ছবি: সুব্রত চৌধুরী
পুজোর আগে লেখকরা খুবই ব্যস্ত থাকেন। উপন্যাস নিয়ে নাজেহাল, নাজেহাল গল্প নিয়ে। কেবল লিখে ফেলাটা কোনও বড় কথা নয়, কথা হল সেটা যেন একটা ভাল লেখা হয়। পুজোসংখ্যা বেরোনোর পর যাতে সে লেখা নিয়ে বহু দিন আলোচনা-সমালোচনা চলতে পারে। ঘটনা হল, এ সময়ে শিল্পীরাও কিন্তু সেই কারণেই ব্যস্ত। আগে এক-একটা পুজোসংখ্যায় সাত থেকে আটটা উপন্যাস যেত। এক-এক জন লেখককে প্রায় দুই থেকে তিনটি উপন্যাস লিখতে হত, তার সঙ্গে কিছু ছোটগল্প। ফলে সব ক’টা পুজোসংখ্যা মিলিয়ে শিল্পীদের ছবি আঁকতে হত পাঁচ থেকে সাতটা উপন্যাসে, সঙ্গে বেশ কিছু গল্প। এবং কবিতার পাতার অলঙ্করণ।
তখন ‘আনন্দমেলা’য় একটা মোটামুটি ধরাবাঁধা রীতি ছিল। রহস্য উপন্যাস লিখতেন কাকাবাবুকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কিকিরা অর্থাৎ কিঙ্কর কিশোর রায়কে নিয়ে লিখতেন বিমল কর, যেটার ছবি আমি আনন্দবাজারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই এঁকে এসেছি যত দিন বিমলদা বেঁচে ছিলেন। আর আঁকতাম ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’র সঙ্গে। বেশ কয়েকটি পুজোসংখ্যায় আমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভূতুড়ে উপন্যাসের ছবি এঁকেছি। শীর্ষেন্দুদা ছোটদের উপন্যাস সময়মতো দিয়ে দিতেন, কিন্তু বড়দের লেখা পেতে আমাদের বহু ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। আজ দু’পাতা তো কাল ছ’পাতা, এ ভাবেই চলত পুজোসংখ্যা বেরনোর গোড়া অবধি। যেমন যেমন পাণ্ডুলিপি পাঠাতেন, আমিও তত দূর অবধি পড়ে তৈরি থাকতাম। দু’বছর আগে তো উপন্যাসের শেষ ইনস্টলমেন্ট দেওয়ার আগেই আমি ছবি আঁকা শেষ করে ফেলেছিলাম; ওই দু’পাতা-ছ’পাতার উপর নির্ভর করে। শেষমেশ শীর্ষেন্দুদা অবশ্য সেই পত্রিকায় সে বার উপন্যাসটি আর লেখেননি।
কবিতার ছবি আঁকার প্রতি আমার নিজের একটা দুর্বলতা আছে। মনে হয়, এই কাজটা যেন আমায় একটা অন্য জগতে নিয়ে যায়। যে-মাপেরই কবিতা হোক না কেন— ছোট, বড়, মাঝারি— আমি একাধিক বার পড়ি। যত বারই পড়ি, প্রতি বারই কবিতার অর্থ আমার কাছে পাল্টে যেতে থাকে, এক-এক রকম ভাবে ধরা দেয়। এতে আমার কাজটা করতে সুবিধেই হয়। নানা ভাবে ফর্ম ভেঙে তার সঙ্গে কিছু ‘মিথ’কে যুক্ত করি, যেটা ওই কবিতার অর্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জয় গোস্বামী আমার খুব প্রিয় এক জন কবি। শব্দের ব্যবহার ওর কাছে ছবি আঁকার মতো। ছবি আঁকার সময়েও কত বার যে শব্দ পাল্টে দিয়েছেন তার কোনও ঠিক নেই। এমনও হয়েছে কখনও, এক দিন কোনও শব্দ পাল্টে দেওয়ার পর দিনই টয়লেটে দেখা হতেই ফের ধরেছেন, ‘‘কাল বুঝলেন, আমি অনেক রাত অবধি একটা শব্দের প্রতিশব্দ হাতড়ে বেরিয়েছি, অবশেষে পেয়েছি।’’ বুঝলাম কবিতার প্রতি কতটা আনুগত্য থাকলে এটা সম্ভব।
পুজোসংখ্যার ছবি আঁকার সুবাদে বহু লেখকের মনের আঙিনায় প্রবেশ করতে পেরেছি। বহু অভিজ্ঞতায় ঝুলি ভরেছি আর মগজের মধ্যে নানা কৌটোয় সে সব গুছিয়ে রেখেছি। প্রয়োজনে কৌটো থেকে বার করে কখনও ছবির কাজেই লাগাই।
দিব্যেন্দু পালিত সব সময় একাধিক নমুনা চাইতেন, সে প্রচ্ছদ হোক বা অলঙ্করণ। ওঁর ধারণা, যে-ছবিটা আঁকা হয়েছে ওটা ছেড়ে পরে আর একটা আঁকলে সেটা হয়তো আরও ভাল হবে। কিন্তু সব সময় দেখা গিয়েছে প্রথমটাই ভাল এবং আমরা সমবেত ভাবে ওঁকে সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করতাম, তবুও আর একটা অপশন চাইতে বলা ওঁর একটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল।
সে বছর খুব সময়ের টানাটানি। রমাপদবাবু অর্থাৎ রমাপদ চৌধুরী আনন্দবাজারে ‘রবিবাসরীয়’ বিভাগটি সামলাতেন। শুধু তাই নয়, আনন্দবাজার পুজোসংখ্যা উনিই দেখতেন। আর বেয়ারা থেকে শুরু করে লিফটম্যান সবাইকেই ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। এক দিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘‘শুনুন, আপনাকে তিনটি উপন্যাসের ছবি আঁকতে হবে মাত্র আড়াই দিনে।’’ এমনিতে আমি একটু দ্রুত ছবি আঁকার অভ্যেস তৈরি করে নিয়েছিলাম। তবুও মনে মনে ভাবলাম, তিনখানা উপন্যাস! কখনই বা পড়ব, আর কখন ছবি আঁকব! আমার কিছুই মাথায় আসছিল না। তার উপর ছবির জন্য জায়গা ছাড়ার বহর সাংঘাতিক, শুরুটা ফুল পেজ, একটুখানি জায়গা ছাড়া হত উপন্যাসের নাম আর লেখকের নামের জন্য। মাঝে দু’খানা ডবল স্প্রেড, দুটো হাফ পেজ ভার্টিকাল, দুটো হরাইজ়ন্টাল আর একটা টেলপিস। প্রত্যেকটা উপন্যাসে এই একই রকম ছবির জায়গা ছেড়ে রাখা।
আমার কপালে ভাঁজ লক্ষ করে বুঝতে পারলেন এটা প্রায় অসম্ভব। বললেন, ‘‘বেশি চিন্তা করবেন না, উপন্যাসের প্রথম দশ পাতা আপনি খুব মন দিয়ে পড়ে নেবেন। দেখবেন অনেক চরিত্রই সেখানে পেয়ে গেছেন। আর ছবির জায়গা যেখানে যেখানে ছাড়া আছে তার আশেপাশে কয়েক পাতা পড়বেন, দেখবেন সেই চরিত্ররাই ঘোরাফেরা করছে। কাজেই আপনি অনায়াসে এই তিনটি উপন্যাস করে ফেলতে পারবেন। আর পুজোসংখ্যা বেরোলে পর তখন আপনি পুরোটাই পড়বেন।’’
বিপদে পড়লে বুদ্ধি খোলে। সহজ উপায় খুঁজে বার করলাম। একটা উপন্যাসে ছেড়ে রাখা সব জায়গাকে ডায়াগোনালি রি়ডাকশন করে ছোট করে লাইন ড্রয়িং করে আবার সেটাকে এনলার্জ করে দিলাম। লাইন সব মোটা হয়ে ফেটে ফেটে গেল। খুব সুন্দর একটা এফেক্ট তৈরি হল। পরের উপন্যাসেও তাই করলাম, লাইন ড্রয়িংয়ের সঙ্গে একটু ওয়াশের কাজ করলাম, সেটাকে সিক্সটি ফাইভ ডটে ট্রান্সফার করে এনলার্জ করে দিলাম, ডট সব বড় বড় হয়ে গেল, শুধু হাইলাইটের জায়গায় কিছু কিছু ডট মুছে দিলাম। দাঁড়িয়ে গেল ছবিগুলো। এ বার তৃতীয় উপন্যাসের বেলায় হিসেব করে দেখলাম একটু সময় আছে। একটু ধরে ধরে লাইন ড্রয়িং করে কাজটা শেষ করলাম। এই আড়াই দিনের এ রকম একটা অ্যাডভেঞ্চার সামলে আমি সত্যি সত্যি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। শুধু তাই নয়, রমাপদবাবুর সেই টিপ্স আমি যত্ন করে কৌটোয় ভরে রাখলাম।
‘পদ্য’ কথাটা কারও মুখ থেকে যদি শুনে থাকি তো তিনি হলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কবিতার বাইরেও তাঁর নানা পাগলামি, স্বেচ্ছাচারিতা; সারা কলকাতা তাঁর হাতের মুঠোয় যেন। কবিতা আর পাগলামি, জীবনের সঙ্গে মানানসই
একটা ‘প্যাকেজ’।
সালটা ১৯৮৬-৮৭ হবে। শক্তিদার এক বন্ধু অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এলেন দেখা করতে। একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন ওঁরা। অর্ধেন্দুদার মা শেফালিকা দেবী এক জন নামজাদা অভিনেত্রী ছিলেন তখনকার সময়ে। খুব সুন্দরী দেখতে ছিলেন। আমি তাঁকে জীবিত অবস্থায় দেখিনি, ছবি দেখেছি, রবীন্দ্রনাথ ওঁর নাম দিয়েছিলেন ‘পুতুল’।
শরৎকালের কোনও এক বিকেলে শক্তিদা আর অর্ধেন্দুদা আমাকে চুপিসারে ডিপার্টমেন্ট থেকে তুলে নিয়ে গেলেন ভিক্টোরিয়া হাউস অর্থাৎ সিইএসসি-র সামনে স্যর আশুতোষের মূর্তির পাদদেশে। পুজোসংখ্যার কাজে আমি খুবই ব্যস্ত তখন, স্যর আশুতোষকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘স্যর যে খুব নোংরা হয়েছেন, মাথায় কাগে পটি করেছে, সে সব গায়ে গড়িয়েছে, এঁকে পরিষ্কার করতে হবে।’’ উল্টোদিকে টিপু সুলতান মসজিদের গলির সামনে বড় হাঁড়িতে করে হালিম বিক্রি হয়। অর্ধেন্দুদা সেখান থেকে বালতি ভর্তি জল নিয়ে এলেন। শক্তিদা গায়ের ফতুয়া খুলে বালতির জলে চুবিয়ে দিলেন আর দু’জনে মিলে আমাকে ঠেলেঠুলে উপরে তুলে দিলেন। নীচে শক্তিদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে। আমি যতটা সম্ভব স্যরকে জাপটে ধরে ঘষে-ঘষে তোলার চেষ্টা করলাম। সে-দৃশ্য দেখার জন্য রাস্তায় ভিড় জমে গেল। গাড়িঘোড়া চলার একটু অসুবিধে হচ্ছিল। খানিক বাদে বাইকে করে এক পুলিশ অফিসার এসে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ‘‘ইয়ে সব কেয়া হোতা হ্যায়, জ্যাম হোনে লাগা। অয়ে! সব বন্ধ কিজিয়ে।’’ ওই অবস্থাতেই ফিরে এলাম অফিসে, লিফটে শক্তিদাকে স্যান্ডো গেঞ্জি পরা অবস্থায় দেখে তো সবাই থ।
পূর্ণেন্দু পত্রীর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। সবচেয়ে যেটা পেয়েছি সেটা হল সাহস। ফেলে দেওয়ার মতো ডিজ়াইনকেও উনি ঠিক বার করে নিয়ে আসতে পারতেন। আমি তখনও আনন্দবাজারে ঢুকিনি, বাইরে থেকে ফ্রিলান্স করতাম। দীর্ঘ দিন ধরে দেখেছি বনগাঁ থেকে এক জন তরুণ কবি পূর্ণেন্দুদার কাছে এসে বসে থাকত। তার একটাই স্বপ্ন, পূর্ণেন্দুদাকে দিয়ে একটা প্রচ্ছদ আঁকাবে। আর পূর্ণেন্দুদা যথারীতি ওকে ঘুরিয়েই যাচ্ছেন। মাঝে তিনটে পুজো কেটে গিয়েছে। লক্ষ্মীপুজোর পর এক দিন সেই তরুণ কবি মরিয়া হয়ে বসে আছে, যে ভাবেই হোক সে আজ পূর্ণেন্দুদাকে দিয়ে প্রচ্ছদটা আঁকিয়েই ছাড়বে। তখন তো এখনকার মতো কম্পিউটার ছিল না। পাতা তৈরি হত গ্যালি কেটে ডামি শিটে আঠা দিয়ে সেঁটে। কাজেই সবার কাছে একখানি কাঁচিও থাকত। পূর্ণেন্দুদার টেবিলের সামনে একটা সাদা কাগজ সব সময় পাতা থাকত। মাথায় কোনও কিছু এলে সেখানে আঁকিবুঁকি কাটতেন। সেই কাঁচিটি কিন্তু আরও একটা কাজে উনি ব্যবহার করতেন। ঘাড়ের চুল সামনের দিকে টেনে নিয়ে সমান করে ছাঁটতেন, নাপিতকে বোধ হয় একটাও পয়সা দিতেন না।
সে রকমই উনি চুল ছেঁটে চলেছেন সে দিন। টেবিলে সাদা কাগজ, সেখানে কাঁচাপাকা চুল পড়ে বিভিন্ন আকৃতি তৈরি হয়েছে। সামনে সেই তরুণ কবি। তার পর পিএনএস স্টুডিয়োর ছেলেটিকে ডেকে সেই সাদাকালো চুলের কাগজটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা একটা হার্ড এক্সপোজ দিয়ে ব্রোমাইডের প্রিন্ট করিয়ে নিয়ে এস। সাবধানে নিয়ে যেও। যতই সাবধানে নিয়ে যাক, যেতে যেতে নাড়া খেয়ে কাগজের ওপর চুলের প্যাটার্নও বদলেছিল নিশ্চয়। যাই হোক, শেষ অবধি প্রিন্টটা যখন এল, দেখা গেল জংলা সেই ডিজাইনের কোথাও ফাঁকা, কোথাও আবার ঘনত্ব বেশি। একটা অদ্ভুত সুন্দর প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে। যেখানে কালোর অংশ বেশি সেখানে ‘বো’ পেন দিয়ে সাদা রঙে লিখে দিলেন ‘স্বপ্ন ভেসে যায় জংলা জলে’— কবিতার বইয়ের নাম। কী যে ভাল দেখতে হয়েছিল তা আর বলার নয়। উপরে ট্রেসিং পেপার সেঁটে কালার চার্ট করে দিলেন, অর্থাৎ হরফের রং কেমন হবে। সেই প্রচ্ছদ পেয়ে তরুণ কবির মুখাবয়বে ফুটে উঠেছিল এক অদ্ভুত জ্যোতি, যেন এইমাত্র সে লটারির টাকা পেল। এ অভিজ্ঞতাও আমি কৌটোয় ভরেছি।
সারা বছরই ছবি আঁকাআঁকির কাজে ব্যস্ত থাকি। কখনও ম্যাগাজ়িনে, কখনও ব্রড শিটে। কিন্তু পুজো এলেই মনে হয় আবার আদা-জল খেয়ে লাগতে হবে। এ একটা অন্য রকম অনুভূতি, একটা শিহরন— পুজো এসে গেল। সবাই তখন ব্যস্ত। তারই মধ্যে উঁকি মারে অনেক আগে পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত বিমল করের ‘একা একা’ উপন্যাস। রিনি তনুশ্যামের প্রেমে পড়েছিল, আর কতশত তরুণ যে রিনির প্রেমে পড়েছিল তার কোনও ঠিক নেই। সুধীর মৈত্রের আঁকা মেয়েরা খুব সুন্দরী, প্রাণবন্ত, তাদের ভাল না বেসে পারা যায় না। সমীর সরকারের ছবি আরবানদের খুব পছন্দ। বিমল দাস আমার পাশেই বসতেন। ড্রয়িংয়ে উনি মাস্টার ছিলেন, ‘আনন্দমেলা’য় তাঁর আঁকা থেকে ছোটরা চোখ ফেরাতে পারত না। ড্রয়িংয়ে আমার নিজের কখনও খটকা লাগলে বিমলদার শরণাপন্ন হতাম। আজও পুজোসংখ্যার কাজ করতে বসলে স্মরণ করি রমাপদবাবুর দেওয়া টিপ্স। আর
খুলতে শুরু করি সঞ্চিত অভিজ্ঞতার রঙিন কৌটোগুলোর ঢাকনা।