ছবি: সুমিত্র বসাক
আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল সন্দীপনবাবুর। মশারির মধ্যে দিয়েই দেখলেন, হাফ পরদা ঢাকা জানলার ফাঁক দিয়ে আকাশে একটা ফিকে আলো ফুটে রয়েছে। বড়দিনের আদুরে ভোরটা আড়মোড়া ভেঙে উঠছে। কোনও দিন এই সময়ে ঘুম ভাঙে না সন্দীপনবাবুর। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন,আরতি উলটো দিকে মুখ করে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আরতিই চিরটাকাল আগে ঘুম থেকে ওঠেন। তার পর চা করে সন্দীপনবাবুকে ঘুম থেকে তোলেন। তবুও সন্দীপনবাবুর ঘুম ভাঙে না। আরতির দ্বিতীয় বারের ঠেলায় যখন ঘুমটা ভাঙে, তত ক্ষণে গরম চা’টা জুড়িয়ে যায়।
তবে আজ ঘুম ভাঙতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। বড়দিনের ছুটি কাটাতে ছেলে, বউমা, নাতনি আজ সকালের ট্রেনে আসছে। এ বার পুজোয় ওরা আসতে পারেনি। শেষ এসেছিল গত গরমের ছুটিতে। মনটা আঁকুপাকু করছে, বিশেষ করে পিপলিটাকে দেখার জন্য। পিপলির গলার স্বরটা সব সময় কানের কাছে বাজে। যেমন কাল রাত্রে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা দাদু, রাত্রে কি ট্রেনে সান্তা ক্লজ আসে?’
‘আসতেই পারে। তুমি বরং একটা মোজা টাঙিয়েই রেখো।’
‘আমি আসলে সান্তা ক্লজের সিক্রেটটা জানি।’ রহস্য মাখা গলায় বলেছিল পিপলি।
‘কী?
‘সেটা বলতে নেই। বললে সান্তা ক্লজ আর কোনও দিন আসে না।’
‘হুম!’ গলাটা ছদ্মগম্ভীর করে সন্দীপনবাবু বলেছিলেন, ‘সান্তা ক্লজ যদি ট্রেন মিস করে, তা হলে হয়তো বাড়িতেও গিফট’টা পৌঁছে দিয়েও যেতে পারে।’
মশারি তুলে খাট থেকে নামলেন সন্দীপনবাবু। তার পর জানলাটার কাছে এগিয়ে গেলেন। বাইরে থেকে একটা ভিজে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। লম্বা একটা শ্বাস নিলেন। আঃ! প্রাণটা জুড়িয়ে যাচ্ছে। ক’টা বাজে এখন?
বেডসাইড টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে সময় দেখলেন সন্দীপনবাবু। পাঁচটা বিয়াল্লিশ। ওদের ট্রেনটা শিয়ালদায় আসবে সাতটা কুড়িতে। হঠাৎ একটা খেয়াল এল মাথাতে। পিপলিটা বড্ড সারপ্রাইজ পছন্দ করে। স্টেশনে ওদের নিতে গেলে কেমন হয়? হাতে বেশি সময় নেই। তাড়াতাড়ি গরম পোশাক পরে, বেরনোর জন্য রেডি হয়ে মশারির বাইরে থেকে আরতিকে ডাকলেন, ‘শুনছ!’
কয়েক বার ডাকাডাকির পর আরতি একটা অস্পষ্ট গলায় সাড়া দিলেন, ‘উমম্।’
‘আমি একটু বেরোচ্ছি।’
আরতি চোখটা না খুলেই জানতে চাইলেন, ‘কোথায়?’
