ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস

স্বাধীনতা তুমি...

আতংকের রং কী? কথাটা ভাবতে ভাবতেই একটা আকারহীন অন্ধকারের গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছিল অর্ণব। অথচ বাইরে তখন চতুর্দিকে আকাশ, চতুর্দিকে আলো, অনাবিল এক মধ্য দুপুরবেলা।

Advertisement

সঞ্জয় দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

Advertisement

অপরিচিত অন্তিম

আতংকের রং কী? কথাটা ভাবতে ভাবতেই একটা আকারহীন অন্ধকারের গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছিল অর্ণব। অথচ বাইরে তখন চতুর্দিকে আকাশ, চতুর্দিকে আলো, অনাবিল এক মধ্য দুপুরবেলা।

Advertisement

আর ঠিক সেই দিন, সেই সময় কলকাতাগামী ট্রেনে, ভিড়ে ঠাসা কামরায় অর্ণব মুখার্জির থাকার কথাই নয়। কে যেন বলেছিল মৃত্যুর রং আছে। কে বলেছিল কথাটা? প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করছে অর্ণব, কিন্তু তার কিছুতেই মনে পড়ছে না! যে-ই বলে থাক, কথাটা সত্যি। মৃত্যুর এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রঙের ছটা দেখতে পাচ্ছে সে। আকাশের ঝকঝকে নীল, ছড়িয়ে থাকা মাঠ-ঘাটের ধূসর সবুজ, দুপুরের জ্বলন্ত শুভ্রতা।

এক বার কেঁপে উঠেছিল শুধু মানুষটা। দরজার কাছে এক চিলতে জায়গায় বসে থাকা অবস্থাতেই। মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট গোঙানি, তীব্র যন্ত্রণা, ভয়, বিস্ময়ে একাকার একটা অস্ফুট আর্তনাদ। পূর্ণ অবয়ব পাওয়ার আগেই গলায় আটকে গেল শব্দটা। বৃদ্ধ ঢলে পড়েছে সামনের দিকে। এত ক্ষণ শম্বুকগতিতে এগোচ্ছিল ট্রেন। সিগন্যাল ছিল না বোধহয়। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গতি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অসাড় দেহটা এক দিকে টান খেয়ে গেল। চোখের দৃষ্টি নিথর। ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক করা। মুখ দিয়ে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিল বোধহয়। পরনের ফতুয়াটার রং জ্বলে গেছে, ছাপা কাপড়ের ঢলঢলে পোশাকটার সারা গায়ে ছোট ছোট পাখির মাথা আঁকা। বাঁ দিকে, বুকের কাছে একটু একটু করে বাড়তে থাকা লালচে-খয়েরি ছোপটা যে আসলে রক্তের দাগ, সেটা অর্ণব প্রথমে বুঝতেই পারেনি।

কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা। তার পরেই আশপাশের যাত্রীরা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল বৃদ্ধ মানুষটির উপর। চলমান ট্রেনের কামরা মুহূর্তে মুখর।

‘কী হল, দাদা?’

‘আর কী হল! খেলা শেষ।’

‘কী করে হল? এই তো বসে ছিল!’

‘হার্ট অ্যাটাকের মতো মনে হচ্ছে। সঙ্গে কে আছে? সঙ্গে?’

‘হার্ট অ্যাটাক? জামায় ওই দাগটা কীসের?’

‘আরে সরুন, সরুন, একটু দেখতে দিন।’

‘আপনি দেখে কী করবেন? আরে, কেউ চেনটা টানুন না!’

‘চেন টানলে আজকাল ফাইন হয়, জানেন না?’

‘কেউ ডাক্তার আছেন ভাই? ডাক্তার?’

‘হোমিওপ্যাথি চলবে?’

ভিতর থেকে খুক খুক চাপা হাসির শব্দ।

অর্ণব তখন আলোর বাজনা শুনতে পাচ্ছে! আলো কি বাজে? হঠাৎ ছেলেবেলায়, স্কুলের চ্যাপেলে, রবীন্দ্রজয়ন্তীর নিয়মিত গানটার মনে পড়ল ‘বাজে আলো বাজে, ও ভাই, হৃদয়বীণার মাঝে—’। বাজছে তো! জীবন আর মৃত্যুর ঠিক মাঝখানের মুহূর্তটিতে দাঁড়িয়ে অর্ণব আলোর বাজনা শুনে বুঝতে পারল, সেটা রবীন্দ্রনাথের গানের সুর না, বেঠোভন-এর ফিডেলিয়ো। বে-এ-ঠো-ভ্‌-ন, ঠিক এই ভাবে টেনে টেনে উচ্চারণ করতে শিখিয়েছিলেন মিস্টার ডাট। দত্ত বলা চলত না তাদের সাহেব ইস্কুলে— মিস্টার ডাট। সেই বেঠোভন-এর ফিডেলিয়োর ওই সুরেই আলো বাজছে।

সহযাত্রীরা যখন রক্তাক্ত দেহটার উপর হামলে পড়েছে, হুড়োহুড়ির মধ্যে কেউ চেন টেনে দিয়েছে, ঝাঁকুনি দিয়ে আবার থেমে গেছে ট্রেন, ঠিক তখনই অর্ণব বুঝতে পারল, তার পকেটের বিদেশি মোবাইল বেজে চলেছে বেঠোভন-এর ফিডেলিয়োর ছন্দোময় রিং টোনে।

অভ্যাসের বশেই ডান হাত চলে গেল পকেটে। রঞ্জনা। ওখানে এখন ক’টা বাজে? কবজির ঘড়িতে এখন একটা সাঁইত্রিশ। দুপুর। তার মানে লন্ডনে সকাল ন’টা সাত। ও-দেশে এখন সামার টাইম। সাড়ে চার ঘণ্টা পিছিয়ে। ফোন ততক্ষণে ভয়েস মেলে চলে গেছে। ‘তুমি কোথায়? ফোন ধরছ না কেন? আজই তো কলকাতায় ফেরার কথা তোমার। কাল থেকে কোনও খবর পাচ্ছি না। এটা পেলে এক বার ফোন কোরো কিন্তু,’ রঞ্জনার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর শুনতে পেল অর্ণব। কিন্তু সেই মুহূর্তে সে ফোন ধরার অবস্থায় নেই!

‘এই তো স্যার, এই কামরায়!’

‘কী হয়েছে? কী হয়েছে এখানে? অ্যাঁ? চেন টেনেছেন কে?’

‘সরুন, সরুন গেট থেকে সরুন। উঠতে দিন ভাই।’

দরজার হাতল ধরে উঠে এসেছেন তিন জন। ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছেন ভিড় ঠেলে। এক জন নিশ্চয়ই গার্ড। বাকি দুজনকে দেখে মনে হয় টিটি গোছের কেউ হবেন। তিন জনেরই পরনে রেলের কালো কোট। মলিন সাদা ট্রাউজার। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসা এই পোশাকটা এখনও বদলায়নি! কিন্তু কালো টুপিটা আর দেখা যায় না তেমন! কথাটা মনে হতেই এই অবস্থায়ও একটু অবাক হল অর্ণব। হঠাৎ হঠাৎ, নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই কী অদ্ভুত সব কথা আজকাল মনে আসে! রেলের তিনজন কর্মকর্তাকে দেখে যাত্রীদের কোলাহল আরও বেড়ে গেল যেন! নিথর দেহটা তখনও দরজার কাছেই।

‘সরুন, সরুন। একটু জায়গা দিন ভাই। দেখতে দিন আমাদের।’ ভিড় ঠেলে তিন জনই ঝুঁকে পড়লেন নিস্পন্দ বৃদ্ধের উপর।

চতুর্দিকে অবিরাম প্রশ্নবাণের কোনও বিরাম নেই। মাঝে মাঝে কটূক্তি, শ্লেষ, ছুটকো-ছাটকা মন্তব্য। ধাক্কাধাক্কিতে একটা বাথরুমের দরজা খুলে গেছে কখন যেন! ঝাঁঝালো কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চার দিকে। ঘামের গন্ধ, শরীরের গন্ধ, কারও মাথার চুলের সস্তার সুগন্ধি তেল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মৃত্যুর গন্ধ কী এই রকমই?

কামরার ভিতর দিকে অনেকগুলো মাথা। অনেকেই গলা বাড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করছে দরজার কাছে কী হচ্ছে। কেউ কেউ আবার ঠেলেঠুলে সামনে আসারও চেষ্টা করছে। যাকে ঠেলছে তিনি গলা তুলে ঝগড়া করছেন। ভিড়ের মধ্যে কোথাও একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল। কেমন যেন দিশেহারা লাগছে অর্ণবের, মাথা ঝিম ঝিম করে উঠছে! ‘আপনি এখানে?’

প্রশ্নটা শুনে সচকিত হয়ে লোকটির দিকে তাকাল সে। গার্ডসাহেবের সঙ্গে যে দুজন কামরায় উঠেছেন তাঁদের মধ্যেই এক জন। রোদে পোড়া, তামাটে চেহারা। একটু থলথলে। মাথার সামনের দিকটায় চুল পাতলা হয়ে এসেছে। একটা চোখে বোধহয় ছানি পড়েছে। ঘোলাটে চাহনি। পান খাওয়া ঠোঁটের ফাঁকে অমসৃণ, খয়েরি দাঁতের সারি। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে আছেন।

কয়েক ঘণ্টা আগেই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হয়েছে অর্ণবের। সাধারণ, হালকা আলাপচারিতা। এসি ফার্স্ট ক্লাস কামরার কন্ডাক্টর গার্ড। দিল্লি থেকে এই ভদ্রলোকই এসেছেন তাদের সাথে।

‘আরে মধুপুরে একটু চা খেতে নেমেছিলাম। হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে দেখি ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। তখন দৌড়ে উঠে পড়তে হল যে কম্পার্টমেন্ট সামনে পেলাম, সেটাতেই। ভাবলাম পরের স্টেশনে থামলেই ফিরে যাব নিজের সিটে। এর মধ্যে দেখুন কী কাণ্ড!’

‘আপনি তো একা ট্র্যাভেল করছেন?’

‘হ্যাঁ, একাই। সুটকেসটা এসি ওয়ানে পড়ে আছে।’

‘ভয় নেই। খোয়া যাবে না। এসি ওয়ানে রিস্ক কম। তা ছাড়া, এত ক্ষণ তো ট্রেন চলছিল। কিন্তু এখানে কী হল বলুন তো? দেখলেন কিছু?’

‘ঠিক কী হয়েছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না! এখানেই তো বসে ছিল লোকটা।’

অর্ণবের মনে হল, তার কথা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না ভদ্রলোক।

‘এ তো স্পট ডেড মনে হচ্ছে। ডাক্তার কেউ আছেন কি এখানে?’

গার্ডসাহেব এত ক্ষণ নিচু হয়ে দেখছিলেন নিথর বৃদ্ধকে। উঠে দাঁড়ালেন। কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ আর বিরক্তি মাখামাখি হয়ে আছে।

চার পাশের কোলাহল একটু স্তিমিত হয়ে এসেছিল। এক অপরিচিত সহযাত্রীর মৃত্যু ঘোষণায় আবারও মুখর হয়ে উঠল দিল্লি থেকে কলকাতাগামী পূর্বা এক্সপ্রেসের জেনারেল কম্পার্টমেন্ট। মৃত্যু কী ভাবে হল, সে সম্বন্ধে কারও স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু তাতে কী? নিজস্ব মতামত জানাতে কোনও দ্বিধা নেই কারও। মৃতের বুকের কাছে গেঞ্জির ওপর স্পষ্টতই রক্তের ছোপ। কিন্তু কোনও মারামারি, এমনকী বচসাও হয়নি কামরায়। বৃদ্ধকে কেউ আঘাত পেতে দেখেনি। কেউ কোনও শব্দও শোনেনি। তাই জল্পনা তুঙ্গে উঠতে সময় লাগল না।

ট্রেনের গার্ড তত ক্ষণে হাতে ধরা ওয়াকি টকি’তে কথা বলতে শুরু করেছেন। মুখ তুলে তাকালেন একটু পরে।

‘এর সাথে কেউ আছেন? আছেন কেউ?’

বার তিনেক জোর গলায় প্রশ্নটা কামরার যাত্রীদের উদ্দেশে ছুড়ে দিলেন গার্ডসাহেব। কিন্তু বৃদ্ধ লোকটির জন্য কেউ এগিয়ে এল না। সহযাত্রীরা কেউই চেনে না লোকটিকে। সে একাই ছিল বোধহয়। কারও সঙ্গে কথাও বলেনি। তাই কোথা থেকে আসছে সে, কোথায় যাচ্ছিল, কেউ জানে না।

‘আমি ট্রেন আবার চালু করছি। সামনেই চিত্তরঞ্জন। সেখানে জিআরপি’র হাতে বডি তুলে দেওয়া হবে। তত ক্ষণ কেউ ডেডবডি ছোঁবেন না প্লিজ। সুবিমলবাবু, কাঞ্চনদা, আপনারা থাকুন এখানে।’ সঙ্গের দুজনকে নির্দেশ দিলেন গার্ডসাহেব।

‘আপনি বরং আপনার কামরায় ফিরে যান,’ সুবিমলবাবু বলে যাঁকে সম্বোধন করা হল, সেই ভদ্রলোকই তাহলে এসি ওয়ানের কন্ডাক্টর গার্ড!

কথাটা তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা। সম্বিৎ ফিরে পেল অর্ণব।

‘ইনি চা খেতে নেমে এই কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়েছেন, স্যর,’ গার্ডসাহেবের নির্বাক প্রশ্নের জবাবে সুবিমলবাবু তড়িঘড়ি ব্যাখ্যা করলেন।

‘আমার সাথেই আসুন তা হলে।’

জেনারেল কামরার সঙ্গে পাশের কামরার সংযোগ স্থাপনকারী ভেস্টিবিউল দরজাটা তত ক্ষণে খুলে দেওয়া হয়েছে। গার্ডের আহ্বানে সে দিকে পা বাড়াল অর্ণব। মাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে। দরজার পাশে ছোট্ট একটা লোহার হ্যান্ডেল। বাঁ হাত দিয়ে সেটাকে আঁকড়ে ধরে শরীরের ভারসাম্য সামলানোর চেষ্টা করল। আর ঠিক তখনই ব্যথাটা টের পেল সে। তীক্ষ্ণ বেদনা ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিটি স্নায়ুর আনাচে-কানাচে। কেউ যেন সজোরে ধাক্কা দিল তাকে, হঠাৎ।

• (ক্রমশ) •

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement