দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৮৮টি সম্পত্তি শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থাকে বিক্রি করে দিতে সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি চেয়েছিল সহারা গোষ্ঠী। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বাজার নিয়ামক সংস্থা সেবির মতামত জানতে চেয়েছিল শীর্ষ আদালত।
তবে সোমবার মামলার শুনানির সময় এই বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে আরও সময় চেয়ে নিয়েছে কেন্দ্র। এ নিয়ে কেন্দ্রের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাকে আরও চার সপ্তাহ সময় মঞ্জুর করেছে প্রধান বিচারপতি বিআর গবই, বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি এমএম সুন্দরেশের বেঞ্চ। সহারা কর্মীদের বকেয়া বেতন দেওয়ার জন্য দায়ের করা আবেদনের শুনানিও স্থগিত রেখেছে শীর্ষ আদালত।
প্রয়াত বাঙালি শিল্পপতি সুব্রত রায় প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘সহারা ইন্ডিয়া কমার্শিয়াল কর্পোরেশন’ (এসআইসিসিএল)-এর স্থাবর সম্পত্তির তালিকায় রয়েছে মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বইয়ের অদূরের অ্যাম্বি ভ্যালি এবং উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনউয়ের উপকণ্ঠের সহারা নগর।
লখনউয়ের গোমতী নগরের এই সহারা নগর একসময় ছিল সহারা ইন্ডিয়া পরিবারের রিয়্যাল এস্টেট উচ্চাকাঙ্ক্ষার উজ্জ্বল প্রতীক। এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল গোষ্ঠীর তরফে দেশ জুড়ে স্বপ্নের বাড়ি তৈরির প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মাধ্যমে।
আবাসিক কলোনি তৈরির জন্য সহারা গোষ্ঠীকে গোমতী নগরের ১৮০ একরের জমি লিজ় দিয়েছিল লখনউ পুরসভা। কিন্তু সেই জায়গাকে বিলাসবহুল প্রাসাদ-সহ একটি নগরে রূপান্তরিত করেন সুব্রত। সহারা নগর হয়ে ওঠে দেশের আভিজাত্যের প্রতীক।
বাসভবন, হাসপাতাল, ক্লাব, মন্দির, সিনেমাহল, সুইমিং পুল, কৃত্রিম হ্রদ, স্টেডিয়াম, হেলিপ্যাড, পশুখামার, খেত— কী না ছিল ১৮০ একরের সেই নগরের মধ্যে। দেশে বড় মাপের যে কোনও ছবি মুক্তি পেলে তা সহারা নগরের ওই সিনেমাহলেও মুক্তি পেত।
একসময় দেশের বড় বড় চলচ্চিত্র তারকা, নেতা থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের ভিড় লেগে থাকত সহারা নগরে। নগরে উঁকি মারলে দেখা যেত বিলাসবহুল সব গাড়ির ঝলক। নিরাপত্তাও ছিল আঁটসাঁট।
সহারার কর্মচারীদের অনেকের দাবি, একটা সময় ছিল যখন অমিতাভ বচ্চন, অক্ষয় কুমার, ধর্মেন্দ্র, শত্রুঘ্ন সিন্হা, মিঠুন চক্রবর্তী এবং গোবিন্দের মতো বিখ্যাত অভিনেতাদের ঘন ঘন যাতায়াত লেগেই থাকত সহারা নগরে। তাঁরা এসে থাকতেন কৃত্রিম হ্রদের ধারের জলমহলে। দুর্গাপূজার সময় সহরা নগরে ধুমধাম হত আরও বেশি।
কিন্তু সেই সহারা নগরই এখন ধ্বংসের মুখে। জাঁকজমক এবং গ্ল্যামার এখন অতীত। অযত্নে, ধুলোয় মাখা সেই নগর এখন জনমানবহীন। নগরের যত্রতত্র নোংরা পড়ে। বাড়িঘর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। কোথাও কোথাও ফাটল ধরেছে।
সহারা নগরের গেট দিয়ে উঁকি দিলে এখনও দেখতে পাওয়া যায়, সংস্থার অনেক বাতিল গাড়ি রাস্তার উপর দাঁড় করানো আছে। মনে করা হয়, সহারা নগরে অডি থেকে শুরু করে বিএমডব্লিউ পর্যন্ত ২০টির বেশি শুধু বিলাসবহুল গাড়িই পড়ে রয়েছে।
কিন্তু কেন এমন অবস্থা? সহারার ব্যবসার ভরাডুবির কথা সকলেরই জানা। তবে অনেকেই জানেন না, ১৯৯৭ সালে সহারা নগরের লিজ় বাতিল করে দিয়েছিল লখনউ পুরসভা। বিষয়টি আদালতে যায়। সম্প্রতি আনুষ্ঠানিক ভাবে গোমতী নগরের বিস্তৃত সহারা প্রাসাদের দখল নিয়েছে লখনউ পুরসভা। ১৮০ একরের সম্পত্তি, যার মধ্যে সুব্রত রায়ের বাসভবনও ছিল, তা-ও সিল করে দেওয়া হয়েছে।
কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, গত ১১ সেপ্টেম্বর জারি করা একটি নোটিসে সহারার বর্তমান বাসিন্দাদের প্রাঙ্গণটি খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রবেশপথে এখন একটি বোর্ড লাগানো হয়েছে, যেখানে প্রাসাদটিকে পুরসভার সম্পত্তি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।
সূত্রের খবর, সুব্রতের স্ত্রী স্বপ্না রায়কেও বাসভবন খালি করতে বলা হয়েছিল। ইতিমধ্যেই তিনি সেখান থেকে অন্যত্র চলে গিয়েছেন।
তবে শুধু সহারা নগর নয়, মহারাষ্ট্রের অ্যাম্বি ভ্যালির অবস্থাও একই রকম। এ ছাড়াও পুণে, ঔরঙ্গাবাদ, যোধপুর, গ্বালিয়র, বরেলী, সোলাপুর, পোরবন্দর, কাটনি, কাশীপুর এবং লখনউ-সহ ১০টি শহরে ৯০০ একর জমির উপর বিস্তৃত প্রকল্পগুলিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ টাউনশিপ হিসাবে কল্পনা করা হয়েছিল।
ঠিক ছিল, বিলাসবহুল আবাসনের পাশাপাশি পার্ক, স্কুল, শপিং কমপ্লেক্স এবং সিনেমাহল— অত্যাধুনিক জীবনযাপনের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থাকবে ওই নগরগুলিতে। সে সব প্রকল্প স্বপ্ন হয়েই রয়ে গিয়েছে।
২০১২ সালে সহারা ইন্ডিয়া ১০টি এই ধরনের প্রকল্প চালু করার কথা জানিয়েছিল, যার প্রতিটির জন্য ৫০০-৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রয়োজন ছিল। প্রকল্পগুলির জন্য দেশ জুড়ে প্রায় ২৭,০০০ একরের জমি জোগাড় করেছিল সংস্থাটি।
সহারার আর একটি প্রধান উদ্যোগ ছিল সহারা স্বপ্ন সিটি, যা কম টাকায় সাধারণ নাগরিকের হাতে জমি এবং বাড়ি তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে তৈরি হয়েছিল। এই প্রকল্প শুরু হওয়ার কথা ছিল ৩৬০টি শহরে। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য ১০০-১২৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছিল সে সময়।
সহারা গোষ্ঠীর সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী উদ্যোগগুলির মধ্যে ছিল কোয়ম্বত্তূরে ১১৩ একরের একটি শহর তৈরি। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা-সহ ৩,৮৪৬টি আবাসন তৈরির পরিকল্পনা ছিল সেখানে।
বিদেশেও সহারা মডেলের প্রতিলিপি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যার মধ্যে বাংলাদেশেও একটি প্রস্তাবিত নতুন শহর তৈরির কথা ভাবা হয়েছিল। তবে তার কোনও কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং মাথায় চেপেছে ঋণের বোঝা।
আদানি গোষ্ঠীকে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৮৮টি সম্পত্তি বিক্রি করে লগ্নিকারীদের বকেয়া টাকা মেটানোর প্রস্তাব শীর্ষ আদালতকে দিয়েছিলেন সহারা কর্তৃপক্ষ। এর পরেই প্রধান বিচারপতি বিআর গবই, বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি এমএম সুন্দরেশের বেঞ্চ সেই আবেদনের অন্তর্বর্তিকালীন শুনানি শুরু করে।
মামলার আবেদনে এসআইসিসিএল-এর আইনজীবী গৌতম অবস্থি শীর্ষ আদালতে জানিয়েছিলেন, তাঁদের সংস্থার মোট ২৪ হাজার কোটি টাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির থেকে এখনও পর্যন্ত ১৬ হাজার কোটি টাকা উদ্ধার করা গিয়েছে এবং গোটা টাকাটাই সেবির হাতে তুলেও দেওয়া হয়েছে।
পরবর্তী ধাপে আরও ৮৮টি সম্পত্তি আদানি গোষ্ঠীকে বিক্রি করে লগ্নিকারীদের বকেয়া মিটিয়ে দিতে চান তাঁরা। মামলায় কেন্দ্রের প্রতিনিধি, সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাকে ১৭ নভেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রের মতামত জানানোর নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। তবে ১৭ নভেম্বর আদালতের কাছে এ নিয়ে আরও সময় চেয়ে নিয়েছে কেন্দ্র।