সন্দীপনবাবু আসল কারণটা বললেন না। আরতি আপত্তি করতে পারে। সকাল সকাল বাজার করে আনার লম্বা একটা লিস্ট ধরিয়ে রেখেছে। গলাটা খাঁকরিয়ে বললেন, ‘এই সামনেই, একটু হাঁটতে।’
‘মাঙ্কি ক্যাপটা পরে বেরিয়ো। ঠান্ডা-ফান্ডা লাগিও না।’
বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন সন্দীপনবাবু। বড়দিনের ভোরটা আর একটু ফরসা হয়েছে। চার দিকে মাটি-ঘেঁষা হালকা একটা কুয়াশা। অনেক দিন পরে সকালটাকে দারুণ লাগছে সন্দীপনবাবুর। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে পৌঁছে একটা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। মিনিট পনেরো দাঁড়িয়েও একটাও ট্যাক্সি পেলেন না। তবে একটু পরেই পেয়ে গেলেন উল্টোডাঙা যাওয়ার একটা অটো। উল্টোডাঙা স্টেশন থেকে একটা ট্রেন ধরে নিলে বেশ হবে। একটা মাত্র স্টেশন পেরোতে হবে। একেবারে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে যাবেন।
অটোটা বাইপাসের মুখে সিগনালে দাঁড়াতেই টুং করে মোবাইলে একটা মেসেজ আসার আওয়াজ পেলেন। মেসেজটা পড়ে মনটা একটু দমে গেল সন্দীপনবাবুর। বউমা মেসেজ করেছে। ‘ঘন কুয়াশার জন্য ট্রেনটা আড়াই ঘণ্টা লেট চলছে। এখনও বর্ধমান ছাড়ায়নি।’ কী করা উচিত? দোনামোনা করে অটো থেকে নেমে পড়লেন সন্দীপনবাবু।
বড়দিনের এই সুন্দর সকালটা, নাতনিকে সারপ্রাইজ দেওয়াটা, কিছুই তো ফেলে যেতে ইচ্ছে করছে না। পিপলি কি মোজা ঝুলিয়ে রেখেছে? সুমন কি খেয়াল করে পিপলির মোজার ভেতর কিছু ঢুকিয়েছে? না হলে উনি যে বলেছেন, ‘সান্তা বাড়িতেও গিফট’টা পৌঁছে দিয়েও যেতে পারে।’ বাড়ি পৌঁছেই পিপলি খোঁজ করতে পারে। সান্তার নাম করে পিপলির জন্য ভাল একটা কিছু একটা কিনতে হবে। এ দিকে দোকানগুলো এত সকালে সব বন্ধ। কাঁকুড়গাছির দিকে দু’-একটা খোলা পাওয়া যেতে পারে। পিপলির জন্য কিছু কিনে ফিরতি অটোটা নাহয় কাঁকুড়গাছি থেকেই ধরবেন।
সন্দীপনবাবু কাঁকুড়গাছির দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। দিব্যি ফুরফুরে লাগছে হাঁটতে। বেশ কিছুটা এগিয়ে ইএসআই হাসপাতালের মোড়ের কোনার দিকে ফুটপাতের ওপর একটা ছোট্ট চায়ের দোকান পেলেন। সকালের চা’টা খাওয়া হয়নি। এক ভাঁড় চা কিনে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এ ভাবে কোনও দিন শহরটাকে দেখেননি। আজ সব কিছু ভাল লাগছে। পিপলিটাকে এ বার সুন্দর এই কলকাতা শহরটা ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। মিউজিয়াম থেকে ইকো পার্ক, এই শহরটার নতুন থেকে পুরনো, কত কিছুই তো নিজেরও দেখা হয়নি।
হঠাৎ দেখতে পেলেন, উল্টোডাঙার দিক থেকে একটা ট্রাম আসছে। দেখে সন্দীপনবাবুর মনে হল, ট্রাম তো বেশ শ্লথ যান। উঠলে বেশ খানিকটা সময় কেটে যাবে। শিয়ালদায় নিশ্চয়ই অনেক দোকান খোলা পাবেন। তা হলে সান্তার গিফট আর সারপ্রাইজ দুটোই হবে। চায়ের দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই এখান দিয়ে ট্রামটা কোথায় যায়?’
ট্রামের দিকে না তাকিয়েই দোকানি বলল, ‘কত নম্বর?’
দূর থেকে নম্বরটা পড়ে সন্দীপনবাবু বললেন, ‘সতেরো।’
‘ধর্মতলা।’
‘শিয়ালদা দিয়ে যায় কি?’
‘যায়।’
রাস্তার মাঝ বরাবর ট্রামটা এগিয়ে এসে লাল সিগনালে থামল। দ্রুত রাস্তাটা পেরিয়ে ট্রামটায় উঠে পড়লেন সন্দীপনবাবু। কত বছর ট্রামে চাপেননি! শেষ কবে চেপেছিলেন মনে করার চেষ্টা করলেন। এক কালে ট্রামের রুটের সব নম্বরগুলো মুখস্থ ছিল।
একেবারে ফাঁকা ট্রামটা। একটা সিটে জবুথবু হয়ে বসে থাকা কন্ডাক্টর ছাড়া এক জন লোকও নেই। সন্দীপনবাবু বেছে বেছে একটা জানলার ধারে বসলেন। সিগনালটা সবুজ হতে টিংটিং করে ঘণ্টি বাজিয়ে ঘরঘর শব্দ করে চলতে শুরু করল ট্রাম। রিটায়ার করার আগে বহু বছর অফিসে গাড়িতেই যাতায়াত করেছেন সন্দীপনবাবু। তখন রাস্তায় ট্রাম দেখতে ভীষণ বিরক্ত লাগত। গাড়িতে বসেই দেখতে পেতেন, ভেতরে নামমাত্র লোকজন। মনে হত, এ যেন সরকারি পয়সায় হাতি পোষা। তার ওপর এর জন্য যখন-তখন ট্রাফিক জ্যাম হয়। কেন যে কোনও সরকারই সাহস করে ট্রামটা তুলে দেয় না!
অথচ আজ সেই ট্রামটাকেই দারুণ আরামদায়ক লাগছে। ট্রামে কোনও দিন পিপলি চাপেনি। সন্দীপনবাবু ঠিক করে ফেললেন, সময় করে ট্রামেও এক দিন চাপাতে হবে মেয়েটাকে। ট্রামে বসে জানলার বাইরে শহরটাকে দেখতে ক্রমশ আরও বেশি ভাল লাগছে। বড়দিন, তার ওপর রবিবার। শহরটা আজ যেন রূপ পালটে ফেলেছে। এটিএমগুলোর সামনে সহিষ্ণু মানুষদের লম্বা লাইন নেই। সেই মানুষগুলোই যেন আজ দল বেঁধে মাইক বাজিয়ে পিকনিকে যাচ্ছে। এই ডিমনিটাইজেশনের অস্থির সময়েও দোকানগুলো দিব্যি সেজেগুজে ঘুমিয়ে আছে। আর একটু বেলা বাড়লেই তারা ঘুম থেকে উঠবে।
হঠাৎ ট্রামের দরজার দিকে চোখ পড়ল। একটা লোক লাফিয়ে ট্রামে উঠল। লোকটাকে দেখে চমকে উঠলেন সন্দীপনবাবু। আরে, এ তো সান্তা ক্লজ! লাল পোশাক, লাল টুপি, এক মুখ সাদা দাড়ি-গোঁফ। চোখে একটা গোল চশমা। কাঁধ থেকে লম্বা একটা ঝোলা ঝুলছে। লোকটা সন্দীপনবাবুর উলটো দিকের জানলার ধারে এসে বসল।
বাঃ! সান্তা ক্লজের সঙ্গে ট্রামে করে পিপলিকে স্টেশনে নিতে যাচ্ছেন, এই গল্পটা পিপলিকে রসিয়ে রসিয়ে বলতে হবে। পিপলি হয়তো জিজ্ঞেস করবে, ট্রামটা কি রেন-ডিয়ার টানছিল? তখন গলাটা রহস্যময় করতে বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু একটা উত্তর দিতে হবে।
জানলার ধারে শহরটা দেখতে দেখতে পিপলিকে কী গল্প বলবেন সেটা ভাবতেই বিভোর হয়ে ছিলেন সন্দীপনবাবু। হঠাৎ চটকটা ভেঙে গেল দুটো গলার আওয়াজে। লোকটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন কন্ডাক্টর। লোকটা ঝোলা হাতড়াচ্ছে। তার পর অসহায় গলায় বলল, ‘নেই।’
কন্ডাক্টর মাফলার-ঢাকা মুখটার পেছন থেকে ফুট কাটলেন, ‘কী হল, সক্কাল সক্কাল ফাঁকা ট্রামে পকেটমার হয়ে গেল নাকি?’
‘বিশ্বাস করুন দাদা, ব্যাগটা নেই। থাকলে পাঁচটা টাকা দিতাম না?’
‘বুঝেছি, বুঝেছি। ভাড়াটা দিন।’
‘বলছি তো নেই। ফাঁকাই তো যাচ্ছে ট্রামটা। শিয়ালদায় নেমে যাব।’
অনুনয়-বিনয় থেকে বাদানুবাদ। শেষ পর্যন্ত কন্ডাক্টর লোকটাকে নেমে যেতে বললেন।
মাত্র পাঁচটা টাকার জন্য সান্তা ক্লজ নেমে যাবে? রেন-ডিয়ারের টানা ট্রামে করে শিয়ালদা স্টেশনে যাচ্ছিলেন বলে পিপলিকে যে গল্পটা বলবেন বলে মনে মনে এত ক্ষণ সলতে পাকাচ্ছিলেন, সেটা এখানেই শেষ হয়ে যাবে? আর লোকটাও তো শিয়ালদাতেই যাবে বলছে।
সন্দীপনবাবু পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করে কন্ডাক্টরকে দিয়ে বললেন, ‘আহা, উনি নেমে যাবেন কেন? খুচরো তো না-ই থাকতে পারে। নিন আপনি দুটো টিকিটের দাম নিয়ে নিন।’
কন্ডাক্টর নির্লিপ্ত হয়ে টাকাটা নিয়ে দুটো টিকিট দিয়ে দিলেন। লোকটা ঈষৎ অপ্রস্তুত হয়ে আবার সিটে ফিরে এসে ইতস্তত গলায় বলল, ‘ধন্যবাদ স্যর।’
সন্দীপনবাবু মনে মনে খুশি হলেন। ট্রামটায় এখনও কোনও তৃতীয় যাত্রী ওঠেনি। টিকিট কেটে দেওয়ার সুযোগে লোকটার সঙ্গে এ বার একটু ভাব জমানো যাবে। সান্তা ক্লজরা কী করে, জানা যাবে। পিপলিকে যে গল্পটা বলবেন, তাতে কাজে লাগবে। লোকটাকে এ বার ভাল করে দেখলেন। সাদা দাড়ি-গোঁফ, চশমা আর লাল টুপিতে ঢাকা মুখটার পেছনে কৃষ্ণবর্ণের লোকটার বয়সটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে বয়সে ছোট। ‘তুমি’ সম্বোধন করা যেতেই পারে। গলাটা একটু খাঁকরিয়ে পরিষ্কার করে লোকটাকে প্রশ্ন করলেন, ‘সকালবেলায় কোনও শপিং মলে ডিউটিতে যাচ্ছ বুঝি?’
‘না স্যার। নাইট ডিউটি ছিল। বাড়ি ফিরছি।’ বিনয়ী গলায় উত্তর দিল লোকটা।
‘নাইট ডিউটি?’ উৎসুক সন্দীপনবাবু জানতে চাইলেন।
‘হ্যাঁ স্যর। কিন্তু জিতেনের কাছে আমার জামাকাপড়গুলো রয়ে গিয়েছে।’
‘জিতেন কে?’
‘আমাদের ড্রেসার। বিশ্বাস করুন, ওই প্যান্টের পকেটেই মানিব্যাগটা রয়ে গিয়েছে। বকশিসের টাকাটা শুধু সঙ্গে রয়েছে। তাও...’
লোকটা থেমে গেল। সন্দীপনবাবুর মোবাইলটা বাজছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে দেখলেন, আরতি। ফোনটা ধরতেই আরতি উদ্বিগ্ন গলায় বলতে শুরু করলেন, ‘তুমি কোথায়? বললে তো একটু হাঁটতে বেরচ্ছ। আমি চা করে নিয়ে বসে আছি। এত ক্ষণ হয়ে গেল!’
সন্দীপনবাবু সতর্ক হলেন। সত্যিটা বলা যাবে না। ছেলে-বউমা আরতিকে মোবাইলে ফোন করতে পারে। আরতি সত্যিটা বলে দিলে সারপ্রাইজটা আর পিপলিকে দেওয়া হবে না। জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখলেন। মানিকতলা থেকে ট্রামটা সার্কুলার রোডের দিকে বাঁক নিচ্ছে। একটু চাপা গলায় বললেন, ‘মানিকতলা বাজারে।’
‘মানিকতলা?’
‘আরে মানিকতলা বাজারের মতো মাছ আমাদের পাড়ার বাজারে পাওয়া যায় নাকি? তুমি তো তিন রকম মাছের লিস্ট দিয়েছ।’
আরতি গজগজ করতে থাকলেন, ‘সেটা আমাকে বলে যেতে কী হত? এ দিকে আমি মরছি চিন্তায়।’
ফোনটা ছাড়তেই লোকটা উসখুস করে উঠল, ‘মানিকতলা বাজার তো ছাড়িয়ে এলাম স্যর।’
নিচু গলাতে কথা বললেও লোকটা ঠিক শুনে ফেলেছে। শিয়ালদা আর বেশি দূরে নেই। তার আগে লোকটার কাছে জেনে নিতে হবে, সান্তা ক্লজরা বাচ্চাদের জন্য কী কী করে। সন্দীপনবাবু লোকটাকে তাড়াতাড়ি বললেন, ‘যাব। ফেরার সময় যাব। আগে কোলে মার্কেটে একটু কাজ আছে। হ্যাঁ, তা তুমি কী যেন বলছিলে, নাইট ডিউটি। কোনও হোল-নাইট পার্টি ছিল বুঝি?’
‘পার্টি একটা ছিল স্যর। বড় ব্যবসাদার। ক্রিসমাস পার্টি দিয়েছিল। যে রকম খানা, সে রকম পিনার ফোয়ারা ছুটেছে স্যর। পার্টিতে চার্লি সেজেছিলাম। ডিউটি শেষ করে জামাকাপড় বদলে ফেলেছি, তখন ওই বাড়ির বড়বাবু টলতে টলতে এসে বললেন, সান্তা সাজতে হবে। জিতেনের কাছে সান্তার ড্রেস ছিল। আমার মালিক বলল, হারু, নাইটটা করে দে, এক্সট্রা পাবি। সকালে বাড়ি যাবি। বড়দিনের দিন ছুটি করবি। আমাদের আর বড়দিন স্যর!’
সন্দীপনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা রাত্রে কী করতে হল?’
‘একটাই কাজ স্যর। রাত তিনটের সময় বড়বাবুর নাতনির ঘরে চুপিচুপি একটা উপহার রেখে আসার কাজ।’
‘বুঝেছি,’ সন্দীপনবাবু হেসে ফেললেন, ‘কিন্তু নিয়মটা তো হচ্ছে, বাচ্চারা রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মোজা ঝুলিয়ে রাখবে। বাড়ির বড়রা সেই মোজার ভেতরে উপহার রেখে দেবে। সকালে উঠে বাচ্চারা উপহার পেয়ে ভাববে সান্তা নিজে এসে উপহার রেখে গিয়েছে। তা হলে, তোমাকে এই ধড়াচূড়া পরে রাত তিনটেয় যেতে হয়েছিল কেন?’
লোকটা ম্লান হাসল, ‘আজকালকার বাচ্চারা অনেক চালাক হয়ে গিয়েছে স্যর। সকালে উঠে প্রমাণ চায় যে সত্যিই সান্তা এসেছিল। তার জন্যই তো স্যর মাঝরাতে চুপিচুপি এই কাজটা করতে হয়েছে।’
সন্দীপনবাবু মাথা ঝাঁকালেন। পিপলিও এইটুকু বয়সে খুব বুদ্ধিমতী। যুক্তিবোধ প্রখর। চট করে কিছু বুঝিয়ে দেওয়া যায় না। যে গল্পটা পিপলিকে বলবেন বলে মাথায় গেঁথে রেখেছেন, তাতেও প্রমাণ দিতে হবে, রেন-ডিয়ারের টানা ট্রামে করে শিয়ালদা স্টেশনে ওকে আনতে গিয়েছিলেন। খুব উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘তা, কী প্রমাণ রেখে এলে?’
‘ওই সিসিটিভির ক্যামেরায় স্যর। গোটা বাড়িতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। সময়ের ছাপ দিয়ে ছবি উঠছে সব সময়। আমাকে ক্যামেরাগুলোর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে হয়েছে। সকালে বড়বাবু ওটা নাতনিকে দেখিয়ে বুঝিয়ে দেবেন, রাত তিনটেয় সত্যিই সান্তা এসেছিল।’
বাঃ! অসাধারণ বুদ্ধি। মনে মনে সন্দীপনবাবু তারিফ করলেন। রাজাবাজারের মোড়ে এসে ট্রামটা দাঁড়িয়ে আছে। শিয়ালদা আর একটুখানি। সময় বেশি নেই। সন্দীপনবাবু একটু ছটফট করে উঠে মোবাইলটা বার করে লোকটার পাশে বসে বললেন, ‘একটা কাজ করে দেবে ভাই?’
‘বলুন না স্যর।’
‘তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভাল লাগল। তোমার সঙ্গে একটা সেলফি তুলে দেবে? আমি কোনও দিন সেলফি তুলিনি। আমার নাতনি আসছে আজ। ওকে দেখাব।’
‘দিন স্যর।’ লোকটা হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিল। সন্দীপনবাবু দেখলেন, স্ক্রিনে উনি আর সান্তা পাশাপাশি। জায়গাটা যে ট্রামের মধ্যে, বেশ বোঝা যাচ্ছে। ছবিটা তুলে লোকটা মোবাইলটা ফেরত দিয়ে দিল। তার পর ঝোলা থেকে কিছু বার করতে যেতেই একটা বাতিল পাঁচশো টাকার নোট বেরিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। সেটা দেখে সন্দীপনবাবুর চোখটা বিস্ফারিত হয়ে গেল।
লোকটা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘বিশ্বাস করুন স্যর, এটা কাল রাতের কাজের জন্য বকশিস পেয়েছি। আমার পয়সার ব্যাগটা প্যান্টের পকেটে জিতেনের কাছে কিন্তু সত্যিই রয়ে গিয়েছে।’
‘তোমাকে কি আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি? কিন্তু এই টাকাটা নিয়ে তুমি কী করবে?’
‘সবটাই তো ধোঁকা স্যর। নাতনিকেও ধোঁকা, ভালবাসাতেও ধোঁকা, বকশিসেও ধোঁকা। নিয়ে নিলাম স্যর। আরও তো সাত দিন সময় আছে পালটে নেওয়ার। দেখি যদি পালটাতে পারি, না হলে ছিঁড়ে ফেলে দেব।’
লোকটা আবার ঝোলার ভেতর হাত ঢোকাল। এক মুঠো লজেন্স বার করে সন্দীপনবাবুর হাতে দিয়ে বলল, ‘এগুলো আপনার নাতনিকে দেবেন। বলবেন সান্তা দিয়েছে। পার্টিতে বাচ্চাদের দেওয়ার জন্য এগুলো আমাদের কাছে সব সময় থাকে। আসুন স্যর। শিয়ালদা এসে গিয়েছে।’
লোকটা নেমে গেল। পেছন পেছন বিহ্বল হয়ে সন্দীপনবাবুও নামলেন। ফ্লাইওভারের পাশ দিয়ে লোকটা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে ঝোলা থেকে লজেন্স বার করে রাস্তার বাচ্চাগুলোকে দিচ্ছে। ক্রমশ সান্তা ক্লজ ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
প্ল্যাটফর্ম টিকিট কেটে ভেতরে একটা বসার জায়গা পেলেন সন্দীপনবাবু। বড় ইলেকট্রনিক ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে, পিপলির ট্রেনটা আসতে এখনও ঘণ্টা খানেক দেরি আছে। সন্দীপনবাবুর হাতের মুঠোতে লজেন্সগুলোর আশ্চর্য এক অনুভূতি পিপলির জন্য অনেক যুক্তি দিয়ে সাজানো বড়দিনের গল্পটা মাথা থেকে একটু একটু করে মিলিয়ে দিচ্ছে। সত্যিকারের সান্তার দেওয়া উপহারের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কোনও প্রমাণ লাগে না। ওটায় কোনও ধোঁকা থাকে না। ছুঁলেই বোঝা যায়। পিপলির জন্য লজেন্সগুলো যত্ন করে পকেটে রেখে দিলেন সন্দীপনবাবু। তার পর মোবাইলটা বার করে ডিলিট করে দিলেন বড়দিনের পবিত্র সকালে সান্তা ক্লজের সঙ্গে তোলা সেলফিটা।