একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

যে বছর প্রথম দার্জিলিং গেছিলাম, তখন বয়স কত ছিল মনে করার মতো মেমরি তৈরি হয়নি। কিন্তু বুঝি, সে সব গত জন্মের কথা, কারণ তখন মন বেজায় ভাল থাকত।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share:

যে বছর প্রথম দার্জিলিং গেছিলাম, তখন বয়স কত ছিল মনে করার মতো মেমরি তৈরি হয়নি। কিন্তু বুঝি, সে সব গত জন্মের কথা, কারণ তখন মন বেজায় ভাল থাকত। আসলে মধ্যবিত্ত সংসার থেকে মে মাসের ছুটিতে দার্জিলিং আর হঠাৎ শাড়ির ওপর কোট পরা মায়ের স্টাইল খামখাই মনে খুশির হরিল্লুঠ দিত। কিন্তু ওই যে, মধ্যবিত্ত সংসার। তার মধ্যবিত্ততা তত ক্ষণ সম্পূর্ণ হয় না যত ক্ষণ না সে অল্প খোঁচা, মৃদু ব্যথা, সামান্য তিক্ততা মিশিয়ে দিতে পারে। সমস্যা-সংকুল বেড়ানো না হলে বাঙালির ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যায়। আমরা রুল ভাঙি কী করে?

Advertisement

ফেরার সময় শিলিগুড়িতে কী সব ট্রেনের গন্ডগোল হল, আমরা একটা পুরো দিন আটকে গেলাম। হোটেল পাওয়া গেল না। কী করে যেন বাবার এক কলিগ খবর পেয়ে, ওঁর বাড়ি নিয়ে গেলেন। ওঁদের বাড়ি তখন তৈরি হচ্ছে। এক পাশে পড়ে রয়েছে ডাঁই করা ইট, ছাদ নেড়া। কোনও কোনও ঘরে দরজা জানলা লাগানো হয়নি।

বিকেল চারটে নাগাদ পৌঁছলাম। ওদের বাড়ি দুজন ছেলেমেয়ে ছিল, যারা আমার আর দিদির মতোই। খেলাধুলো শুরু হয়ে গেল। একটা ঘরে, ওদের বাড়ির বাইরে যে লোহার গেট লাগানো হবে, সেটা হেলান দিয়ে দাঁড় করানো ছিল। তারই একটা ত্রিফলার মতো শিকে মায়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে রেখেছিলেন গৃহকর্ত্রী। মা এক সময় আমায় বলল, ব্যাগটা নিয়ে এসো তো। আমি উদ্যোগ করতেই, ও বাড়ির মেয়েও সেই একই কাজে হাত লাগাতে গেল। দুজনেই এক সঙ্গে লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য লাফালাম, কে আগে নিতে পারে ব্যাগটা। গেটটা স্লাইড করে পড়ে গেল। লেগে, মেয়েটির ভুরুর ওপর কেটে গেল। খুব, খুব রক্ত পড়ছিল। আমার মা-বাবা লজ্জায় আকুল। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিকে নিয়ে ছুটল। ডাক্তার-হাসপাতাল-স্টিচ শেষে যখন বাড়ি ফিরল, রাত দশটা। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না বলে খেলাম না। মা জোর করল না।

Advertisement

শোওয়ার সময় হাঁটুর ওপর ফ্রকটা তুলে মা’কে দেখালাম, ‘মা, আমারও কেটে গিয়েছে।’ হাঁটু থেকে থাইয়ের শেষ পর্যন্ত এমন কেটে গেছে যে ফাঁক হয়ে আছে। আমি শুধু একটা ক্রিম লাগিয়ে কাটাটাকে দুদিক দিয়ে চেপে ধরে রেখেছিলাম। দেখে মা চমকে উঠল! স্টিচ করার সময় পেরিয়ে গেছে। মা উঠে আরও একটা ক্রিম লাগিয়ে, ব্যান্ডেজ করে দিল। বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘তুমি না আমার সাহসী মেয়ে?’

মায়ের ভেতরে যে কী কষ্ট হয়েছিল, এখন বুঝতে পারি। জানি, মা নিজেকে বার বার কত বার দুষেছে। আমায় কত বার বলেছে, ‘আমি সরি বাবু।’ এও জানি, আমার যন্ত্রণার কথা প্রকাশ না করে আমি ভালই করেছিলাম। অন্যের বাড়ি গিয়ে থাকতে হচ্ছে, তাদের মেয়ে আমার জন্যেই পড়ে গেল, আমার দিকে সবাই অভিযোগের চোখে তাকাচ্ছে, এর মধ্যে আর নিজের ঝরঝর রক্তের কথাটা বলতে পারিনি।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে দিন খুব কেঁদেছিলাম। আমার কাটা, আমার ব্যথা, আমার লেগেছে কি না, মা বুঝতেও পারল না? নিজের আগে অন্যের কথা ভাবাই ওদের চরিত্রের গুণ। বা দোষ। আমি কেবল দেখছিলাম, ওই মেয়েটিকে নিয়ে আমার মা-বাবা পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে। আর আমি? আমার বুঝি লাগেনি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন