মার্কিন অর্থনীতিতে ‘জ়ম্বি’ হামলা! ঋণের উপর ঋণ নিয়ে চলেছে একের পর এক সংস্থা। ফলে দিন দিন জটিল হচ্ছে পরিস্থিতি। বাড়তে বাড়তে দু’লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছেছে ধারের অঙ্ক। কিন্তু, তার পরেও টনক নড়ছে না ওয়াশিংটনের। এই অবস্থা চলতে থাকলে ‘জ়ম্বি’ সংস্থাগুলির জন্য আমেরিকাকে ডুবতে হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ। সে ক্ষেত্রে ভারত-সহ সারা বিশ্বকে যে এর ক্ষতিকর প্রভাব সইতে হবে, তা বলাই বাহুল্য।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ভিতর থেকে ফোপরা করে ফেলা ‘জ়ম্বি’ সংস্থাগুলি কারা? মূলত ছোট পুঁজির কিছু সংস্থাকে এর আওতাভুক্ত করা হয়ে থাকে। ঋণ নিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখে এই সব সংস্থা। তাদের নতুন কিছু তৈরির ইচ্ছা বা চেষ্টা নেই। মুনাফা করার কোনও মডেল অনুসরণ করে না তারা। এককথায় ব্যবসায়িক দিক থেকে ‘মৃত’ অথচ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সংস্থাগুলিকে ‘জ়ম্বি’ সংস্থা হিসাবে আর্থিক বিশ্লেষকেরা চিহ্নিত করে থাকেন।
অর্থনীতির পরিভাষায় ‘জ়ম্বি’ সংস্থার আরও একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। ঋণগ্রস্ত কোনও কোম্পানির সুদের অনুপাত কখনওই লাভের অঙ্কের চেয়ে কম হতে পারে না। একে বলে ‘ইন্টারেস্ট কভারেজ রেশিয়ো’। যে সমস্ত সংস্থার এই অনুপাত পর পর তিন বছরের মধ্যে এক বা দু’বার ঋণাত্মক থাকবে, তাদের পক্ষে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। এগুলিই ‘জ়ম্বি’ সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
আমেরিকার আইন অনুযায়ী, স্টার্টআপ খোলার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে সস্তা সুদে ঋণ পাওয়ার সুবিধা রয়েছে। এই নিয়মের জাঁতাকলে একের পর এক ‘জ়ম্বি’ সংস্থা গজিয়ে উঠছে বলে সতর্ক করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের কথায়, ব্যবসার সম্প্রসারণ না করলেও এই কোম্পানিগুলির মধ্যে ঋণের উপরে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এর মাধ্যমে নিজেদের শেয়ার চাঙ্গা করার চেষ্টাও করে থাকে তারা, যেটা আরও বিপজ্জনক।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলিতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বর্তমানে আমেরিকার ছোট কোম্পানিগুলির মধ্যে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ ‘জ়ম্বি’ সংস্থা। এদের জন্য আমেরিকার মোট ঘরোয়া ধারের ৭৫ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে সেখানকার নন-কর্পোরেট ঋণ। যেটা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির চার ভাগের তিন ভাগ। উদ্বেগের বিষয় হল, এই সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রয়েছে।
চলতি আর্থিক বছরের (২০২৫-’২৬) শেষে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জ়ম্বি’ সংস্থাগুলির নেওয়া ঋণের শুধুমাত্র সুদের পরিমাণ দাঁড়াবে ছ’হাজার কোটি ডলার। ২০২৮ অর্থবর্ষে সেটা এক লক্ষ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আর্থিক বিশ্লেষকদের কথায়, আমেরিকার জন্য ‘জ়ম্বি’ সংস্থাগুলি একাধিক বিপদ ডেকে আনছে। এদের জন্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতির হার এবং বেকারত্ব। সংস্থাগুলি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে ওয়াল স্ট্রিটের স্টকের বাজারে ধস নামার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমেরিকার শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত ৫১৬টি সংস্থা নিজেদের দেউলিয়া বলে ঘোষণা করে। এগুলির প্রায় প্রতিটি শেষ তিন-চার বছর ধরে লাগাতার ঋণ নিয়ে গিয়েছে। ফলে আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিকে কিনে নিতে অস্বীকার করে বড় বড় কর্পোরেট হাউস ও শিল্প সংস্থা। মালিকানা হাতবদল না হওয়ায় ওয়াল স্ট্রিটের স্টকের বাজারে এখনও অস্তিত্ব রয়েছে ওই সমস্ত ‘জ়ম্বি’ কোম্পানির।
দু’বছর আগে এই ইস্যুতে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন ‘আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার’-এর (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) তৎকালীন অর্থনীতিবিদ ব্রুনো আলবুকার্ক। তিনি বলেন, ‘‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জ়ম্বি সংস্থার সংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সর্বাধিক ক্ষতিকর প্রভাব সহ্য করতে হচ্ছে প্রতিযোগিতায় থাকা অন্যান্য সংস্থাকে। জ়ম্বি সংস্থাগুলির জন্য অনেক সময়ে সুদের হার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজ়ার্ভ।’’
‘জ়ম্বি’ সংস্থার ব্যবসা বৃদ্ধি করতে না পারার নেপথ্যে একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের যুক্তি, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতে পারে না বহু ছোট পুঁজির সংস্থা। ফলে পুরনো কাঠামোকে আঁকড়ে ধরে ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তারা। এতে ফল হয় হিতে বিপরীত। সেই কারণে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) আসার পর ‘জ়ম্বি’ সংস্থার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ক্যাথরিন জ়াজ। তাঁর কথায়, ‘‘দেশের আর্থিক অবস্থা ঠিক রাখতে হলে সুস্থ এবং সু-মূলধনী ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সেখানে ঋণের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়া মোটেই ভাল নয়। আর তাই কোনও সংস্থা ‘জ়ম্বি’ হচ্ছে বুঝতে পারলে দ্রুত তা বন্ধ করার আইন প্রণয়ন করতে হবে। এতে প্রাথমিক ভাবে কিছু লোকসান হলেও বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে দেশ।’’
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজ়ার্ভের অবশ্য দাবি, ২০২০ সালে কোভিড অতিমারির সময় ‘জ়ম্বি’ সংস্থার সংখ্যা লাগামছাড়া ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলিতে এর সংখ্যা কিছুটা নামিয়ে আনা গিয়েছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে সুদের হার কিছুটা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে তারা। আগামী দিনে সুদের হার বেশি রাখার পক্ষপাতী ফেড রিজ়ার্ভ। পাশাপাশি, ঋণ শোধ করতে না পারা সংস্থার ব্যালেন্স শিট পরীক্ষার কড়া আইন তৈরির দাবি তুলেছে আমেরিকার এই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।
আমেরিকার মতো ‘জ়ম্বি’ সংস্থার উপস্থিতি রয়েছে ভারতেও। স্টার্টআপের নামে খোলা সেই সমস্ত কোম্পানিগুলি নতুন কিছু তৈরি করছে না। এ দেশের ঋণ ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের মতো নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ স্টার্টআপকে ধার দেওয়ার নিয়মে বদল আনার দাবি তুলেছে। যে সমস্ত সংস্থা গবেষণা এবং নতুন কিছু বাজারে আনার চেষ্টা করছে, কেবলমাত্র তাদের ঋণের উপরে ঋণ দেওয়া উচিত, বলছেন তাঁরা।
এ বছরের ১ অক্টোবর থেকে আমেরিকায় শুরু হয়েছে শাটডাউন। ফলে জরুরি পরিষেবাকে বাদ দিয়ে সেখানে বন্ধ রয়েছে সমস্ত সরকারি কাজকর্ম। এই পরিস্থিতিতে মন্দার পূর্বাভাস দিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে সতর্ক করেছে রেটিং সংস্থা ‘এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল’। ডিসেম্বরের মধ্যে মন্দার পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতির কাঁটাতেও মার্কিন অর্থনীতির ক্ষতবিক্ষত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে স্পষ্ট করেছে তারা।
সম্প্রতি ‘সিএনবিসি টিভি১৮’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মার্কিন অর্থনীতি নিয়ে একাধিক বিস্ফোরক দাবি করেন ‘এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল’-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ সত্যম পাণ্ডে। তাঁর কথায়, ‘‘আগামী ১২ মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র মন্দার মুখে পড়ার অন্তত ৩০ শতাংশ আশঙ্কা রয়েছে।’’ এর জন্য মূলত শ্রম বাজার এবং ভোক্তা ব্যয়ের নিম্নমুখী সূচককে দায়ী করেছেন তিনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টার ত্রুটি করছে না আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজ়ার্ভ, খবর সূত্রের।
সাক্ষাৎকারে পাণ্ডে বলেন, ‘‘শ্রম বাজারের উপর ট্রাম্প প্রশাসন এবং ফেডারেল রিজ়ার্ভের কর্তাব্যক্তিরা কড়া নজর রাখছেন। দেশে বেকারত্বের হার বাড়ুক, তা কোনও ভাবেই সরকারের কাছে কাম্য নয়।’’ তবে বর্তমানে মার্কিন অর্থনীতি যে মাত্রাতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতির চাপে ভুগছে তা স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। এই সূচককে টেনে নামাতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক অক্টোবরের শেষে এবং ডিসেম্বরে সুদের হার কমাতে পারে বলে জানিয়েছেন ‘এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল’-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ‘সঙ্কট’ নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) একটি পোস্ট করেন ‘মুডিজ় কর্পোরেশন’-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ মার্ক জ়ান্ডি। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রের এক তৃতীয়াংশ প্রদেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) হয় মন্দায়, নয়তো সেই রকম পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য এক তৃতীয়াংশ কিছুটা স্থিতিশীল। বাকি এক তৃতীয়াংশের সূচক বৃদ্ধি পাচ্ছে। এককথায় অর্থনীতি যথেষ্ট অস্থির। আমার মূল্যায়ন অনুযায়ী, আমেরিকায় মন্দা আসার মতো সহায়ক পরিস্থিতি রয়েছে।’’
২০০৮ সালে বিশ্ব জুড়ে আর্থিক মন্দার ভবিষ্যদ্বাণী করে খবরের শিরোনামে আসেন জ়ান্ডি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে তালুর মতো চেনেন তিনি। এ-হেন ‘মুডিজ়’-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদের সতর্কবার্তার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। কোনও দেশ আর্থিক মন্দার কবলে পড়েছে, এটা বোঝার একটা সুনির্দিষ্ট উপায় রয়েছে। একটি অর্থবর্ষে পর পর দু’টি ত্রৈমাসিকে যদি জিডিপির সূচক ঋণাত্মক থাকে, তা হলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রটিকে মন্দা গ্রাস করেছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
বর্তমানে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ন’হাজার কোটি ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য রয়েছে। ‘জম্বি’ সংস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতির হার বেশি বৃদ্ধি পেলে এ দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে লোকসানের মুখে পড়তে হতে পারে। কারণ, ওয়াশিংটনের ঘরোয়া অর্থনীতির সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে এই দুই ক্ষেত্র।