নবরূপে: ভরত পারেখ-সুজিত রায়ের ‘নিসান ২৪০ আরএস’।
ধুলোভরা রাস্তায় দ্রুত ছুটছে একের পর এক গাড়ি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছেন কাতারে কাতারে মানুষ। হঠাৎ একেবারে উল্টেপাল্টে গেল একটা গাড়ি। পিছনেই ছিল অ্যাম্বুল্যান্স। উদ্ধারকর্মী, চিকিৎসাকর্মী ও আশেপাশের মানুষ মিলে উদ্ধার করলেন গাড়ির দুই আরোহীকে। দেখা গেল, এমন দুর্ঘটনা সত্ত্বেও তাঁদের তেমন ক্ষতি হয়নি।
‘কার র্যালি’-তে এমন দৃশ্য দেখা যায় প্রায়ই। আর এ হেন দুর্ঘটনায় চালক, পথনির্দেশক (ন্যাভিগেটর) ও অন্য আরোহীদের বাঁচাতে বিশেষ ব্যবস্থা করা থাকে র্যালির গাড়িতে। আবার র্যালির দৌড়ে জেতার জন্য ইঞ্জিনের শক্তি বাড়ানো থেকে শুরু করে বাড়তি আলো, ব্যবস্থা করা হয় সব কিছুরই। গাড়ির জগতের পরিভাষায় এই পরিবর্তনের পোশাকি নাম ‘কার মডিফিকেশন’।
কেমন সেই পরিবর্তন? কী ভাবেই বা বদলানো হয় গাড়ি?
১৯৬০-এর দশক থেকে কার র্যালির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সুজিত রায় ও ভরত পারেখ। তাঁরা জানাচ্ছেন, আগে গাড়ির ইঞ্জিন-সহ নানা ক্ষেত্রে অনেক বেশি পরিবর্তন করতে হত। কারণ, অ্যাম্বাসাডর, ফিয়াটের মতো গাড়ি র্যালির বিশেষ উপযুক্ত ছিল না।
প্রথমে আসা যাক গাড়ির ‘বডি’র কথায়। ভরত ও সুজিতের কথায়, ‘‘সাধারণ গাড়ির বডি তেমন বড় ধাক্কা সামলাতে পারে না। তাই বডিতে পাইপের তৈরি আলাদা একটি কাঠামো লাগানো হয়। তাকে বলে রোলকেজ। গাড়ি উল্টেপাল্টে গেলেও অনেক সময়েই এই রোলকেজের দৌলতে বেঁচে যান প্রতিযোগীরা।’’ গাড়ির পেট্রল পাম্প, মবিল ট্যাঙ্কে থাকে আলাদা ‘গার্ড’। কারণ, বন্ধুর পথে অনেক সময়েই বেশি গতিতে চলতে হয় র্যালির গাড়িকে। রে়ডিয়েটরে সমস্যা হলে যাতে দ্রুত পরিবর্তন করা যায় সে জন্য থাকে বিশেষ ব্যবস্থা। এবড়োখেবড়ো পথের ধাক্কা সামলানোর হয় বিশেষ দামি ‘শক অ্যাবজ়র্বার’। র্যালির দৌড়ের হিসেব রাখার জন্য বসানো হয় বিশেষ মিটার। ইউরোপের একটি সংস্থার তৈরি মিটার তখন বিশেষ জনপ্রিয় ছিল প্রতিযোগীদের মধ্যে।
বন্ধুর পথে দ্রুত গতিতে চলতে গেলে গাড়ির বনেট-ডিকিতে সাধারণ ভাবে যে ‘লক’-এর ব্যবস্থা থাকে তার উপরে ভরসা করা যায় না বলে জানাচ্ছেন ভরত-সুজিত। তাই সেখানেও লাগানো হয় বাড়তি ‘লক’। থাকে অন্তত দু’টি ‘স্টেপনি’ বা বাড়তি টায়ার। সুজিত জানালেন, তখন সাধারণত কেউ রেডিয়াল টায়ার কিনতেন না। কিন্তু র্যালির গাড়িতে ওই টায়ার কার্যত আবশ্যিক ছিল। সেই সঙ্গে অনেক সময়ে দু’টি সাধারণ চাকার ‘রিম’ কেটে একসঙ্গে জুড়ে র্যালির গাড়ির বিশেষ ‘রিম’ তৈরি হত। অনেকে জুড়ে নেন একটি বাড়তি পেট্রল ট্যাঙ্কও।
রয়েছে গাড়ির আলোর ব্যবস্থাও। ‘ওভারনাইট’ র্যালিতে অনেক সময়েই রাতের অন্ধকারে জঙ্গুলে বা পাহাড়ি পথে ছুটেছেন ভরত-সুজিতরা। তাঁদের ‘নিসান ২৪০ আরএস’ গাড়ির প্রবল গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করতে হয়েছিল আলোর আয়োজন। ছিল মোট দশটি আলো। ভরতের কথায়, ‘‘রাতকে দিন করে ফেলতাম আমরা। যত ভাল দেখতে পাব ততই তো জোরে চালাতে পারব।’’ গাড়ির সাধারণ ‘ওয়্যারিং’ ব্যবস্থা এত আলোর পক্ষে উপযোগী নয়। তাই বদলাতে হত তা-ও। রকমফের আছে আলোরও। গাড়ির সাধারণ আলোর সঙ্গে লাগানো হয় ‘স্পট ল্যাম্প’ও। এর আলো অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
সুবীর রায়-নীরব মেটার গাড়ি
বাড়তি শক্তি আর সুরক্ষার ফল হাতেনাতে পাওয়া যায় বলে দাবি ভরত ও সুজিতের। ১৯৮৫ সালের ‘হিমালয়ান র্যালি’-তে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পথের পাশে গাছে ধাক্কা মারে তাঁদের ‘নিসান ২৪০ আরএস’। সুজিত গুরুতর আহত হন। কিন্তু বিশেষ সিট ও সিট বেল্ট তাঁকে অনেকটাই রক্ষা করেছিল বলে দাবি সুজিতের। আরও একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে তাঁর। রাস্তার পাশের মাঠে ছিটকে পড়েছিল প্রতিযোগী প্রশান্ত পাল ও তাঁর সহযোগী দেবার গাড়ি। কিন্তু বিশেষ সুরক্ষা থাকায় শারীরিক ক্ষতি হয়েছিল কম।
আর ইঞ্জিনের শক্তি? তাও বিশেষ পদ্ধতিতে বাড়ানোর সুবিধে পাওয়া গিয়েছিল কলকাতা-জামশেদপুর র্যালিতে। ফিয়াট গাড়ির ইঞ্জিনের শক্তি বাড়িয়ে তাতে যোগ দিয়েছিলেন ভরত-সুজিত। টায়ার ফেটে যাওয়ায় পিছিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু পরে দ্রুত গতিতে এগিয়ে ধরে ফেলেছিলেন এক লেভেল ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য প্রতিযোগীদের। একের পর এক প্রতিযোগীকে টপকে শেষে কলকাতারই নিয়াজ আলির গাড়ির পিছনে ছিলেন তাঁরা। এক কালভার্টের উপরে নিয়াজকেও টপকে যান। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছিল তাঁদেরই।
গত বছরে ভারতের একাধিক জনপ্রিয় কার র্যালিতে জিতেছেন কলকাতার সুবীর রায় ও নীরব মেটা। সুবীরবাবু জানাচ্ছেন, গাড়ির ‘বডি’-সহ অন্য বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এখনও প্রায় একই ধরনের। তবে ইঞ্জিন এখন বদলে গিয়েছে। চালু হয়েছে কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। তাই ইঞ্জিনের সফটওয়্যারে কিছুটা পরিবর্তন করতে গেলে বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন। সরাসরিই বলছেন, ‘‘কলকাতায় এখনও এই ধরনের দক্ষ ওয়ার্কশপ নেই। গাড়ি পাঠাতে হয় দিল্লি বা দক্ষিণ ভারতে।’’ বেঙ্গালুরুর নীলাকিষণের মতো বিশেষজ্ঞদের প্রায়ই সাহায্য নেন তিনি। সুবীরবাবু জানাচ্ছেন, সফটওয়্যারে কিছুটা বদলের ক্ষেত্রে আগে র্যালির পথ ঘুরে আসেন সংশ্লিষ্ট কারিগরেরা। তার পরে প্রয়োজনীয় বদল করা হয়।
রাজস্থানে ডেজ়ার্ট স্টর্ম র্যালির আসরে ১০-১২ বার উল্টেপাল্টে তবে স্থির হয়েছিল সুবীর-নীরবের গাড়ি। বাঁচিয়ে দিয়েছিল বিশেষ সিট বেল্ট, হেলমেট, বিশেষ সিট। দাক্ষিণাত্যে ‘দক্ষিণ ডেয়ার’ র্যালির আসরেও পরিবর্তিত মারুতি সুইফ্ট গাড়ি থাকায় সুবিধে পেয়েছেন তাঁরা।
প্রতিযোগীরা জানাচ্ছেন, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে আনা হয় বিশেষ সিট-সহ র্যালির গাড়ির অনেক উপকরণ। উপযোগিতা বিচার করে তবেই কোন কোন গাড়ি র্যালির আসরে ব্যবহার করা হবে তা স্থির হয়। অনেকে ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ গাড়ি কিনে তাতে র্যালির প্রয়োজনীয় বদলের জন্য বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হন। অনেকে নতুন গাড়িও কেনেন। র্যালির নিয়মিত প্রতিযোগীদের আলাদা ভাবে গাড়ি বিক্রি করে অনেক গাড়ি নির্মাতা সংস্থা। তাতে বদলের কাজে অনেক সুবিধে হয়।
পরিবর্তনের জন্য কলকাতা থেকে দিল্লি বা বেঙ্গালুরুতে পাঠিয়ে দেন প্রতিযোগীরা। কিন্তু আনার সময়ে? সুবীর হেসে বললেন, ‘‘অদলবদলের জন্য গা়ড়ি ট্রেলারে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু দিল্লিতে পাঠালে কলকাতায় ফেরত আনার সময়ে নিজেই চালিয়ে ফিরে আসি। পথে একটা রাত বারাণসীতে থাকি। সেটাও একটা অভিজ্ঞতা।’’
পথের আকর্ষণ যাঁদের রক্তে, তাঁদের কোনও বাধাই ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। কিন্তু র্যালির উপযোগী সঠিক যন্ত্রপাতি থাকাটা জরুরি।