ডলার আধিপত্যবাদের দিন কি শেষ? ধীরে ধীরে কি সেই জায়গার দখল নিচ্ছে চিনা মুদ্রা ‘রেনমিনবি’, যার একককে গোটা দুনিয়া চেনে ইউয়ান নামে? ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত খনিজ তেলের লেনদেনের একটা বড় অংশ দখল করেছে তারা। ফলে লাগাতার ইউয়ানে বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়াচ্ছে রাশিয়া, ব্রাজ়িল, আর্জেন্টিনা এবং ইরানের মতো দেশ। পিছিয়ে নেই ভারতও। টাকাকে বিশ্বমুদ্রায় পরিণত করতে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা আরবিআই।
বর্তমানে ডলার বর্জনকারী প্রথম ১০টি রাষ্ট্রের তালিকার একেবারে নীচে রয়েছে আর্জেন্টিনা। গত কয়েক বছর ধরেই মারাত্মক আর্থিক সমস্যায় ভুগছে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশ। বুয়েনাস আইরেসের মাথার উপর ঝুলছে প্রায় চার হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ। ফলে কিছুটা বাধ্য হয়ে আমদানি-রফতানির সিংহভাগ লেনদেনের ক্ষেত্রে চিনা ইউয়ান ব্যবহার করছে তারা। তবে মেসি-মারাদোনার জন্মভূমিতে এখনও পুরোপুরি ব্রাত্য হয়নি মার্কিন মুদ্রা।
তালিকায় নবম স্থানে রয়েছে তুরস্কের নাম। দেশের জ্বালানি সঙ্কট মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার রক্তচক্ষু এড়িয়ে রাশিয়ার থেকে দিব্যি অপরিশোধিত খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে যাচ্ছেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোয়ান। এর দাম মেটাতে কখনও মস্কোর মুদ্রা রুবল, কখনও আবার সোনা ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির দাবি, এতে প্রায় ৬০ শতাংশ জ্বালানি কেনার খরচ মেটাচ্ছেন তিনি।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়া ইস্তক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রাজ়িলের সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে আদায়-কাঁচকলায়। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির থেকে আমদানি করা পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন তিনি। যদিও তাতে দমে যাওয়ার পাত্র নন ব্রাজ়িলের বামপন্থী প্রেসিডেন্ট লুইজ় ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা। শুল্কযুদ্ধে ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়ার পাল্টা হুঙ্কার দিতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। শুধু তা-ই নয়, ডলারের মূল্য হ্রাস করতে চিনের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সেরেছেন লুলা দ্য সিলভা।
বেজিং-ব্রাসিলিয়া বাণিজ্যিক সমঝোতা অনুযায়ী, আগামী দিনে ১,৫০০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য লেনদেন চিনের ইউয়ানে করবে দুই দেশ। ড্রাগনভূমিতে মূলত কৃষিপণ্য পাঠায় দক্ষিণ আমেরিকার ওই দেশ। এর মধ্যে সয়াবিন, ভুট্টা, চিনি, সেলুলোজ় এবং মাংস উল্লেখযোগ্য। অন্য দিকে মান্দারিনভাষী রাষ্ট্রটি থেকে সেখানে সরবরাহ হয় বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক, রাসায়নিক এবং অন্যান্য শিল্পজাত পণ্য।
তালিকায় সপ্তম স্থানে জায়গা পেয়েছে ‘রিপাবলিক অফ সাউথ আফ্রিকা’ (পড়ুন দক্ষিণ আফ্রিকা)। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ তুলে সেখানকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসাকে প্রকাশ্যেই ‘অপমান’ করেন ট্রাম্প। এর পরই ওয়াশিংটন এবং কেপটাউনের সম্পর্কের সূচক নিম্নমুখী হতে শুরু করে। সূত্রের খবর, শেষ চার মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৬৫ শতাংশকে ডলারমুক্ত জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন রামাফোসা। এই অঙ্ক ৮৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।
১৯৭৯ সালে ‘ইসলামীয় বিপ্লব’-এর পর রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ইরানের ক্ষমতা দখল করেন কট্টরপন্থী শিয়া ধর্মগুরু আয়াতোল্লা রুহুল্লাহ খামেনেই। তেহরানের শাসনবদল অবশ্য মেনে নিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। ফলে তিনি কুর্সিতে বসতেই ধাপে ধাপে সাবেক পারস্য দেশটির উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় আমেরিকা। এর জেরে অপরিশোধিত খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল ভান্ডার থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে তা বিক্রি করা শিয়া মুলুকটির পক্ষে একরকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালে ডলারে বৈদেশিক বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় ইরান। বর্তমানে তেহরানের খনিজ তেলের অন্যতম বড় ক্রেতা হল বেজিং। ড্রাগনভূমির সঙ্গে ইউয়ানে এই বাণিজ্য চালাচ্ছে তারা। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে দীর্ঘ দিন সাবেক পারস্য দেশটির থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানি করছে না নয়াদিল্লি। ইউয়ানে সেই ব্যবসা ফের শুরু করার ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ রয়েছে হরমুজ় প্রণালীর কোলের দেশটির, খবর সূত্রের।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে মস্কোর উপর ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি দুনিয়া। ফলে গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে ৮৪ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য চিনের ইউয়ানে করছে ক্রেমলিন। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে রুপি-রুবল বাণিজ্যিক সমঝোতা রয়েছে পূর্ব ইউরোপের ওই দেশটির। আর তাই তালিকায় পঞ্চম স্থানে নাম রয়েছে রাশিয়ার।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ডলারের প্রতি আস্থা হারিয়েছে আমেরিকার পরম ‘বন্ধু’ হিসাবে পরিচিত সৌদি আরবও। তালিকায় রিয়াধের স্থান তাই চতুর্থ। গত বছরের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পেট্রোডলারের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় তাদের। এর পরই সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটির আর পুনর্নবীকরণ হচ্ছে না বলে জানিয়ে দেয় পশ্চিম এশিয়ার ওই আরব মুলুক। শেষ ৫০ বছর ধরে এই চুক্তি অটুট রেখেছিল এই দুই দেশ।
১৯৭৪ সালের ৮ জুন সৌদি সরকারের সঙ্গে পেট্রোডলারের চুক্তি করে আমেরিকা। ঠিক হয়, খনিজ তেল রফতানির ক্ষেত্রে কেবলমাত্র মার্কিন মুদ্রা ব্যবহার করবে রিয়াধ। বিনিময়ে পশ্চিম এশিয়ার দেশটিকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটিকে হাতিয়ার করে পরবর্তী দশকগুলিতে খনিজ তেলের আন্তর্জাতিক বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রায় পুরোপুরি নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় ওয়াশিংটন।
গত বছর সেই চুক্তি থেকে সরে আসার পর অন্যান্য মুদ্রাতেও ‘তরল সোনা’ বিক্রি শুরু করেছে সৌদি সরকার। ২০২৪ সালে পাঁচ হাজার কোটি ডলার মূল্যের তেল যুক্তরাষ্ট্রের বদলে অন্য মুদ্রায় সরবরাহ করতে দেখা গিয়েছে রিয়াধকে। পশ্চিম এশিয়ার দেশটির স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের ইচ্ছা প্রবল। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা ইউরো, চিনা ইউয়ান এবং জাপানি মুদ্রা ইয়েনে আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রবণতা রয়েছে তাদের।
সৌদি আরবের পাশাপাশি ধীরে ধীরে ডলার ত্যাগের রাস্তায় হাঁটছে আর এক উপসাগরীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। আবু ধাবির স্থানীয় মুদ্রা দিরহামের সঙ্গে মার্কিন মুদ্রা ডলারের মূল্যের পার্থক্য মোটেই বেশি নয়। এর জেরে গত বছর (পড়ুন ২০২৪) আট হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক বাণিজ্য স্থানীয় মুদ্রায় করতে দেখা গিয়েছে এই উপসাগরীয় দেশটিকে। আগামী দিনে সেই অঙ্ক আরও বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভাবনা প্রবল, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে চিনের ইউয়ান ব্যবহার করছে বিশ্বের ১৩০টা দেশ। সরাসরি ভারতীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করা দেশের সংখ্যা ২২। ডলারের ‘একচ্ছত্র’ প্রতিপত্তি শেষ করার ব্যাপারে সর্বাধিক উদ্যোগ রয়েছে রাশিয়ার। গত কয়েক বছর ধরেই ‘ব্রিকস’ভুক্ত দেশগুলির একটি সাধারণ মুদ্রা চালু করার ব্যাপারে জোরালো সওয়াল করতে দেখা যাচ্ছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে। সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির সদস্যপদ রয়েছে ভারত, চিন, ব্রাজ়িল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা-সহ মোট ১০টি রাষ্ট্রের।
আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, ‘ব্রিকস’ মুদ্রা চালু হলে হু-হু করে কমবে ডলারের মূল্য। সে ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা খেতে পারে আমেরিকার অর্থনীতি। তবে সংশ্লিষ্ট মুদ্রাটি চালু করা মোটেই সহজ নয়। কারণ, ‘ব্রিকস’ভুক্ত ভারত ও চিনের মধ্যে রয়েছে সীমান্ত সংঘাত। এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকে আছে রাশিয়া এবং ইরান। গত তিন-চার বছর ধরে ক্রমাগত যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হচ্ছে এই দুই দেশকে।
অতীতে ডলারের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে বিপদের মুখে পড়ে ইরাক এবং লিবিয়া। একসময়ে ইউরোয় খনিজ তেল বিক্রির কথা ঘোষণা করেন বাগদাদের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেন। এর পরই তাঁর বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী হাতিয়ার রাখার অভিযোগ তোলে আমেরিকা। এর পর সেখানে সামরিক অভিযান পাঠাতে দেরি করেননি ওয়াশিংটন। ফলে দ্রুত পতন হয় সাদ্দামের। মার্কিন ফৌজের হাতে বন্দি হন তিনি। বিচারে ফাঁসির সাজা হয় তাঁর।
লিবিয়ার গল্পটাও প্রায় একই রকম। ১৯৬৯ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে উত্তর আফ্রিকার দেশটির ক্ষমতা দখল করেন কর্নেল মুয়াম্মর গদ্দাফি। ২১ শতকের গোড়ার দিকে ডলারে খনিজ তেল বিক্রি করার ব্যাপারে অসম্মতি জানান তিনি। কিছু দিনের মধ্যেই আচমকা এক ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাঁর দেশ। ২০১১ সালে বিদ্রোহীদের গুলিতে মৃত্যু হয় তাঁর। পর্দার আড়ালে থেকে এই চিত্রনাট্যের পুরোটাই মার্কিন গুপ্তচরবাহিনী সিআইএ (সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি) লিখেছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
ফলে এ বারও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউই। ডলারকে শেষ করার চেষ্টা হলে মোটা অঙ্কের শুল্ক চাপানোর হুমকি ইতিমধ্যেই দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যদিও সেই হুঁশিয়ারিকে অগ্রাহ্য করেই স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যের উপরে জোর দিচ্ছে ভারত, রাশিয়া এবং চিন। শেষ পর্যন্ত তাতে কতটা সাফল্য আসে, সেটাই এখন দেখার।