জা স্ট যা চ্ছি

বিবেকানন্দ, শিব, ইন্দির ঠাকরুন, ছিটকিনি

কো নও বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে চেহারার মিল থাকলে খুবই মুশকিল হয়। অচেনা লোকেরা তাকে আরও মন দিয়ে দেখে খুব কাছে গিয়ে। কেউ অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে। কেউ ফ্যাক করে হেসে চলে যাওয়ার আগে বলে যায়, ‘না না, অন্য লোক’। এই ব্যাপারগুলো হয়, জানি বলেই চুপ করে আছি। মুখ খুলতে ইচ্ছে করছে খুবই। কারণ, সামনে যে লোকটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে, তাকে হুবহু অল্প বয়সের স্বামী বিবেকানন্দের মতো দেখতে।

Advertisement

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩
Share:

ছবি: শুভময় মিত্র

কো নও বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে চেহারার মিল থাকলে খুবই মুশকিল হয়। অচেনা লোকেরা তাকে আরও মন দিয়ে দেখে খুব কাছে গিয়ে। কেউ অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে। কেউ ফ্যাক করে হেসে চলে যাওয়ার আগে বলে যায়, ‘না না, অন্য লোক’। এই ব্যাপারগুলো হয়, জানি বলেই চুপ করে আছি। মুখ খুলতে ইচ্ছে করছে খুবই। কারণ, সামনে যে লোকটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে, তাকে হুবহু অল্প বয়সের স্বামী বিবেকানন্দের মতো দেখতে। ভাবছে কিছু একটা। দু’হাত পিছনে। পরেছে পাজামা-পাঞ্জাবি। চলে গেলেই হয়, কিন্তু আমি যাচ্ছি না, আশ্চর্য মিলটা দেখে যাচ্ছি মন দিয়ে। অনেকগুলো বাচ্চা দৌড়ে আসছিল, তাদের দেখে দুম করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্কুলটা কোথায় রে?’ ওরা আমাকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেল। একটা বড় বাঁশবন পড়তে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওই লোকটা কে রে?’ সবাই চেঁচিয়ে বলল, ‘নরেন’।

Advertisement

দারুণ জায়গাটা। এত বড় বাঁশবন দেখিনি আগে। সবুজ ফোয়ারার মতো বাঁশঝাড় আকাশের দিকে উঠে তার পর বেখেয়ালে আবার জমির দিকে ফিরে এসেছে। ঝকঝক করছে হলুদ-সবুজ রোদ্দুর। অল্প হাওয়া দিচ্ছে, ঝরে যাওয়া বাদামি পাতার ওপর ছায়া-সিনেমা চলছে। এখনও গরম পড়েনি। আমি দাঁড়িয়ে পড়ায় বাচ্চাগুলো ‘ওই দিকে চলে যাও’ বলে নিজেরা চলে গেল। চার পাশ চুপচাপ হয়ে গেল, একটু পরে আবার সরসর আওয়াজ শুনে দেখি এক বুড়ি আসছে আমার দিকে। শহুরে ছোট মন আমার। ভাবলাম, নিশ্চয়ই ভিক্ষে চাইবে। লাঠি ঠুকে ঠুকে সামনে এসে দাঁড়াল সে। আমার দিকেই তাকাল। একে আবার ‘পথের পাঁচালী’র ইন্দিরা ঠাকরুনের মতো দেখতে। ভেঙেচুরে যাওয়া শরীরের সব বুড়িকেই নিশ্চয়ই তাই।

বুড়ি আমাকে এক দিকে ইশারা করে দেখাল, যেতে বলছে, সেটা স্কুলের দিকটা নয়। দেখিয়ে নিজে চলল, আমি পিছন পিছন। ‘কী আছে ও দিকে?’ জিজ্ঞেস করলাম। বেশ কিছুটা চলার পর একটু থেমে জিরিয়ে নিতে নিতে বলল, ‘শিব’। মন্দির আছে নিশ্চয়ই, দেখা যেতেই পারে। বিকেল অবধি আমার কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই।

Advertisement

বাঁশবন শেষ হবার আগেই লোকজনের গলার শব্দ পাওয়া গেল। একটু এগোতেই দেখলাম, এক জন মহিলা গাছের ছায়ায় বসে পাঁপড় ভাজছেন। কিছু দূরে অনেক সাইকেল, মোটরবাইক, তার পর লোকজনের জটলা। যেন মেলা বসে গেছে। ভিড়ের কাছে পৌঁছতেই চিৎকার শুনলাম, ‘এ কী অনাচার নানা! গ্রামের যুবতী মেয়েকে পার্বতী সাজিয়ে বাঁশবনে নিয়ে গেল আর তুমি ডুগডুগি বাজাচ্ছ আপন মনে? এ কী অনাচার!’ অদ্ভুত সাজগোজ করা চার জন লোক চেপে ধরেছে আরও উদ্ভট সাজ করা আর এক জনকে। হাতে টিনের ত্রিশূল, পরনে প্রিন্টেড বাঘছাল। সর্বাঙ্গে নীল রঙের ওপর পাউডারের প্রলেপ। পাশে চ্যালা, নন্দী। তার মানে, এই লোকটাই শিব। যাত্রা বা নাটক জাতীয় কিছু একটা হচ্ছে খোলা মাঠে। সবাই ঘিরে বসে দাঁড়িয়ে দেখছে, আমোদ করছে। আমাকে দেখে মাতব্বর চেহারার এক জন ‘মাস্টারমশাই, সামনে বসুন’ বলে একটা চেয়ারে বসানোর চেষ্টা করতে লাগল। না-কাটা দাড়ি আর বাজে চশমা থাকায় আমাকে টিচার ভেবেছে। ‘আজ কী ব্যাপার?’ কায়দা করে প্রশ্নটা ছুড়লাম। ‘গরমেন্ট এই শিল্পের প্রসারের জন্য ইউনিসেক্স-এর সঙ্গে কাজ করছে, অনুষ্ঠান দিচ্ছে, খরচা করছে। সমাজের জরুরি কথাগুলো ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তা ছাড়া আমাদের এই মালদার গম্ভীরা তো জগৎপ্রসিদ্ধ। বসুন, বসুন।’ গম্ভীরা, নামটা ভুলে গিয়েছিলাম। দারুণ ব্যাপার। এক ধরনের নাটকই বলা যেতে পারে। কনটেম্পোরারি ঘটনা নিয়ে চড়া নাটুকে ডায়লগ আদানপ্রদান চলবে, ব্যাকগ্রাউন্ডে পুরাণ, ঠাকুর-দেবতা। শিবকে বলে নানা। শেষে তাকে ডাকা হবেই, সমস্যার বিহিত করার জন্যে। আশ্বাস পেলেই খেল খতম। লোকসংস্কৃতির প্রসারের জন্য সরকার কাজ করছে, ইউনিসেফ-ও আছে বোঝা গেল। সবাইকে নয়, বেছে বেছে কিছু লোককে চা দেওয়া হচ্ছে, আমাকেও দিল।

ওপেন এয়ার থিয়েটার দেখতে ভালই লাগছিল। চোখা-চোখা ডায়ালগের সঙ্গে সঙ্গে ছেলে-বুড়ো সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। এটা রবীন্দ্র সদন নয়, এটা আমবাগান। এখানে এন্টারটেনমেন্ট চড়া দাগের না হলে চলবে কেন? ঝোলা ব্যাগটা কোলের কাছে নিয়ে জমিয়ে বসলাম, সিগারেট ধরিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে। লোকজনকে তো আর বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আসলে আমি ফালতু লোক। মুখ ঘুরিয়ে এক বার পিছনে দেখলাম। গ্রাম ভেঙে লোক এসেছে। স্কুল-ফেরত ইউনিফর্ম পরা মেয়েরাও আছে এক জায়গায়। এ ওর গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চুপ করে গেল। কী মুশকিল। বুড়ি কোথায় চলে গেছে কে জানে! এ দিকে শিবকে খুবই চেপে ধরা হয়েছে নানা ধরনের সামাজিক অবক্ষয়ের ব্যাখ্যা চেয়ে। কমলা রঙের পরচুলা পরা শিব খুব মুশকিলে পড়েছে। বেগতিক দেখে নন্দীর দিকে তাকিয়ে আনস্মার্ট ডায়লগ দিচ্ছে। এরই মধ্যে মনে হল, আমার পিছনে অন্য কিছু একটা ঘটছে। অনেকেই উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। কেউ কেউ উঠে চলে যাচ্ছে। স্কুল-পড়ুয়া একটু বড় হওয়া একটা মেয়েকে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করায় প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, তার পর ভয়ানক লজ্জা পেয়ে ‘দরজা বন্ধ করে দিয়েছে তো’ বলেই অন্যদের পিছনে লুকিয়ে পড়ল।

রিয়েল লাইফ নাটকের গন্ধ পেয়ে আমিও ঘুরে দাঁড়ালাম। সবাই যে দিকে যাচ্ছে, এগোলাম সেই দিকে। জিজ্ঞেস করলে কেউ স্পষ্ট কিছু বলছিল না, শুধু হাসছিল। উত্তেজক কিছু একটা ঘটেছে, তাই সবাই আগ্রহী। বিনি পয়সার এমন আমোদের লোভ আমিও ছাড়ব না। এগোলাম, সবাই যে দিকে যাচ্ছে, সে দিকে। বাচ্চা কোলে বউ, সবে হাঁটতে শেখা বাচ্চা, সবার সঙ্গে আমিও পৌঁছে গেলাম আর একটা নতুন ভিড়ের কাছে। অনেকগুলো বাড়ির মধ্যে একটার উঠোনের সামনে জটলা, চিৎকার-চেঁচামেচি। খান্ডারনি চেহারার এক জন বউ হাতে ঝাঁটা নিয়ে সদর্পে পায়চারি করছে। এক বার বাড়ির বন্ধ দরজার দিকে, আর এক বার জড়ো হওয়া জনতার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে— ‘যেই না সবাই দুকুরবেলা পালা দেকতে গিয়েচে, অমনি সুযোগ বুঝে ঘরে এসে ঢুকেছো! ঢুকেই ছিটকিনি মেরেচো, আমরা বুঝিনি কিছু, নাকি? আজ তোর ছিটকিনি খুলব আমরা। বেরোও বলছি।’ পাবলিক খুব উত্তেজিত, ভায়োলেন্ট কিছু একটা হবে নিশ্চয়ই, বারণ করার ব্যাপার নেই। ছোটদের ঠেলে বুড়োরা মাথা গলাচ্ছে ভিড়ের মধ্যে। এ দিকে অন্য সমস্যা হয়ে গেল। আমাকে দেখেই, ‘আসুন, আপনি বলুন বেরুতে, তার পর বিহিত করবেন, যা ভাল বুঝবেন। আসুন, আসুন।’ যেতেই হল, উপায় নেই। বধ্যভূমিতে এসে দাঁড়ালাম। অতি ভয়ংকর শাস্তির কথাও বলা হল আমাকে। ‘ছিটকিনি’ শব্দটা দর্শকদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। ‘কেউ এগোবে না, মাস্টারমশাই যা বলবেন, তা-ই ফাইনাল’, চেঁচিয়ে শুনিয়ে দেওয়া হল সবাইকে। আমি আমার মতো করে কী ঘটেছে সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। এই মুহূর্তে ওই উগ্রপন্থী মহিলাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস আমার নেই। এক বার মুখ ঘুরিয়ে শিবকেও দেখতে পেলাম। উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে ভিড়ের মধ্যে।

মাথার মধ্যে পিন পতনের শব্দ অবধি শুনতে পাচ্ছিলাম না আর। দোষী আসামির মতোই আমি নিজেই পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম বন্ধ দরজার সামনে, তার পর দৃঢ় গলায় বললাম, ‘খোলো দরজা, আমি এসেছি।’ পুকুরে বড় কলসি ডুবলে যে ভারী শব্দটা বেরোয়, ‘আমি’টা আমার কানে তেমনই শোনাল। কিছু ক্ষণ চুপচাপ, তার পর দরজার ভেতরে ছিটকিনি খোলার শব্দ হল। আস্তে করে দরজার একটা পাল্লা খুলল। বেরোল পাজামা পরা একটা পা, তার পর আরও একটা।

suvolama@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন