা এক্স পোস্টে লিখেছিলেন, ‘‘কল্পনা করুন, যদি ভারতের উপর মার্কিন প্রযুক্তিচালিত প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাদ্ধা জারি করেন ট্রাম্প! এক্স, গুগ্ল, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক বা চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে পারবেন না। ভয় লাগল? এর পরিণতি এবং আমাদের জন্য ‘প্ল্যান বি’ কী হতে পারে তা গুরুত্ব সহকারে ভাবুন।’’
গোয়েন্কার সেই টুইটের পরেই হইচই পড়ে। সত্যিই যদি ভারতের উপর ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-এক্স ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, তা হলে ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতি ভেঙে পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন অনেকে।
শুল্ক চাপিয়ে ভারতীয় অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন ট্রাম্প। ভারতের উপর মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন তিনি। ফলে আমেরিকায় পণ্য রফতানি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ক্ষতির মুখে পড়ছেন দেশের উৎপাদকেরা। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তিও হচ্ছে না।
ফলে অনেকেই দাবি করেছেন, নিজের দেশের ভোটারদের খুশি করতে ভারতের উপর গুগ্ল, ফেসবুক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্তও যে কোনও দিন নিতে পারেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
এই নিয়ে যখন আলোচনা-উদ্বেগ তুঙ্গে, তখন উল্লিখিত পরিস্থিতিতে বিদেশি প্রযুক্তির উপর ভারতের নির্ভরতা কমানোর জন্য ‘প্ল্যান বি’ বাতলালেন ভারতেরই অন্য এক শিল্পপতি শ্রীধর ভেম্বু। তিনি ভারতের অন্যতম প্রযুক্তি সংস্থা জ়োহোর প্রতিষ্ঠাতাও বটে।
গোয়েন্কার সঙ্গে সহমত পোষণ করে শ্রীধর এ-ও মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারতের প্রযুক্তি-নির্ভরতা শুধুমাত্র সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মেই সীমাবদ্ধ নয়। অপারেটিং সিস্টেম, মাইক্রোচিপের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি সরঞ্জামের জন্যও ভারতকে অন্য দেশের উপর নির্ভর করতে হয়।
ফলে ভারতের ডিজিটাল দুর্বলতা কাটাতে ‘প্রযুক্তি স্থিতিস্থাপকতার জন্য ১০ বছরের জাতীয় মিশন’-এর প্রস্তাব দিয়েছেন শ্রীধর। গোয়েন্কার পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় শ্রীধর লিখেছেন, ‘‘আমি সহমত। আর অ্যাপের বাইরেও আমাদের প্রযুক্তি-নির্ভরতা অনেক বেশি। অপারেটিং সিস্টেম, চিপের জন্যও আমাদের নির্ভর করতে হয় অন্যদের উপর। আমাদের ১০ বছরের জন্য ‘প্রযুক্তিগত স্থিতিস্থাপকতার স্বার্থে জাতীয় মিশন’-এর প্রয়োজন। তেমনটা করা কঠিনও নয়।’’
গোয়েন্কার পোস্ট ভারতের ডিজিটাল দুর্বলতা এবং প্রযুক্তি নির্ভরতা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন তুলেছিল। তবে শ্রীধরের পরামর্শ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতের ডিজিটাল বাস্তুতন্ত্রে পরিকাঠামোগত পরিবর্তন যে শীঘ্রই প্রয়োজন, তা-ও মনে করিয়ে দিয়েছেন শিল্পপতিদ্বয়।
তবে গোয়েন্কা বা শ্রীধর প্রথম নন, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞেরা প্রায়শই সতর্ক করেন যে, আমেরিকাভিত্তিক বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলি ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তার ফল হবে ভয়ানক। ভারত জুড়ে যোগাযোগ, অর্থায়ন এবং প্রয়োজনীয় অনলাইন পরিষেবাগুলি ব্যাহত হয়ে পড়তে পারে।
গুগ্ল, মেটা এবং মাইক্রোসফ্টের মতো আমেরিকার সংস্থাগুলির উপর নির্ভরতা থাকায় এবং সেই প্ল্যাটফর্মগুলির মাধ্যমে ব্যবসা করার কারণে ছোটখাটো অনেক সংস্থা এবং নাগরিক পরিষেবা প্রভাবিত করতে পারে বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা।
ফলে দীর্ঘমেয়াদি মিশনের জন্য ভারতকে সেমিকন্ডাক্টর, ক্লাউড কম্পিউটিং পরিকাঠামো এবং অপারেটিং সিস্টেমের মতো ক্ষেত্রে দেশীয় বিকল্প তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন শ্রীধর। জোর দিয়ে বলেছেন, ভারতের প্রকৃত প্রযুক্তিগত স্বাধীনতার জন্য কেবল অ্যাপ্লিকেশন তৈরিতে নয়, চিপ এবং ফ্যাবসের মতো মৌলিক প্রযুক্তিতেও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
নেটাগরিকদের একাংশ ইতিমধ্যেই শ্রীধরের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত হয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন, ভারতের জন্য প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা এখন কেবল একটি অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নয়, এটি কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা।
যদিও নেটাগরিকদের অনেকে শ্রীধরের সঙ্গে একমত হননি। বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল বাস্তুতন্ত্রের চ্যালেঞ্জগুলি উল্লেখ করে জাতীয় মিশনের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।