আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: ওসামা বিন লাদেন

ভয়ের ব্যবসায় ইমেজই আসল

কেসটা কী বলুন তো? যখনই আপনার বাজার একটু ডাউন চলে, অমনি দেখি আমেরিকা আর সিআইএ ঠিক আপনার পাশে দাঁড়িয়ে যায়! সেই কোন ২০০৬-এ দুনিয়াসুদ্ধ খোকাখুকুদের লাদেন-জুজুর ভয় দেখানোর জন্য আপনার পুতুল বানিয়েছিল, সেই খবরটা এত দিনে মিডিয়াকে খাওয়াচ্ছে!

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০০:০০
Share:

ওসামা বিন লাদেন। এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত আতঙ্কে আর রোমাঞ্চে নড়ে যাওয়ায়, ছবিটা কেঁপে গেছে।

প্রতিবেদক: কেসটা কী বলুন তো? যখনই আপনার বাজার একটু ডাউন চলে, অমনি দেখি আমেরিকা আর সিআইএ ঠিক আপনার পাশে দাঁড়িয়ে যায়! সেই কোন ২০০৬-এ দুনিয়াসুদ্ধ খোকাখুকুদের লাদেন-জুজুর ভয় দেখানোর জন্য আপনার পুতুল বানিয়েছিল, সেই খবরটা এত দিনে মিডিয়াকে খাওয়াচ্ছে!

Advertisement

ওসামা বিন লাদেন: হ্যাঁ, বারাক ওবামা তো আমার শ্বশুরমশাইয়ের সেজ ছেলে, তাই আমার স্মৃতিচিহ্নের ছবি ছাপাচ্ছে! তোদের মাথাতেও আসে বটে! এর পর বলবি সিআইএ-ই আমাকে বাম্বু দেওয়ার জন্য আমার ওই ভিডিয়োগুলো টিভি চ্যানেলে ছাড়ত! নিজেরাই নিজেদের গাল পাড়ত, যাতে জেহাদিদের কাছে আমার লড়াকু ইমেজ আরও ডাকাবুকো হয়! যত্ত সব!


প্রতি: কিন্তু সত্যি সত্যি ওই ভিডিয়োগুলোয় হলিউডি ব্যাপার ছিল কিন্তু! আপনার পেছনে পাথুরে পাহাড়, ধু ধু বালিয়াড়ি কিংবা ঘুটঘুটে গুহা। আপনার কাঁধে বা হাতে ঝুলছে কালাশনিকভ। আর আপনি বিলিতি-মার্কিনি মেলেচ্ছগুলোর ‘জিনা হারাম করে দেওয়ার’ ফতোয়া দিচ্ছেন! কী সিনেম্যাটিক!

Advertisement

লাদেন: তোর মুন্ডু! সিনেমা না ছাই! ওই এট্টুসখানি ভিডিয়ো তুলতে দিন কাবার হয়ে যেত! বারবার এন.জি! বন্দুক সামলাতে গিয়ে ডায়ালগ হড়কে যায়। ডায়ালগ ম্যানেজ হল তো এক্সপ্রেশনে গোলমাল! তার চেয়ে মুন্ডু কাটার ভিডিয়ো তোলা অনেক সোজা। লোকটাকে হাঁটু গেড়ে বসাও, ঘ্যাঁচাৎ করে মাথা উড়িয়ে দাও। আমারটায় অনেক হ্যাপা! কথাগুলো এমন করে বলতে হবে যাতে ঘেন্না আর দাপট দুটোই ঠিকরোবে! তার ওপরে আবার লাদেনের ঠ্যাং ভেঙেছে, কোমর বেঁকেছে, কঠিন ব্যামোয় চুল-দাড়ি সব ঝরে গেছে— এ সব গুজবের বেলুনে পিন ফোটাতে, আমাকে খটখটিয়ে হেঁটে, দাঁত ছরকুটে হেসে, বুক ফুলিয়ে বন্দুক বাগিয়ে দেখাতে হত। বুঝলি না, ভয়ের ব্যবসায় ইমেজটাই আসল। যে লোকটা দুনিয়াকে ঘাবড়ে দেবে, তাকে দেখেই যদি মনে হয় বোমকে, কুঁকড়ে আছে, চলবে কী করে! আমার মুজাহিদ ভাইয়েরা, মানুষ-বোমারু, ফিদাইন জেহাদিরা মনের জোরই বা পাবে কোত্থেকে?


প্রতি: সিআইএ-র বানানো পুতুলে আপনাকে যতই সবুজ চোখ লাগিয়ে, লাল-কালো রং মাখিয়ে হরর-সিনেমার কিম্ভূত সাজানো হোক না কেন, আপনার মতো অমন রূপবান সন্ত্রাসবাদী তো পৃথিবীতে এক পিস-ও নেই!

লাদেন: দূর, তুইও তো দেখছি ওই ইয়াংকিগুলোর মতোই ভাবছিস! আরে, সন্ত্রাসবাদ কি হরর-ফিল্ম, না ভিডিয়ো গেম, যে ‘ভিলেন’দের রাক্ষস-খোক্কসদের মতো দেখতে হবে? সন্ত্রাসের নেতা বা হোতারা হবে অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টরদের মতো। কোথায় কখন চেলো-টা বাজবে, মানে গাড়িবোমাটা ফাটবে— স্যাক্সোফোনটা সুর ধরবে, মানে কোন শহরটা সিরিয়াল-বিস্ফোরণে কাঁপবে— সে-সব ছড়ির ডগায় থাকবে! বাজনদারদের কার কদ্দূর দৌড়, কে হার্প-এ বসবে, কে পিয়ানোয়— কে হাতবোমাটা ছোড়ে ভাল, কার মানববোমা সাজতে একটুও বুক কাঁপবে না— সেটাও নেতাকেই বুঝতে হবে। জেহাদের ভাষা হবে সিম্ফনির মতো। এক-একটা কথা এক-এক জনের বুকে এক-এক রকম ঠিকরে লাগবে! কেউ বদলার আগুনে টগবগ ফুটবে! কেউ এই ধরাধামে ঝটপট শহিদ হয়ে জন্নতে গিয়ে হুরি-পরিদের সঙ্গে গোলাপের পাপড়ি-ছড়ানো দুধ-পুকুরে ডুবসাঁতার দেওয়ার খোয়াব দেখবে। আবার তাত্ত্বিক কেউ কেউ প্যান-ইসলামের সেকেলে রূপকথায় মজে থাকবে। মোট কথা, সন্ত্রাসের নেতা হবে সেই লোক, যে দেশে দেশে ভয় রপ্তানি করবে। ভয়ের মন্ত্রে কুলকুচো করবে। আর তারিয়ে তারিয়ে দেখবে, অর্ধেক দুনিয়া ছেতরে পড়ে বলছে— ‘কওম কা নেতা ক্যায়সা হো...’

প্রতি: ‘আবু-বকর আল বাগদাদি য্যায়সা হো!’ সিআইএ আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়াকে ঠেকাতে আপনাকে মুজাহিদ বানিয়েছিল। তার পর ৯/১১ আপনাকে সেলেব্রিটি সন্ত্রাসবাদীর তকমা দিল ঠিকই, কিন্তু ‘ইসলামিক স্টেট’-এর আল বাগদাদির পাশে আপনি কোথায়? আপনি তো স্রেফ সন্ত্রাসের ভাড়াটে শ্রমিক, আর আল বাগদাদি ‘খলিফা’।

লাদেন: শোন, নিজে নিজে নামের আগে ‘খলিফা’ জুড়ে দিলেই কেউ অমনি রাজা-গজা হয়ে যায় না। পাবলিক মানছে কি না, সেটা দেখ। সবে পাখা গজিয়েছে, তাই একটু ঝাপটাচ্ছে। ডানা যে দিন কাটা পড়বে, দেখবি কেউ নামও করছে না।

প্রতি: এটা তো হিংসের কথা হয়ে গেল স্যর। এই বাজারে পারফরমেন্সটাই আসল। ৯/১১-র পর আপনার বাজারে নাম ফাটল ঠিকই, কিন্তু কাজের কাজ কী হল? আমেরিকা-ব্রিটেন মিলে আপনাকে সবসুদ্ধ হিন্দুকুশ পাহাড়ের গর্তে ঢুকিয়ে দিল। তার পর পাকিস্তানের শেল্টারে। পালিয়ে পালিয়েই বুড়ো হয়ে গেলেন। সেখানে অর্ধেক পশ্চিম এশিয়ায় এখন আল বাগদাদির কালো পতাকা উড়ছে! আপনার অত সাধের আল কায়দা এখন স্রেফ সাইনবোর্ড বাঁচিয়ে ইসলামিক স্টেট-এর ছোট শরিক!

লাদেন: এই তো তোদের একচোখোমি। তোরা আমাকে বলিস আমেরিকার ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’, অথচ আইএস কোথা থেকে গজাল সেই ইতিহাসটা দেখিস না। সাদ্দামকে খতম করার পর আমেরিকা যে গোটা এলাকার শিয়া-সুন্নি রাজনীতিটা ঘেঁটে দিল, শিয়াদের তোল্লাই দিতে গিয়ে, সুন্নিদের পুরো দুটো প্রজন্মকে খেপিয়ে দিল, সাদ্দামের ‘বাথ’ পার্টিটাকে আইএস-এর পতাকার তলায় নতুন জন্ম দিল, সেটা তো বলছিস না! শোন, আমাকে যদি আমেরিকা বানিয়ে থাকে, আল বাগদাদিও ওদেরই হাতযশ। বুশসাহেব ইরাকে গা-জোয়ারি, গুন্ডামি করে যে চারাগাছটা পুঁতেছিলেন, ওবামাবাবুর জমানায় সেটাই ডালপালা মেলে এই জায়গায় এসেছে। শুনে রাখ, সন্ত্রাসবাদ সব সময় নিউটনের তৃতীয় সূত্র মাফিক চলে। তুমি সুন্নিদের ঠেলতে ঠেলতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিলে, তারাও তো পালটা দেবে। ওখানে সেটাই হয়েছে। ওবামা মশাই ওঁর যুদ্ধবিরোধী ইমেজ বাঁচাচ্ছেন, ও দিকে আল বাগদাদি চান্স পে ডান্স মারছে— আর তোরা ভাবছিস বিরাট খলিফা এসেছে! আল কায়দার কায়দা টুকেই তো ওদের ফুটানি।

প্রতি: কিন্তু আল বাগদাদির আইএস গোটা দুনিয়ার মুসলিমদের মধ্যে যেমন সাড়া ফেলেছে, ভারত থেকেও বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা লড়তে চলে যাচ্ছে, আপনার আল কায়দা-র এ রকম ব্র্যান্ড-ভ্যালু কোনও কালে ছিল কি?

লাদেন: হ্যাঁ, এটা ঘটনা, আইএস-এ যত ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বৈজ্ঞানিক-প্রফেসর জুটেছে, আমার দলে তত ছিল না। আমার কারবার তো ছিল গোঁয়ারগোবিন্দ তালিবানগুলোর সঙ্গে। ওরা বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ভেঙে ফেলতে পারে, কিন্তু মিউজিয়ামের লুটের মাল পশ্চিমের বাজারে চড়া দামে ঝেড়ে দিতে জানে না। দেখ, আইএস এশীয় হয়ে এশীয়দেরই খতম করছে, মুসলিম হয়ে মুসলিমদের সঙ্গেই লড়ালড়ি করছে— আমি কিন্তু সন্ত্রাসটা আমেরিকার উঠোনে পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম। আমি ক্ষমতার হিসেব কষিনি, শুধু চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দিয়েছি। আর আইএস হিসেব করে মেপেজুখে ক্ষমতা দখল করছে। আমি ছিলাম সন্ত্রাসের মিথ, প্রবাদ, রূপকথা। আমার লাশটাকে তাই সমুদ্রের জলে কবর না দিয়ে আমেরিকা নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। আর আল বাগদাদির আইএস হল সন্ত্রাসের ব্যবসাদার, বেনিয়া। অনেকটা আমেরিকার মতোই। এরা সব একই টাওয়ারের টুইন, বুঝলি না?

sanajkol@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন