টাইগার হিল

দার্জিলিং যাওয়া হবে শুনেই পুপুলের মনের ভেতরটা আনন্দে নেচে উঠল। আসার পথেই দার্জিলিঙের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল পুপুল। হোটেলে ওরা যখন পৌঁছল, তখন পাহাড়ের পিছনে সূর্য ডুবে যাচ্ছে একটু একটু করে। হোটেলের বারান্দা থেকেই দেখা যাচ্ছে এই দৃশ্য। পুপুল একদৃষ্টে দেখছিল সে দিকে।

Advertisement

বিনতা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
Share:

দার্জিলিং যাওয়া হবে শুনেই পুপুলের মনের ভেতরটা আনন্দে নেচে উঠল।

Advertisement

আসার পথেই দার্জিলিঙের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল পুপুল। হোটেলে ওরা যখন পৌঁছল, তখন পাহাড়ের পিছনে সূর্য ডুবে যাচ্ছে একটু একটু করে। হোটেলের বারান্দা থেকেই দেখা যাচ্ছে এই দৃশ্য। পুপুল একদৃষ্টে দেখছিল সে দিকে। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন লাগছে পুপুল?’

‘খুব সুন্দর। তবে সানরাইজ আরও সুন্দর না?’

Advertisement

‘সেটাও দেখব আমরা।’

‘টাইগার হিল থেকে তো?’

‘অবশ্যই। কাল সাইট-সিয়িং, পরশু ভোরে টাইগার হিল। অনেক সকালে উঠতে হবে কিন্তু, পারবি তো? তুই তো সকালে উঠতে পারিস না।’

‘না না, যখন বলবে, তখনই উঠব।’

ভোর চারটের সময় গাড়ি ওদের পিক-আপ করতে আসবে। তাই পুপুলের বাবা তিনটের সময় ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখলেন। পুপুলের মায়ের চিন্তা ছিল, পুপুল একেবারেই সকাল সকাল উঠতে পারে না। ডাকলেও পাঁচ মিনিট-দশ মিনিট করে করে দেরি করে ফেলে।

অ্যালার্ম বাজতেই ধড়মড় করে আগে উঠল মা, তার পর বাবা। বাবা উঠেই মাকে বললেন, ‘পুপুলকে তুলে দাও। চারটে বাজতে দেরি নেই।’

‘পুপুল, উঠে পড়। বেরোব।’

‘পাঁচ মিনিট মা, উঠছি আমি।’

বাবা আর মা দ্রুত তৈরি হতে থাকল আর বারে বারেই পুপুলকে ডাকতে লাগল। কিন্তু পুপুল প্রতিবারই ‘আর পাঁচ মিনিট। প্লিজ, পাঁচ মিনিট’ করতে লাগল। কম্বল থেকে সে বেরোতেই পারছে না।

অবশেষে যখন কানের কাছে মুখ নিয়ে মা বলল, ‘যাঃ টাইগার হিল-এর সানরাইজ দেখা মিস হয়ে গেল।’ তখন পুপুল চোখ কচলে উঠে বসল।

ওকে ঠেলে বাথরুমে ঢুকিয়ে মা যখন সব গোছগাছ সেরে নিচ্ছে তখনই বাইরে গাড়ির হর্ন। ড্রাইভার জানিয়ে দিল, ‘চারটে বেজে গেছে, এর পর আর গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা পাওয়া যাবে না।’

ও দিকে বাথরুমের মধ্যে কোনও সাড়াশব্দ নেই। মা শঙ্কিত গলায় বলে, ‘পুপুল বাথরুমে ঘুমিয়ে পড়েনি তো?’

‘দরজা ধাক্কা দাও শিগগির।’

মা বাথরুমের দরজায় ঘা দিতেই ভেতর থেকে পুপুলের বিখ্যাত উক্তি ভেসে এল, ‘আর মাত্র পাঁচ মিনিট।’

গাড়ি চলছে সাঁ সাঁ করে। ভীষণ চড়াই। কিছুক্ষণ পরই দেখা গেল রাস্তার দু’ধারে কেবলই জঙ্গল। কোনও মানুষজন নেই। মা বলল, ‘আর একটাও গাড়ি দেখা যাচ্ছে না কেন?’

‘সবাই পৌঁছে গেছে। পুপুল, মনে হচ্ছে সব কষ্টই সার হবে। সানরাইজটা মিস করে যাব। তোমার পাঁচ মিনিটের কথামালায় নিজেই ভুগবে।’

‘মাত্র পাঁচ মিনিটের দেরির জন্য টাইগার হিল থেকে সানরাইজ দেখা মিস হয়ে যাবে বাবা?’

‘মাত্র পাঁচ মিনিট? ছ’বার মাত্র পাঁচ মিনিট হলে কত হয় হিসেব কর।’

পুপুলের মাথা ঝুলে পড়ল। এত আশা করে এসেছে, সব ব্যর্থ হয়ে যাবে? ভীষণ মন খারাপ লাগছে পুপুলের। অবশেষে গাড়ি টাইগার হিল-এ পৌঁছল।

ড্রাইভার বলল, ‘যারা আগে এসেছে তারা গাড়ি নিয়ে ওপরে উঠে গেছে। আপনাদের এখান থেকে পায়ে হেঁটে উঠতে হবে।’

তিন জনেই চড়াই ভাঙছে তড়িঘড়ি।

টিকিট ঘরে এসে পুপুলরা শুনল, সুপার ক্লাসের টিকিট সব বিক্রি হয়ে গেছে। অগত্যা ওরা কুড়ি টাকার টিকিটই কাটল।

তখনও সানরাইজ হয়নি। পুপুল দেখল দিগন্ত রেখা ধরে সারা আকাশ লাল টুকটুকে হয়ে উঠছে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে। ড্রাম ড্রাম লাল রং ঢালা হয়েছে যেন আকাশের গায়ে।

‘বাবা, দেখতে পাব তো সানরাইজ?’

‘মনে হচ্ছে পাবি। এখন লাল আকাশ দেখ। আর বাঁ দিকে তাকা পুপুল, কী দেখছিস?’

‘কাঞ্চনজঙ্ঘা!’ স্লেট রঙের আকাশে সগর্বে প্রকাশিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। লাল আকাশের রিফ্লেকশন এসে পড়ছে ওর গায়ে। যেন উন্নত মস্তক সম্রাট।

ও দিকে সবাই ডান দিকে পাহাড়ে গায়ে তাকিয়ে আছে। ওখান থেকেই সূর্যদেব প্রকাশিত হবেন। সকলের হাতে ক্যামেরা। সবাই প্রস্তুত। ঠান্ডায় শরীর শিউরে উঠছে কিন্তু কেউ তাকে কেয়ার করছে না। হাওয়ায় জামাকাপড় টুপি উড়ছে, কাঁপিয়ে দিচ্ছে, তাতে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। দমবন্ধ করে তাকিয়ে আছে পাহাড়ের কিনারে। পুপুলও।

একটু পরেই সমস্বরে উল্লাস ধ্বনি শোনা গেল। ওই, ওই যে। টাইগার হিলের গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে পুপুল বিস্ময়ে লক্ষ করল, প্রথম একটি সরু লাল রেখা। তার পর একটু একটু করে বাড়ছে সেটা, অন্ধকার পাহাড়ের কোল থেকে লাল টকটকে একটা আগুনের গোলা উঠছে ধীরে ধীরে।

পুপুলের বাবার হাতে ক্যামেরা সচল। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘মাঝে মাঝে বাঁ দিকেও নজর রাখ পুপুল!’

বাঁ দিকে তাকাল পুপুল, তাই তো! কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রথমে গোলাপি, তার পর লাল, তার পর কমলা। একটু পরেই তার সঙ্গে মিশে গেল ডিমের কুসুমের রংটা। কী ঝকঝকে, কী চমৎকার! একটু পরেই বুঝতে পারল, আর সূর্যর দিকে তাকানো যাবে না। কী তার তেজ! পাহাড়ের কোল ছেড়ে সে উঠে পড়েছে আকাশে।

পুপুলের মা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন লাগছে?’

মাকে জড়িয়ে ধরল পুপুল, ‘অসাম, মা। অসাম। জীবনে ভুলব না।’

পাহাড়ি রাস্তা ধরে গাড়ি নামছে। পুপুল বলল, ‘টাইগার হিল ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না, বাবা।’

‘সব ভিডিয়ো বন্দি করেছি। বাড়ি ফিরেও দেখতে পাবি।’ হাতের ক্যামেরা দেখালেন বাবা।

‘কিন্তু পুপুল, আজকের এই মহান দৃশ্য থেকে তুই কী শিক্ষা পেলি?’

‘নেচার ইজ দ্য কিং। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যর কাছে মানুষের বানানো কোনও সৃষ্টিই বেশি সুন্দর হতে পারে না। আর...।’

‘আর?’

মায়ের কোল ঘেঁসে বসল পুপুল, ‘ঘুম থেকে ডাকলে আর কোনও দিন ‘পাঁচ মিনিট’ বলব না। টাইগার হিল আমাকে আজ ক্ষমা করে দিয়েছে।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন