Bengali Feature

মেক্সিকো সিটিতে বাঙালি বিপ্লবীর বাড়ি

অনুশীলন সমিতির হয়ে সশস্ত্র আন্দোলন দিয়ে জীবন শুরু। পরে হয়ে ওঠেন উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। মেক্সিকো সিটিতে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতে এখনও তাঁরই নামফলক।

Advertisement

অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৫৪
Share:

বিপ্লবীনিবাস: রোমা ডিস্ট্রিক্ট এর রাস্তায় সেই স্মৃতিধন্য বাড়ি।

মেক্সিকো সিটির বোহেমিয়ান কালচার হাব রোমা ডিস্ট্রিক্ট-এর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চোখ আটকে গেল এক পুরনো বাড়ির নেমপ্লেটে। লেখা রয়েছে ‘এম এন রয়’! মনে হল ভারতীয় বিপ্লবী, পরবর্তী কালের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা মানবেন্দ্রনাথ রায় নন তো! এম এন রায়ই তো মেক্সিকোয় পালিয়ে এসেছিলেন। কৌতূহল চেপে বসল। খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম।

Advertisement

জানা গেল, এই বাড়িতেই আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পালিয়ে এসে উঠেছিলেন আজীবন সংগ্রামী এম এন রায়। ভগ্নদশাপ্রাপ্ত বাড়িটি এখন একটি ক্লাব, যার নাম ‘এম এন রয়’! এখানে রাতভর গানবাজনার আসর বসে আর মেক্সিকো সিটির বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পীদের সমাগম ঘটে। মেক্সিকো সিটির ইলেকট্রনিক মিউজ়িকের অন্যতম সেরা সংস্থানও এটি। একমাত্র নির্বাচিত সদস্যরাই এখানে প্রবেশের আমন্ত্রণ পান।

বহু প্রচেষ্টায় ভিতরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেল। ভিতরের কর্মকাণ্ড দেখে আবার আশ্চর্য হওয়ার পালা! বাইরে থেকে ভগ্নদশাপ্রাপ্ত বাড়িটির ভিতরে অসাধারণ আধুনিক স্থাপত্যকীর্তি। দুই ফ্রেঞ্চ আর্কিটেক্ট— ইমান্যুয়েল পিকাউল্ট এবং লুডিগ গডফ্রয়ের দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টার ফসল এই স্থাপত্যসৌন্দর্য। মায়ান, আজ়টেক এবং পরবর্তী কালের ঔপনিবেশিক শিল্পের পীঠস্থান মেক্সিকো সিটি। সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে বিভিন্ন আধুনিক স্থাপত্যশিল্পীর কাজ দেখা যায় সারা শহর জুড়ে। তার মধ্যে এই দুই শিল্পীর হাতে তৈরি এম এন রায় ক্লাবের অন্দরমহল অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন।

Advertisement

এম এন রায় তথা মানবেন্দ্রনাথ রায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম এক বৈপ্লবিক চরিত্র, যাঁর জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগনার আরবেলিয়াতে। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বর্তমানে যা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, সেখান থেকে পাশ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে। যোগ দেন অনুশীলন সমিতিতে। পরবর্তী কালে ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে এবং সশস্ত্র আন্দোলনের রসদ জোগাড় করতে পালিয়ে যান জাপানে। সেখান থেকে চিন হয়ে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোর কাছে পাওলো অলটো-তে। আমেরিকায় থাকাকালীন মার্ক্সিস্ট কমিউনিস্ট আদর্শে অনুপ্রাণিত হন এবং ব্রিটিশ সিক্রেট পুলিশের চাপে বর্ডার পেরিয়ে হাজির হন মেক্সিকোতে। মেক্সিকো সিটিতে বরোদিনের সংস্পর্শে আসেন এবং অ্যাডলফ সান্টিবেনেজের মতো সমকালীন সমমনোভাবাপন্ন বিপ্লবীদের নিয়ে গড়ে তোলেন মেক্সিকোর প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি। পরবর্তী কালে এম এন রায়ের কর্মকাণ্ড এবং তাঁর মেধা আকর্ষণ করেছিল তৎকালীন নানা বিশিষ্টজনকে, তাঁদের মধ্যে যেমন লেনিন, স্তালিন, ট্রটস্কি আছেন, আবার অ্যালবার্ট আইনস্টাইনও প্রভাবিত হয়েছেন এম এন রায়ের দর্শনে। কালক্রমে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য মুখ হয়ে ওঠেন তিনি, তাসখন্দে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলেন। শেষ জীবনে ভারতে ফিরে এসে নেতাজি সুভাষচন্দ্র, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিভিন্ন দেশে ঘোরা, অভিজ্ঞ এম এন রায়ের গতিবিধির উপর নজর রেখেছিল ব্রিটিশ পুলিশ। তিনি যাতে এই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন মাত্রা যোগ না করতে পারেন, সে কারণে বহু পুরনো একটি মামলার জের টেনে তাঁকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করে ব্রিটিশ পুলিশ। আন্তর্জাতিক উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মানবেন্দ্রনাথ মারা যান ১৯৫৪ সালে।

মেক্সিকো সিটির এম এন রায় ক্লাবের আর্কিটেক্ট ইমান্যুয়েল পিকাউল্টের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা একটা বিকল্প অবসর বিনোদনের পরিবেশ দিতে চেয়েছেন মেক্সিকোবাসীদের। এই ভাবনারই প্রতিফলন দেখা যায় তাঁদের ডিজ়াইন, পরিবেশ এবং অনুষ্ঠানে। ক্লাবের নামও তাঁরা রেখেছেন সেই ব্যক্তিত্বেরই নামে ‘এম এন রায়’। ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা গেল, প্রাক্তন গৃহকর্তা এম এন রায়কে সম্মান জানাতেই এই পদক্ষেপ। বিখ্যাত এই প্রাক্তন আবাসিকের দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তাঁদের এই প্রয়াস, যা এক বিকল্প স্থাপত্য-সংস্কৃতি এবং মানসিক ব্যাপ্তির আধুনিক পীঠস্থান!

জানি না আমাদের দেশের জনসাধারণ, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মানুষও এই বিশাল মাপের আন্তর্জাতিক সংগ্রামীকে মনে রেখেছে কি না। হয়তো ইতিহাস বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্কলার, কিংবা রাজনীতির মানুষজন কেউ কেউ মনে রেখেছেন তাঁর কর্মকৃতিত্ব, উপলব্ধি করেছেন তাঁর গুরুত্ব। সাধারণ মানুষের বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু উনিশ শতকের মৌলিক উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শহর, ফ্রিডা কাহলোর শহর, ট্রটস্কির জীবনের শেষ ক’টা দিন কাটানোর এই শহর এবং গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের শহর এম এন রায়কে মনে রেখেছে!

ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম, নিজের নামে এ রকম একটা ক্লাব দেখে কি খুশি হতেন এম এন রায়? যাই হোক, মেক্সিকো সিটিতে তাঁর বাড়িটি যে এখনও তাঁর নামের অনুষঙ্গে ইতিহাসের সাক্ষ্য দিচ্ছে, এটুকুও সচেতন মানুষকে মনে করিয়ে দেবে সেই বিস্মৃত বিপ্লবীর কথা। তা-ই বা কম কী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন