চাঁদনি রাতে সৈকতে ঘুরে বেড়ায় ভিনগ্রহের প্রাণীরা

পাহাড়ের গায়ে ঝলকে ওঠে অদ্ভুত আলো। মাঝে মাঝে হরেক রহস্যময় সংকেত পান শহরের মানুষ। পেরুর চিল্কা কি আসলে ভিনগ্রহী ‘জাদু’র শহর? সেই টানেই ভিড় জমান পর্যটকরা? লিখছেন পেরু-বলিভিয়ায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সন্দীপ চক্রবর্তী পাহাড়ের গায়ে ঝলকে ওঠে অদ্ভুত আলো। মাঝে মাঝে হরেক রহস্যময় সংকেত পান শহরের মানুষ। পেরুর চিল্কা কি আসলে ভিনগ্রহী ‘জাদু’র শহর? সেই টানেই ভিড় জমান পর্যটকরা? লিখছেন পেরু-বলিভিয়ায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সন্দীপ চক্রবর্তী

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

রোদ পোহাচ্ছে ই টি। চিল্কার সমুদ্রসৈকতে ইনস্টলেশন আর্ট।

সে ই অল্প বয়সে সিনেমার পরদায় দেখা ক্যালিফোর্নিয়ার জঙ্গলটা মনে ভেসে উঠল, দক্ষিণ আমেরিকার আদ্যোপান্ত আধুনিক এই শহরতলিতে দাঁড়িয়ে। মনে পড়ে গেল সেই পিতৃহীন বাচ্চা ছেলেটা, যার নাম ইলিয়ট, আর তার দাদা মাইকেলের কথা। পিৎজা কিনে ফিরে আসার সময় বাড়ির গ্যারেজের কোনায় লুকিয়ে থাকতে দেখেছিল এক কিম্ভূতদর্শন প্রাণীকে! যার নাম ই টি।

Advertisement

দাঁড়িয়ে রয়েছি পেরুর রাজধানী লিমা থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে, ‘চিল্কা’ শহরে। যে শহরের হাওয়ায় মিশে রয়েছে জাদুবাস্তবতা। যেখানে ঘুরতে-ফিরতে প্রতি মুহূর্তে আপনি পাবেন অজানা কোনও গ্রহ থেকে আসা সংকেত! কঠোর বাস্তববাদী হলেও গা শিরশির করতে বাধ্য আপনার।

রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে পেরুতে এসেছি দু’বছর হতে চলল। আসার পর থেকেই দূতাবাসের পুরনো সহকর্মী অথবা স্থানীয় মানুষজনের কাছ থেকে এই চিল্কার গল্প শুনেছি বিস্তর। এই শহর নাকি ‘ই টি’ (এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল) অথবা ভিনগ্রহের প্রাণীর মনপসন্দ জায়গা! এখানে তেনারা আসেন! মাঝরাতে ঘুরে বেড়ান। কখনও কারও দিবাস্বপ্নে দেখা দেন। কারও গ্যারেজ, কারও চিলেকোঠায় গিয়ে বসেন। কারও ক্ষতি করেন না। বরঞ্চ উপকারই করে থাকেন।

Advertisement

হাজার হোক, আমি স্পিলবার্গের ছবি দেখা বঙ্গসন্তান। সত্যজিৎ রায়ের ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ পড়েছি সেই কোন ছেলেবেলায়। তাই চিল্কার কথা শোনা ইস্তক কৌতূহল জমা হচ্ছিল। এক ছুটির দিন সপরিবার গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলাম সটান চিল্কায়। শহরে ঢোকার গেট থেকে সেখানকার পুর-বিল্ডিং-এর কার্যালয়, পাব-বার-রেস্তোঁরা থেকে বড় হোটেল, সর্বত্রই দেখি ‘তিনি’ নিশ্বাস ফেলছেন! সর্বত্র তাঁর ছবি আর তাঁকে নিয়ে লেখা। আর সেই সঙ্গে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কতই না কিংবদন্তি আর উপকথা। চোখ জুড়ানো একটা ঝিল রয়েছে শহরের মধ্যে। একটাই ঝিল, কিন্তু তার নাম ‘টুইন’ লেক! এখানে ঝিলে নাকি মাঝে মাঝে নিশুতি রাতে এসে গা ভেজানো ভিনগ্রহের প্রাণীরা। তাঁদের আশীর্বাদ বইছে এর জলে। মানুষের বিশ্বাস (বাস্তবেও নাকি ঘটেছে), এখানে গর্ভবতী নারীরা স্নান করলে তাঁদের যমজ সন্তান হতে বাধ্য! এখানকার ইয়া ইয়া সৈকতে ভোরবেলা হাঁটলে শরীরে আপনি পাবেন এক অদ্ভুত এনার্জি। কথিত, এই সৈকতে চাঁদনি রাতে আসেন ভিনগ্রহের বাসিন্দারা। সংলগ্ন পাহাড় এবং গুহাতেও তাঁদের অবাধ যাতায়াত।

ই টি-র ব্র্যান্ডওয়ালা একটি আইসক্রিম পার্লারের মালিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এই তাজ্জব বিষয় নিয়ে। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশ হবে। দীর্ঘ দিন ধরে এখানকারই বাসিন্দা। আদালবের্তো হোসা নামের লালচে চুলের এই ভদ্রলোকের বক্তব্য, রাতে মাঝে মাঝেই তাঁরা পাহাড়ের গায়ে এক অদ্ভুত আলোর রোশনাই দেখতে পান! বিভিন্ন রঙের সেই আলো নাকি নেচে বেড়ায় পাহাড়ে কন্দরে, লেকের ওপর। বসতির কাছে কখনও আসে না। বহু দূরে হলেও তার দিকে নাকি বেশি ক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, চোখ অবশ হয়ে আসে। হোসা-র কথায়, ‘ওরা আসে এখানকার খনিজ পদার্থ, ধাতু নিতে। তবে কাউকে বিরক্ত করে না। আসে। নিজেদের মতো মিলিয়েও যায়।’ উনিশ-বিশ এ রকম বর্ণনাই শুনলাম এক স্থানীয় ক্যাব-চালকের কাছেও। আলবের্তো পাস নামের সেই চালকের বক্তব্য, মাঝরাতে গাড়ি চালানোর সময় মাঝে মাঝেই সে দেখেছে রহস্যময় আলোর ঝলক। গাড়ি থামিয়ে, রাস্তার পাশে পার্ক করে চুপচাপ অপেক্ষা করেছে গোটা রাত। দিনের আলো ফুটলে আবার ইঞ্জিন চালু করেছে।

তাঁরা কি তবে দিনের আলো পছন্দ করেন না? স্বাভাবিক ভাবেই এর কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, এখানে ই টি-র প্রবল উপস্থিতির পিছনে একটি অর্থনৈতিক দিকও কিন্তু রয়েছে। হলিউডের ইউনিভার্সাল স্টুডিয়োতে যেমন স্পিলবার্গের সেই প্রবাদপ্রতিম ছবির সেট আর নকল ই টি দেখার জন্য বছরভর পর্যটকদের ভিড় উপচে পড়ে, এ-ও যেন কতটা সে রকমই। গড়পড়তা বিচারে এই চিল্কার মধ্যে অসাধারণত্ব কিছু নেই। কিন্তু ইউএফও এবং ই টি-র কারণে বিশ্ব মানচিত্রে এর পরিচিতি এবং পর্যটনপ্রিয়তা প্রবল। লোকে সপ্তাহান্তে আসে ভিনগ্রহের আঁচে নিজেদের ছুটিকে একটু সেঁকে নেওয়ার জন্য। ফলে বিয়ারের দোকান থেকে আইসক্রিম পার্লার, সৈকতের ধারে তাঁবু-খাটানো ঠেক থেকে মাঝারি হোটেল— ব্যবসার অভাব হয় না।

চিল্কায় ভিনগ্রহের প্রাণীর এই বসতি শুরু কবে থেকে? সঠিক ভাবে কেউ জানে না। কিন্তু প্রথম যিনি বিষয়টিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন এবং গোটা দেশে হইচই ফেলে দেন, তাঁর নাম সিক্সটো পাজ ওয়েল্‌স। ১৯৫৫ সালে জন্ম, পেরুর এই নাগরিকের বাবা ছিলেন পেরুর ইউএফও গবেষণা সংস্থার (বেসরকারি) সক্রিয় সদস্য। বাবার অন্ধবিশ্বাস ছিল, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথাও না কোথাও প্রাণের সাড়া রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই এ বিষয়ে উৎসাহী হয়ে পড়েন সিক্সটো। পেরুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক হওয়ার পর তিনি মেতে ওঠেন ইউএফও চর্চায়। পড়াশোনা করেন প্যারাসাইকোলজি নিয়ে। ১৯৭৪ সালের এক শীত-সন্ধ্যায় তিনি একটি ‘বার্তা’ পান ধ্যানে বসে! সেই বার্তায় তাঁকে বলা হয়, ‘তোমাদের বাড়িটা যোগাযোগের জন্য খুব ভাল। আমার নাম অক্সালিক। জুপিটারের একটি চাঁদে আমরা থাকি, তার নাম অক্সালিক। আমরা তোমাদের যোগাযোগ করব পরে।’ সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দৌড়োন মা এবং দিদির কাছে। তাঁরাও নাকি একই রকম বার্তা পেয়েছেন বলে জানান।

আষাঢ়ে গল্প বলেই একে উড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কার্যকারণবশত তা হল না। শোনা গেল, একই সঙ্গে একই সময়ে আরও অনেকে নাকি একই বার্তা পেয়েছেন। ঘটনাচক্রে প্রাথমিক ভাবে এঁরা সবাই চিল্কার পাহাড়ে আলোর রোশনাই দেখা শুরু করেন। যাকে উড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল, তা ক্রমশ পল্লবিত হল। অনেকেই নাকি স্বপ্নে বা জাগরণেও নানা বার্তা পেতে শুরু করলেন। বাড়তে লাগল কৌতূহল, খবর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না। তার পর দেওয়ালের গ্রাফিতি থেকে সরকারি অফিস— সর্বত্র ই টি কার্যত হয়ে দাঁড়াল শহরের এক ব্র্যান্ড।

লিমা-য় ফেরার সময় হতে হতে সন্ধ্যা পেরিয়ে এল। গাড়িতে ওঠার সময় দূরে পাহাড়ের কোনায় কোনও নীল রঙের ঝলক দেখলাম নাকি?

এটা কি ভারতের জন্য কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে পাঠানো কোনও সংকেত? নাকি গোটা দিনের ঘোর?

অন্যমনস্ক ভাবেই ফেরার রাস্তা ধরেছিলাম সেই রাতে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement