Alice Springs

আজব দেশ অ্যালিস

ভূমিপুত্ররা এখানে পরবাসী। তাদের অসুখ কিংবা অপরাধ কমাতে সরকার উদাসীন। এখানে গাছ আছে বৃষ্টি নেই, নদী আছে জল নেই, সভ্যতা আছে মনুষ্যত্ব নেই।

Advertisement

দেবাঞ্জলি রায়

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:৫২
Share:

শহরচিত্র: অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রে অবস্থিত অ্যালিস শহরের আকাশরেখা।

শস্যশ্যামলা বঙ্গদেশে জন্ম, মফস্সলের স্কুলে বড় হওয়া, মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলে মনের বিকাশ, তার পর উত্তর কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা। তার পর যতই ওঠাপড়া হোক না কেন, জীবনের গান ওই প্রাথমিক সুরেই বাঁধা থাকে। সবার ক্ষেত্রে এটাই নিয়ম। এ হেন অবস্থা থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করার ঝোঁকে আমার স্থান কাল পাত্র, এমনকি গোলার্ধেরও পরিবর্তন হল! স্থানান্তর ঘটল অস্ট্রেলিয়ার অ্যালিস স্প্রিংস হাসপাতালে।

Advertisement

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া এই হাসপাতালই এই শহরের প্রাণ। জায়গাটি কিন্তু সিডনি, মেলবোর্ন বা পার্থ নয়, মধ্য অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমির মাঝে একটি শহর। তবু এখানে এমন কিছু নতুন ওষুধ বা যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়, যা অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় শহরেও নেই। সেই কারণে এটি একটি মেডিক্যাল স্কুলও বটে। কারণ জায়গাটির প্রতি অস্ট্রেলিয়ান সরকারের বিশেষ নজর আছে। এই অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার আদিম আরান্দা জনজাতিদের বাস সব থেকে বেশি। এদের খুব আস্তে আস্তে ব্রিটিশ-স্কটিশ শাসকরা প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছে, সমূলে উৎপাটন করতে পারেনি যদিও। সেটাই এখন হয়ে গেছে সরকারের মাথাব্যথার কারণ।

১৭৭০-এ সিডনির বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়ে, বন্দুকের গুলির আওয়াজ শুনিয়ে বা ব্যবসার নামে জবরদখল করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা জাল বিছিয়েছে এই দেশে। ১৮৬১ সালে জন ম্যাকডুয়াল স্টুয়ার্ট নামের স্কটিশ আবিষ্কারক দক্ষিণে অ্যাডিলেডের পোর্ট অগাস্টা বন্দর থেকে উত্তরে ডারউইন যাওয়ার সময় মধ্য অস্ট্রেলিয়ার পাহাড় ঘেরা প্রায় মরুভূমির মাঝে আবিষ্কার করেন এই জনজাতির বাস। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এরা। এর আগে বা পরে ১৫০০ কিলোমিটার প্রায় কিছুই নেই। এই গোটা ৩০০০ কিলোমিটার অঞ্চলের ঠিক মাঝবরাবর ম্যাকডোনেল পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা এই জনজাতি একটি গভীর জলের কুয়োর উপর বাঁচার জন্য নির্ভরশীল।

Advertisement

গ্রামের নাম মপার্নতুয়ে। একটি নদী আছে বটে কিন্তু জল নেই। বছরে এক দিন ১২-১৪ ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই দু’কূল ছাপিয়ে বন্যা, অর্থাৎ নদীর গভীরতা নেই। বিচক্ষণ স্টুয়ার্ট সাহেব অনুভব করলেন এই জায়গাকে কেন্দ্র করে টেলিগ্রাফ লাইন তৈরির প্রয়োজনীয়তা। অ্যাডিলেড থেকে ডারউইন এবং গ্রেট ব্রিটেন।

কাজটা সহজ ছিল না। শ্রমিক তো এই আদিম জনজাতি, কিন্তু ভাষা বোঝা দায়। এরা একটা তীব্র শব্দ করে নিজেদের ভাষায় কথা বলে। কিন্তু ব্রিটিশরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী আর ধূর্ত। দ্রুত স্থানীয় ভাষা শিখে নিল স্টুয়ার্টের দলবল। আদিম দরিদ্র জনজাতি এই সাদা চামড়ার বিদেশিদের থেকে পেল তিনটি জিনিসের স্বাদ— কাঁচা পয়সা, বিলিতি সুরা আর পাকা ঘর। রাতারাতি গ্রামের নাম মপার্নতুয়ে থেকে হয়ে গেল স্টুয়ার্ট। ১৮৭২ সালে চার্লস টডের কারিগরি পরামর্শে শেষ হল টেলিগ্রাফ স্টেশন তৈরির কাজ। অস্ট্রেলিয়ান ওভারল্যান্ড টেলিগ্রাফ লাইন। তিনিই ছিলেন ওই টেলিগ্রাফ স্টেশনের প্রথম আধিকারিক। তাঁর নামে সেই জলহীন নদীর নাম হল টড নদী আর তাঁর স্ত্রীর নামানুসারে জায়গার নাম হল ‘অ্যালিস স্প্রিংস’।

এই অবধি খারাপ চলছিল না। কিন্তু ১৮৮৭-তে অ্যালিস স্প্রিংসের ১০০ কিলোমিটার দূরে পাওয়া গেল মাটি মেশানো নরম সোনার তাল। ক্রমশ বাড়তে লাগল ব্রিটিশ ও অন্য ইউরোপিয়ানদের আনাগোনা। শুরু হল ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে আরান্দা জনজাতিদের বিভিন্ন কারণে বচসা। এর আগে আরান্দা জনজাতির কেউ অপরাধ করলে তাকে শিকল বেঁধে ১২০০ কিলোমিটার দূরে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হত। এতে দেখা গেল সময় ও শ্রমিক দুই নষ্ট। মাঝরাস্তায় কষ্ট সহ্য করতে না পেরে প্রাণ হারায় অনেক লোক। সে সব ভেবে অ্যালিস স্প্রিংসেই তৈরি হল জেলখানা। সাদা চামড়ার অপরাধীদের একটা করে আলাদা ঘর আর আরান্দাদের জন্য ডরমিটরি। পুরুষ-মহিলা একই ঘরে, খুব নিম্নমানের জেলখানা।

দিন যায়, কাল যায়। সভ্যতার প্রয়োজনে তৈরি হয় রেললাইন। তার পর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কম দূরত্বের উড়োজাহাজ। আরান্দা জনজাতি এত দ্রুত উন্নতির মাঝে হারিয়ে ফেলে নিজেদের। অতি প্রাচীন দলবদ্ধ ‘দিন আনি দিন খাই’ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত মানুষজন ক্রমশ স্বীকার করে এদের বশ্যতা। অবশ্য দু’-এক জন ভাল মানুষও ছিলেন। ১৯৪১-এ ফাদার পার্সি স্মিথ এই আদিম জনজাতির ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি হস্টেলও তৈরি করেছিলেন, যাতে এরা মূলস্রোতে আসতে পারে। কিন্তু এই শহরের ভাগ্যে লেখা ছিল অন্য কিছু। হঠাৎ শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

যে শহরে হাতে গোনা ৫০০ জন লোক থাকত কি না সন্দেহ, সেই শহর ভরে ওঠে মিলিটারি পুলিশে। জাপান উত্তর দিক থেকে ডারউইন আক্রমণ করে। প্রচুর লোকজনকে এখানে সরিয়ে আনা হয়। প্রায় আট হাজার মিলিটারি সেনা মোতায়েন করা হয়। আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন ইত্যাদি বিভিন্ন দেশের সেনানায়ক ও তাদের পরিবারের আগমনে অ্যালিস হয়ে ওঠে বর্ণময়। সিনেমা হল, ঘরবাড়ি, রেস্তরাঁ আর মিলিটারি হাসপাতাল যার সূত্র ধরে এই ইতিহাস সন্ধান। আরও কুঁকড়ে যায় আরান্দা গোষ্ঠী।

কালের নিয়মে যুদ্ধ শেষও হয় এক দিন। অনেকেই ফিরে যায় নিজের ঠিকানায়। পাকাপোক্ত ভাবে কিছু ইউরোপিয়ান হয়ে যায় অ্যালিসের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। একটা ছোট্ট গ্রাম বিদেশিদের জন্য হয়ে যায় শহর, গ্রামের আসল মানুষরাই হয়ে যায় বহিরাগত! সংখ্যায় কমতে কমতে এরা আজ বিপন্ন। অতএব এদের সাপ্তাহিক ভাতা দেওয়া শুরু হল। সেই টাকায় এরা যা খুশি করুক! মদ্যপান, জুয়া। এদের জন্য স্কুল আছে, কিন্তু নেই সবাইকে বাধ্যতামূলক ভাবে ভর্তি করার উপায়। ইচ্ছে হলে এসো, না হলে কেউ ডাকবেও না। আছে উচ্চমানের হাসপাতাল-ওষুধ-চিকিৎসা ব্যবস্থা। কিন্তু সেই হাসপাতালে আসে কারা? ৬০ শতাংশ আরান্দা এবং বাকি সাদা চামড়ার অস্ট্রেলিয়ানরা। কী তাদের অসুখ? অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েদের ডায়াবিটিস এবং তার কারণ হচ্ছে কাঁচা টাকা দিয়ে মদ, কোক ও চিপস খাওয়ার অভ্যেস। কম বয়সে সাপ্তাহিক ডায়ালিসিস। স্বাস্থ্য-শিক্ষা, কমিউনিটি মেডিসিনের প্রয়োগের অভাব। অসুখ-প্রতিরোধ নীতির অভাব। ইউনাইটেড নেশনস, হিউম্যান রাইটসকে জবাবদিহি করতে হবে বলে প্রকৃত উন্নতির কথা না ভেবে পাইয়ে দেওয়া।

এদের বেশির ভাগের, বিশেষত ১০ বছরের নীচে ছেলেমেয়েদের পায়ে জুতো নেই, অথচ একটু সাবালক, সাবালিকা সবার হাতে বিয়ার বা কোকের টিন! মা শিশুকে বোতলের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে সেটা হয়তো মাটিতে পড়ে গেল, তুলে পরিষ্কার না করেই আবার শিশুটির মুখে ধরে সেই ধুলোমাখা বোতল! স্নান বা পরিচ্ছন্নতার বোধ নেই, কিন্তু গাড়ি করে আসে ফাস্ট ফুড কিনতে। যে যখন যা পারে ছিনিয়ে নেয়। এদের রক্তে অবিশ্বাস আর প্রতিশোধস্পৃহা। এরা না পেরেছে পুরো সভ্য হতে, না পেরেছে সভ্যতার সুবিধেগুলো ছাড়তে। ৩০,০০০ বছরের অভ্যেস ২০০ বছরে জোর করে পরিবর্তন করা যায়নি, আর সরকার চেষ্টাও করেনি। সভ্যতার নিষ্ঠুর চাবুকের এই কশাঘাত রোজ হাসপাতালে আমাদের মতো চিকিৎসকদের বিষণ্ণ করে বইকী!

প্রতিদিন পাহাড় ঘেরা অ্যালিস স্প্রিংসে প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ সূর্যাস্ত হয়। ঠিক তখন দক্ষিণ পূর্বের সিম্পসন মরুভূমি থেকে একটা অদ্ভুত মন খারাপের হাওয়া আসে ভেসে। এখানে গাছ আছে বৃষ্টি নেই, নদী আছে জল নেই, সভ্যতা আছে মনুষ্যত্ব নেই। শুধু কিছু শান্তিপূর্ণ সামাজিক সহাবস্থান, যার ভিত খুব নড়বড়ে। কানে ভেসে আসে বিখ্যাত আরান্দা গায়ক ম্যাটি এম-এর ‘টেলিফোন’ গানটি। ২০২২-এর এই অস্ট্রেলিয়ান রেগে সঙ্গীত বিশ্বে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। অর্থাৎ মণিমুক্তো এদের মধ্যেও আছে, কিন্তু প্রদীপের আলোর তলায় অন্ধকার! সেখানে কবে আলো পড়বে, কেউ জানে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন