ছবি: সুমন চৌধুরী।
হাতিবাগানের বড় রাস্তা থেকে পুব দিকে বিডন স্ট্রিট বরাবর হাঁটছি। একটু খোঁজাখুঁজির পর দেখা মিলল সারকারিনার— একদম ভাঙাচোরা, হলদে রঙের, খেলনা-খেলনা দেখতে একটা বাড়ি। ভেতরে ঢুকতে দেখি, ছোট্ট একটা লবি এঁকেবেঁকে চলে গেছে ছোট ছোট কতকগুলো খাঁচার পাশ ঘেঁষে, যেগুলো এক কালে টিকিট-ঘর ছিল। লবিটা শেষ হয়েছে একটা অন্ধকার, আঁকাবাঁকা প্যাসেজে, মনে হচ্ছিল যেন একটা ময়লাটে কারখানার মধ্যে এসে পড়েছি। আঠা, নতুন কাগজ, মেটাল আর মেশিনের তেলের গন্ধে ভেতরের বাতাস ভারী হয়ে আছে।
প্যাসেজটা ধরে চলতে চলতে কতকগুলো সিঁড়ির দেখা পাওয়া গেল। এক কালে যেখানে ছিল অডিটোরিয়াম, সে জায়গাটার ওপরের ধাপে দেখি একটা বাড়ি। বোঝাই যাচ্ছে, কেউ থাকেন। দেওয়ালে পুরনো দিনের সব নাটকের পোস্টার, সস্তা রঙচঙে ফ্রেমে বাঁধানো। এক ধারে একটা লোহার গেট, বহু পুরনো, শিরা বের-হওয়া। কত কাল ধরে যে সামনের প্যাসেজটাকে আগলে রেখেছে কে জানে। এখন নেহাতই এক রাশ মরচের স্তূপ। গেটে দাঁড়িয়ে এক বয়স্কা পরিচারিকা আর দুটো বেড়াল। আগন্তুককে দেখে তিন জনই চমকিত।
মহিলাটি অমর ঘোষকে ডেকে দিলেন। তিনিই সারকারিনার মালিক। লম্বা, শান্ত স্বভাবের এক জন ভদ্রলোক, দেখে মনে হল বয়স সত্তরের কোঠায় হবে। পরে জানলাম, তাঁর এখন তিরাশি চলছে।
অমরবাবু কথা বলছিলেন অগোছালো ভাবে, থেমে থেমে, কিন্তু খুব উৎসাহ নিয়ে বলছিলেন— কী করে নিজের বসতবাড়ির নীচতলাটা পালটে ফেলেছিলেন আস্ত, মস্ত একটা থিয়েটারে। ১৯৭৫-এ তৈরি হওয়া সারকারিনা হয়তো ‘স্টার’, ‘মিনার্ভা’ বা ‘রঙমহল’-এর মতো পুরনো থিয়েটার ছিল না। কিন্তু ‘উত্তর কলকাতার থিয়েটার’ বলতে অন্তত যে একশো বছরের ইতিহাসটাকে বুঝি, সারকারিনা তার শেষটুকুকে ছুঁয়েছিল। আর ১৯৭০-১৯৯০ সময়টাতে তো সে রীতিমত সেনসেশন, এই গোটা এলাকাটাকে লোকে চিনত সারকারিনার সূত্রে। অমরবাবু নিজে এক কালে ছিলেন ফিজিক্সের শিক্ষক, অ্যামেচার আর্কিটেক্টও। কিন্তু থিয়েটার ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। সারকারিনা সেই থিয়েটার-প্রেমেরই ফসল। তিনি বিশ্বাস করতেন, থিয়েটার আসলে এক চোখ-ধাঁধানো দেখনদারি, শোম্যানশিপ। তাই নিজে এমন সব নাটক লিখতেন, যেগুলোর অভিনয় সম্ভব ছিল শুধু সারকারিনার মতো জাদু-থিয়েটারেই।
অমরবাবুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার মনে পড়ছিল শ্যামবাজারের বাবু নবীনচন্দ্র সেন-এর কথা। নবীনচন্দ্র ১৮৩৫ সালের কলকাতা শহরে, এক রাতে দু’লক্ষ টাকা খরচা করেছিলেন, একটা নাটক ‘নামাতে’! সারা রাত ধরে চলেছিল ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’। সেটা এমন চোখ-ধাঁধানো, জমকালো উৎসবের চেহারা নিয়েছিল, তাকে স্রেফ নাটক বললে অবিচার হবে। সেনদের প্রাসাদের মতো বাড়িতে, কোনও ‘সিন’ ফেলা হয়েছিল শোওয়ার ঘরে, কোনওটা বাগানে, কোনওটা আবার পুকুরের ধারে। জনা তিনশো দর্শকও, সিন-মাফিক ঘুরছিলেন এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। শুধু ঘুরছিলেন না, তার সঙ্গে তাঁদের মুখ চলছিল! ছিল দারুণ সব খাবারদাবারের এলাহি আয়োজন, অফুরান খাঁটি বিলিতি মদ। সেনবাড়ির ঘরগুলোর তলা দিয়ে খোঁড়া হয়েছিল অনেকগুলো সুড়ঙ্গ, যেগুলোর মধ্যে দিয়েও মাঝে মাঝে দর্শকদের যেতে হচ্ছিল, তাতে আরও জমে উঠছিল রোমাঞ্চ। শহরের চার জন খুব দামি গণিকাকে নিয়ে আসা হয়েছিল নারীচরিত্রগুলিতে অভিনয়ের জন্য। তাদের গা-ভর্তি ঝলমল করছিল আসল সোনার গয়না। এক রাতের এই দু’লাখি মচ্ছবের জেরে সেনমশাইকে আর একটা আলিশান বাড়ি বেচতে হয়েছিল।
এ জিনিসের যে মজা, যে রগরগে কার্নিভালের আমোদ, তাকেই বয়ে নিয়ে চলেছিল উত্তর কলকাতার পেশাদার থিয়েটার। ইন্ডিয়ান পিপল্’স থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সূত্রপাত ও বাংলায় গ্রুপ থিয়েটারের গোড়াপত্তনের পর, এই ‘কমার্শিয়াল’ নাটককে একটু নিচু চোখে দেখা শুরু হয়। জমিজিরেত-টাকাপয়সাওলা লোকদের ভোগবাদে যে থিয়েটারের শেকড়, যে থিয়েটার বাজার থেকে পয়সা তোলে, লাভের খোঁজ করে, গ্রুপ থিয়েটারের মানুষরা তাকে দেখতেন ক্ষয়িষ্ণু বিনোদন হিসেবে। যে নাটক মানুষের কথা বলে না, স্রেফ কতকগুলো সেনসেশনাল আর সেন্টিমেন্টাল গল্প ফাঁদে, চোখ-ধাঁধানো সব কায়দা-কেতা দিয়ে কেল্লা ফতে করতে চায়। অ্যাকাডেমিতে ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ থিয়েটারের দিকে সরকারেরও বেশ কিছুটা পক্ষপাত ছিল। তবে সে সবের জন্য নয়, পেশাদার থিয়েটার হলগুলো এক সময় যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরেই, তার দর্শক হারাল। বেশ কিছু দিন ডাইনোসরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে থেকে তারা আস্তে আস্তে হয়ে গেল বিয়ে-টিয়েতে ভাড়া দেওয়ার বাড়ি, বা ডিপার্টমেন্ট স্টোর।
সারকারিনার মঞ্চে অমর ঘোষ। ছবি সৌজন্য: কমল সাহা, বাংলা নাট্যকোষ পরিষদ
সারকারিনা তখনও আছে, কিন্তু আসলে নেই। অমরবাবু আমাদের নীচে, সারকারিনার অডিটোরিয়ামে নিয়ে গেলেন। প্রথম দেখায় অডিটোরিয়ামটাকে মনে হল খুব ছোট, যেন এখানে থিয়েটার নয়, পুতুলনাচ-টাচ মানানসই হবে। আমরা গ্যালারিতে ঢুকে, মাকড়সার জালে ভরা সার সার সিটের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম ঠিক মধ্যিখানের গোল কাঠের পাটাতনটা অবধি। অমরবাবু ডেকে পাঠালেন সারকারিনার একমাত্র কর্মীটিকে। সে ছাড়া আর কেউই অবশিষ্ট নেই। মধ্যবয়স্ক, ভবঘুরে-চেহারার এক জন লোক, মুখে মদের গন্ধ। কতকগুলো ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলাম, দু’পাশে ভাঙা আসবাব, বেতের তৈরি এটা-ওটা, বস্তা, দোমড়ানো বিলবোর্ড ডাঁই করা। সব কিছুর ওপর ধুলোর আস্তরণ। পেরিয়ে গেলাম বেশ কয়েকটা গ্রিনরুম, সেখানে আয়না ধুলোমাটিতে আবছা, ছোট ছোট কতকগুলো স্পিকার পড়ে আছে, যেগুলো এক কালে নাটকের ঘোষণায় কাজে লাগত।
বেসমেন্টে পৌঁছলাম। পুরনো সব সেট-এর অজস্র টুকরোটাকরায় ভর্তি সে জায়গাটা— ড্রেসিং টেবিল, হুইলচেয়ার, ভাঙা চেয়ারটেবিল। এক কোনায় একটা সুইচবোর্ড, সমস্ত স্টেজ লাইট সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হত।
সারকারিনার সব-সেরা জাদুর সুইচটা ছিল ওখানেই— চোঙার মতো দেখতে একটা কাচের বাক্সের মধ্যে লাল-রঙা একটা লিভার। অমরবাবুর কথায় তাঁর সহকারী লিভারটা টানল, আর প্রায় নিঃশব্দে বিশাল স্টেজটা নীচে নেমে গেল, গোটা ঘরটায় ছড়িয়ে থাকা হলদে আলোর ওপর মস্ত ছায়া ফেলে।
এ ভাবেই কাজ করত সারকারিনার ম্যাজিক। স্টেজের চার পাশে গোল করে ঘিরে থাকত একটা গ্যালারি। আর স্টেজের ঠিক তলায় ছিল বিরাট, মস্ত একটা গর্ত। একটা সিন শেষ হতেই, স্টেজটা ঝপ করে সেঁধিয়ে যেত সেই অদৃশ্য গর্তে, আর খানিক পরেই উঠে আসত একেবারে অন্য একটা রঙচঙে ঝকঝকে সিন, একদম নতুন সেট, নতুন সিনের অ্যাক্টরদের নিয়ে। আমার মা-বাবাদের প্রজন্মের কাছে, সারকারিনা ছিল গায়ে কাঁটা দেওয়া একটা জায়গা, যাকে কক্ষনও ভোলা যায় না।
টেকনিশিয়ান লিভার টানলেই, তেলের ওপর ভাসা একটা হাইড্রলিক পিস্টন বরাবর স্টেজটা নেমে আসত নীচে। সঙ্গে নেমে আসতেন অভিনেতারাও, টুপ করে নীচের গ্রিনরুমে ঢুকে সাজপোশাক পালটে নিতেন, আর ও-দিকে ব্যাকস্টেজ কর্মীরা বদলে দিতেন সিন-এর সেটিং, ব্যাকড্রপ।
সারকারিনা আসলে ছিল এমন একটা থিয়েটার, যার ব্যাপ্তি সার্কাসের মতো। কিন্তু এত দিন পর আমার কাছে তাকে মনে হচ্ছিল ছোট্ট, খুব ছোট্ট। কী জানি, হয়তো ওই ধুলো আর অন্ধকারের জন্য হবে! হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে শুকিয়ে, কুঁকড়ে গেছে জায়গাটা!
সারকারিনায় গিয়েছিলাম রিসার্চ করতে, আমার একটা উপন্যাসের জন্য। সেই ইংরেজি উপন্যাসটা হবে একটা ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে, যার মা উত্তর কলকাতার কমার্শিয়াল নাটকে অভিনয় করেন। ওই সার্কুলার থিয়েটার আর স্টেজ ওঠা-নামা দেখেই আমার মনে হল, এটাকে কোনও একটা ভাবে উপন্যাসটায় লাগিয়ে দিতেই হবে।
সারকারিনার স্বর্ণযুগে, হপ্তায় তিন দিন গ্যালারি-ভর্তি দর্শকের চোখের সামনে এই বিখ্যাত স্টেজ নামত আর উঠত। বৃহস্পতি, শনি আর রবি— এই তিন দিন প্রফেশনাল থিয়েটারের অভিনয় হত। সে-সব দিনের কথা শুনেছি গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ইনি সে-যুগের সারকারিনায় অমরবাবুর নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছেন ‘তুষারযুগ আসছে’, ‘হ্যালো চুমকি’, ‘করিৎকর্মা’র মতো সুপারহিট নাটকের গল্প, সে-সব নাটকের স্ক্রিপ্ট, পরিচালনা আর সেট ডিজাইনে অমরবাবু কেমন তাক-লাগানো সমস্ত ভাবনা সত্যি করে তুলেছিলেন। কিন্তু গ্রীষ্মের সেই দুপুরে, টিকিট-কাউন্টারের পাশে জানলাবিহীন ঘুপচি একটা ঘরে (এক কালে যেটা ছিল সারকারিনার অফিস) বসে অমরবাবু বলছিলেন, আজ তাঁর ছানি অপারেশনেরও পয়সা নেই, পেনশনের পুরোটা চলে যায় বন্ধ সারকারিনার দেখভালে। এক দশকেরও বেশি বন্ধ হয়ে গেছে থিয়েটারটা, এখন মাঝেসাঝে স্থানীয় ক্লাব দু’একটা গানের জলসা করে, বা হাতিবাগান বাজার ব্যবসায়ী সমিতির মিটিং বসে কখনও। অমরবাবু এখন লবি আর নীচের হলঘরটা বই-বাঁধাই করা ব্যবসায়ী, আর ওয়েল্ডারদের ভাড়া দেন। তা থেকে মাসে হাজার দশেক আয় হয়। ঢোকার সময় আঠা আর তেলের গন্ধ নাকে এসেছিল, মনে পড়ে গেল।
ব্যাকড্রপে ঘুমিয়ে-পড়া, একাকী এক থিয়েটার। তার সামনে বসে-থাকা অমরবাবুর মুখে শুনলাম হাতিবাগানের থিয়েটারের বিস্মৃতিতে তলিয়ে যাওয়ার গল্প। শেষের শুরু হয়েছিল টেলিভিশনের হাত ধরে, অমরবাবু বলছিলেন। আশির দশকের শুরুতেই আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হচ্ছিল বোকাবাক্স। দোসর ছিল ভিডিয়ো ক্যাসেট-প্লেয়ার। এই দুইয়ের হাত ধরে সটান বাঙালির বেডরুমে ঢুকে পড়ল বিনোদন। প্রযুক্তি ছিনিয়ে নিল নাটকের দর্শককে, আর যাত্রা-পার্টিরা ফুসলে নিয়ে গেল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের, বেশি পয়সার লোভ দেখিয়ে।
মুমূর্ষু সন্তানকে আগলে থাকার মতো, সারকারিনাকে আঁকড়ে আছেন অমরবাবু। ব্যতিক্রমী এক মানুষ, বলতেই হবে। আর সব থিয়েটারগুলো চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে, যাদের কাছে ওই বড় বড় বাড়ি, তার সম্পত্তি-মূল্যই আসল, নাটক নয়। অনেকগুলো থিয়েটারে রাতের অন্ধকারে আগুন লেগেছে। বিমা-টিমার ব্যাপারগুলো মিটিয়ে নেওয়ার পর এক দিন দেখা গেছে, থিয়েটারগুলোর জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে মস্ত অ্যাপার্টমেন্ট, বিশাল ডিপার্টমেন্ট স্টোর। সারকারিনাকে ঘিরেও শকুনের ওড়াউড়ি কম হয়নি। এক কালের রমরমা থিয়েটার আজ গোটা পরিবারটাকে ঋণে ডুবিয়ে রেখেছে, অমরবাবুর ছেলের মত এমনটাই। লোকে ভয় দেখিয়েছে, মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে অমরবাবুকেও। পাত্তা দেননি। এখনও পাড়ায় তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা— কে ওঁকে স্পর্শ করবে? তবু ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা করেন।
উপন্যাসটা শেষ হয়েছে, প্রকাশিতও হয়েছে এ বছর, নাম ‘দ্য ফায়ারবার্ড’। এক কপি অমরবাবুকে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু গত বছর জানুয়ারিতে অমরবাবু মারা গেছেন। সময়টা তো মরে গেছিল অনেক আগেই— হাতিবাগানের থিয়েটারগুলোও। কয়েকটা থিয়েটার হল এখনও দাঁড়িয়ে, ব্যস্ত রাজপথ আর হুল্লুড়ে গলিগুলোর পাশে, চামড়া-কুঁচকোনো বুড়িদের মতো। এই যে একটা দারুণ রঙচঙে সময় শেষ হয়ে গেল, যেন ঝলমলে নাটকের পর নিষ্ঠুর পর্দা পড়ে গেল একটা, যেন গোল স্টেজ নেমে গেল কিন্তু নতুন চমক নিয়ে আর উঠে এল না— এই মন-খারাপটা ঝুপ করে সন্ধেবেলার মতো মাঝে মাঝে আমার ওপর নেমে আসে।
majumdar@stanford.edu
আলো ছায়ার নাচ
অরি যখন ওর মা’কে প্রথম বার মারা যেতে দেখে, তখন ওর পাঁচ বছর বয়স।
ওকে ঘিরে তখন এক দল লোক ঝালমুড়ি চিবোচ্ছিল। তাদের মুখে ছিল লালচে হলুদ আলোর ছায়া। অরিকে জড়িয়ে ধরে হাত দিয়ে ওর চোখ আড়াল করে ওরা ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আরে বাবা অন্য দিকে তাকা। এটা তোকে দেখতে হবে না।’ একে অপরকে বলছিল, ‘যাঃ, ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেই হত।’
অরির গায়ে আলগোছে হাত বোলাচ্ছিল ওরা। কিন্তু সামনের ওই মন্থর আলো ছায়ার নাচ— যাতে ভেসে অরির মা মৃত্যুর দিকে চলেছিল— তা থেকে তখন কেউ চোখ সরাতে পােরনি। অরি দেখল, সুতির চাদর আর উলের শাল জড়ানো শরীরগুলো থেকে কয়েকশো কালো কালো মাথা স্থির তাকিয়ে আছে সামনের খোলা মাঠের দিকে— তার মায়ের মৃত্যুযন্ত্রণায় সবাই সম্মোহিত। অরির বাবা হঠাৎ অরিকে জড়িয়ে ধরল। ‘কী রে, কাঁদছিস কেন?’ বাবার গলায় ঠাট্টা। ‘ধুর বোকা।’
অরি একটুও চেঁচায়নি। কিন্তু ওর চশমার কোনাগুলো চোখের জলে উপচে পড়ে পৃথিবীটা হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গেল। পেটের মধ্যেটা কী রকম গুলিয়ে উঠল। গা-টা বড্ড গরম। ঝাপসা আলোয় দেখল মা মাটিতে, মাথাটা পিছনে হেলে পড়েছে। জীবনের শেষ লেশটুকু চলে গেছে শরীর থেকে। লম্বা চুল মাটিতে বিছানো, ঠিক যেন ছড়ানো গাঢ় রক্ত। আস্তে আস্তে অরির শরীরে স্বস্তি ফিরে এল। জ্বরটা কোথায় চলে গেল। গা ভিজে গেল ঘামে।
অরি খেয়ালও করেনি কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবা হঠাৎ ওর হাত ধরে টানল। ‘আয় এ বার।’ অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে নিয়ে চলল ওকে, ফিসফিস করে বলল, ‘আমার হাতটা ধর। টাইট করে।’
নড়বড়ে কাঠের পাটাতনের তলা দিয়ে ওরা আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে চলল। ইলেকট্রিক তােরর শিরা ভর্তি সরু প্যাসেজটা পেরোতেই এল ঝকঝকে সাদা আলো আর দৈত্যাকার আয়না ভরা ছোট্ট ঘরটা, যেটা ও দেখবে আরও বহু বার, পরচুলা, মেকআপ, তুলোর গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসা সেই ঘরটা।
মা’র গায়ে তখনও জমকালো শাড়ি, ভারী সোনার গয়না, পিঠের ওপর চুলের লম্বা ঘন ধারা। সামনের আয়নায় অরির প্রতিবিম্ব দেখে মা হাসল। অদ্ভুত সেই হাসি।
‘দ্য ফায়ারবার্ড’ উপন্যাসের অংশ। ইংরেজি থেকে অনূদিত।