ভূতের রাজা জুতের নয়

ভূতের রাজা জুতের নয়। তার কেবলই ভূতের ভয়। সন্ধে হলেই ভূতের রাজার পা কাঁপে ঠকঠক। বুক করে ধকধক। ভূতের অভূতপূর্ব মহামন্ত্রী পড়েছে মহা গেরোয়। কী লজ্জা! কী লজ্জা! এমন বিদঘুটে অদ্ভূতুড়ে ভূতের রাজা! কেউ শুনেছে কোনও কালে? ইনি অবশ্য রাজা হয়েছেন হালে। আগে যে রাজা ছিল, সেই রাজা ছিল খুবই ঘুমকাতুরে। সিংহাসনে বসে নাক ডাকিয়ে সে কী ঘুমের ঘটা। সকাল ছ’টা কী রাত ন’টা, তার কাছে সবই সমান।

Advertisement

প্রদীপ আচার্য

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share:

ছবি: সুমিত্র বসাক

ভূতের রাজা জুতের নয়। তার কেবলই ভূতের ভয়। সন্ধে হলেই ভূতের রাজার পা কাঁপে ঠকঠক। বুক করে ধকধক। ভূতের অভূতপূর্ব মহামন্ত্রী পড়েছে মহা গেরোয়। কী লজ্জা! কী লজ্জা! এমন বিদঘুটে অদ্ভূতুড়ে ভূতের রাজা! কেউ শুনেছে কোনও কালে? ইনি অবশ্য রাজা হয়েছেন হালে। আগে যে রাজা ছিল, সেই রাজা ছিল খুবই ঘুমকাতুরে। সিংহাসনে বসে নাক ডাকিয়ে সে কী ঘুমের ঘটা। সকাল ছ’টা কী রাত ন’টা, তার কাছে সবই সমান। তাই ভূতুমপুরের সেনারা সবাই গেল খেপে। তখন রাজার সিংহাসনও গেল কেঁপে। সেনারা সবাই একসঙ্গে জোট বাঁধল। ওই রাজাকে রাজ্যছাড়া করে এই রাজাকে সিংহাসনে বসাল। এই রাজা আগে কোতোয়াল ছিল। বেশ দশাসই চেহারা। ইয়া লম্বা লম্বা হাত। মুখে লম্বা-চওড়া বাত। লম্বা লম্বা পা দু’খানা। মুখখানা কিম্ভূত কিমাকার। দেখলেই বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। সবাই বলল, এমন রাজাই চাই। অমনি রাজা বদল হল।
কিন্তু এই রাজার সমস্যাটা আরও গুরুতর। আগের রাজা ছিল ঘুমকাতুরে। আর এই রাজার ঘুমের সঙ্গে আড়ি। মহামন্ত্রী খানিক চুলকে নিয়ে দাঁড়ি, মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘মহারাজ, বদ্যিকে খবর দেব নাকি? কোবরেজকে ডাকি? ঘুমের বড়ি খান। সুখে নিদ্রা যান।’ রাজা কোনও কথা বলে না। মহামন্ত্রী ক’দিন ধরে লক্ষ করল, সন্ধে ঘনিয়ে আসার পর থেকেই রাজার হম্বিতম্বি নেই। মুখে লম্বা-চওড়া বাত নেই। অমন তালগাছের মতো পা দু’খানা কাঁপছে। মহামন্ত্রী বলল, ‘মহারাজ, আপনার পা দু’খানা কাঁপে কেন? শরীরটাও কাঁপে যেন। এ তো ভাল লক্ষণ নয়। এই সময়টা টায়ফয়েডের ভয়। কঠিন কোনও ব্যামোট্যামো পাকাচ্ছে নিশ্চয়।’ রাজা তবু কোনও কথা বলে না। ঘনঘন জল খায়। আর ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে। চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ।

Advertisement

মহামন্ত্রী রাজবদ্যিকে ডেকে পাঠাল। থুত্থুরে সাতকেলে বুড়ো রাজবদ্যি এসে রাজাকে পরীক্ষা করে দেখল। বলল, ‘অবাক কাণ্ড! যার মুখের দিকে তাকালে ভয়ে পিলে চমকে যায়, ভায়া। তার চোখেই কিনা ভয়ের ছায়া!’ রাজবদ্যি মহামন্ত্রীকে আড়ালে ডেকে বলল, ‘ভায়া, ওষুধ দিতে পারি। তবে লাভ হবে না তাতে। মিথ্যে কিছু খরচ হবে চিকিৎসার খাতে।’ মহামন্ত্রী বলল, ‘তবে অ্যালাপ্যাথি করে দেখব নাকি?’

‘অ্যালাপ্যাথিও দেবে ফাঁকি।’ বলেই রাজবদ্যি খুক খুক করে কাশতে লাগল। কাশতে কাশতে হাসতে লাগল। বলল, ‘অ্যালাপ্যাথি, হোমুপ্যাথি সবই আখেরে ফেল হবে।’

Advertisement

‘কী করা যায় বলুন তবে?’ মহামন্ত্রী বলল। শুনে রাজবদ্যি মুচকি হেসে জবাব দিল, ‘ফেল হবে সব প্যাথি। অ্যালোপ্যাথি, হোমুপ্যাথি। আগে চাই সিমপ্যাথি। হতে হবে সমব্যথী। যাকে বলে সিমপ্যাথি। রাজার যেভাবে কাঁপতেছে বুক। নির্ঘাৎ এ মনের অসুখ। ভেবে দেখলাম সব দিক। রোগটা হল মানসিক।’

রাজা ভয়ে চোখ বুজে বসেছিল। মহামন্ত্রী সহানুভূতির সুরে বলল, ‘মহারাজ, ছেলেমানুষের মতো ভয় পাচ্ছেন কীসে অত?’ রাজা তখন কাঁপা কাঁপা গলায় মহামন্ত্রীকে সব কথা খুলে বলল। মহামন্ত্রী তো শুনে বোবা হয়ে গেল। ভাবল, স্বয়ং ভূতের রাজা যিনি, ভূতের ভয়ে কাবু তিনি। ছিঃ ছিঃ, অন্য সব ভূতের রাজারা শুনলে বলবে কী? লজ্জায় মুখ দেখানো যাবে না, ছিঃ। তা ছাড়া, ব্যাপারটা জানাজানি হলে, কানাকানি হলে, হবে আর এক জ্বালা। তখন এই রাজাকেও তো শুনতে হবে, রাজ্য ছেড়ে পালা।

মহামন্ত্রী বলল, ‘মহারাজ, আপনি কেবলই ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যাচ্ছেন। মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন। শত্রু যদি থাকে তো বলুন, তাকে নিকেশ করি। কিন্তু ভূতের ভয়ে ভীত আপনি, ভেবে লজ্জায় মরি। কথাটা যদি পাঁচকান হয় তবে, হাসি তামাশার পাত্র হতে হবে। সবাই বলবে, ভূতের রাজার ভূতের ভয়? ন্যাকামি আর কারে কয়! তা ছাড়া, মহারাজ, আপনার এত লোক-লশকর, বরকন্দাজ, গোলন্দাজ, রিসালা। তবু আপনার এত ভয়। উফ্ এ যে কী জ্বালা!’

রাজা বলল, ‘মহামন্ত্রী, সে সব কথা নয়। আমার যাকে ভয়, সে ভূত এক ভয়ঙ্কর। হয়তো কোনও গুপ্তচর। থাকে আমার শোবার ঘরে। রোজ আমাকে ফলো করে।’ শুনে আকাশ থেকে পড়ল মহামন্ত্রী। বলল, ‘মহারাজের শোবার ঘরে ভূত! কাণ্ডটা অদ্ভূত! অবাক কাণ্ড! সে কী! চলুন তো যাই, দেখি।’

রাজার শোবার ঘরে গিয়ে মহামন্ত্রী খিলখিল করে হেসে ওঠে। রাজা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কারণ, রাজা এখন সেই ভয়ঙ্কর ভূতটার পাশে মহামন্ত্রীকেও দেখতে পেল। চোখ কচলে রাজা বলল, ‘আইপবাস! কেমন হল ব্যাপার খানা? মহামন্ত্রী দু-দু’খানা!’ মহামন্ত্রী বলল, ‘মহারাজের রহস্যটা নেই জানা। আপনিও তো দু-দু’খানা। মহারাজ, ওটা হল আয়না। ওতে নিজেকেই দেখা যায়। ভুল দেখা যায় না। মানুষেরা ব্যাভার করে। থাকে মানুষের ঘরে ঘরে। ভূতের ঘরে আয়না নেই। ভ্রম হয়েছে তাই তাতেই।’

মহামন্ত্রী তখন রাজাকে আয়নার গল্পটা খুলে বলল। আগের রাজা এক পোড়ো-ভুতুড়ে জমিদার বাড়ি থেকে ওই আয়নাটা নিয়ে এসেছিল। সেই রাজাও প্রথম ওই আয়না দেখে ভিড়মি খেয়েছিল। তার পর বেশ মজা পেয়ে গেল। তখন আয়নাটা এনে শোবার ঘরেই ঝুলিয়ে রেখে দিল।

আয়নার বৃত্তান্ত শুনে রাজা ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। তখন রাজা কিন্তু কিন্তু করে বলল, ‘মহামন্ত্রী, দেখতে আমায় এত কুচ্ছিত? এতটা ভয়ঙ্কর? আজই তুমি পালটে দাও আমার শোবার ঘর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন