সেন্সরামি যুগে যুগে

এক কালে যাঁরা ‘বিবর’ নিয়ে সমরেশ বসুকে হুড়কো দিয়েছিলেন, হাংরি লেখালিখি নিয়ে কোর্ট-কাছারি করেছিলেন, এবং এখন কেউ পোঁছে না বলে মনোকষ্টে ভুগছিলেন, তাঁদের জন্য সুসংবাদ। তাঁদের উদ্ধারকল্পে কল্কি অবতার রূপে এসে গেছে সেন্সর বোর্ড।

Advertisement

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০৩:১৫
Share:

এক কালে যাঁরা ‘বিবর’ নিয়ে সমরেশ বসুকে হুড়কো দিয়েছিলেন, হাংরি লেখালিখি নিয়ে কোর্ট-কাছারি করেছিলেন, এবং এখন কেউ পোঁছে না বলে মনোকষ্টে ভুগছিলেন, তাঁদের জন্য সুসংবাদ। তাঁদের উদ্ধারকল্পে কল্কি অবতার রূপে এসে গেছে সেন্সর বোর্ড। কোর্টের কাছে ধমক খাওয়ার আগে, সেই নতুন অবতার কেটে-ছিঁড়ে ‘উড়তা পঞ্জাব’-এর এমন হাল করার আবদার জানিয়েছিলেন, যেন তিন বছরের শিশু বাপের কাছে ‘তোমার জামাতা ছিঁড়ে ন্যাতা বানিয়ে দাও’ বলে আদুরে কান্না জুড়েছে। সেখানেই শেষ না, মূল দাবি ছিল সিনেমার নাম থেকে ‘পঞ্জাব’ কথাটাই কাটতে হবে, বাদ দিতে হবে আঞ্চলিক এবং রাজনৈতিক সমস্ত রেফারেন্স। নইলে ঈশ্বর জানেন, কার নরম ভাবাবেগে পট করে আঘাত লেগে যাবে, আর নাদান দর্শকরা দেখেশুনে ভুল ধারণা নিয়ে বাড়ি ফিরবে। অতএব চালাও পানসি বেলঘরিয়া, প্রেক্ষাগৃহ নামক মাতুলালয়ে লাগাও রূপকথা। সেখানে ড্রাগ থাকবে, নাচাগানা থাকবে, কিন্তু পঞ্জাবের পটভূমিকায় বানানো সিনেমায় পঞ্জাবের নামোল্লেখ করা যাবে না। সুশিক্ষারও হদ্দমুদ্দ হবে, আর ভাবাবেগে আঘাত লাগারও কোনও চান্স নেই। এক ঢিলে দুই পাখি, টু-ইন ওয়ান।

Advertisement

এই যুক্তিপরম্পরা অনুসরণ করলে, বোঝা যাচ্ছে, ফিলিম কোম্পানিদের খুবই দুর্দিন সমাগত। এখন ‘ম্যাড্রাস ক্যাফে’ বানালে তামিল ভাবাবেগে আঘাত দেবার অপরাধে ‘ম্যাড্রাস’ বাদ দিয়ে নাম করতে হবে ‘ক্যাফে’। নব্বইটা সিন কেটে, ব্যাকগ্রাউন্ডে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের গান চালিয়ে দিলেই বিতর্ক পালাবার পথ পাবে না, ভোল বদলে একদম সুসংস্কৃত পারিবারিক ছবি। আর ‘চিটাগং’ এর পুরো নামটাই বাদ গিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম নামহীন সিনেমা হয়ে গিনেস বুকে নাম তুলবে, কারণ চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের গপ্পোগাছা যথেষ্ট রিয়েলিস্টিক না হওয়ায় বহু লোকের ভাবাবেগ ইতিমধ্যেই আহত। অবশ্য জিনিসটা হিন্দিতে বানানো, ফলে ঝাড়পিটটা কোথায় হচ্ছে, চট্টগ্রাম না কানপুর বোঝা মুশকিল, কাটাকাটির ঝঞ্ঝাট নেই।

মোট কথা, সতত খেয়াল রাখতে হবে, শিল্প প্রসবকালে অনবধানে যেন ভুল বার্তা চলে না যায়। নচেৎ, একে তো যাদের অবমাননা হল, তারা মুচ্ছো যাবে, আর বাকি বোকা-পাঁঠা পাঠক ও দর্শককুল, যা পাবে তাই খাবে আর বিশ্বাস করবে। অতএব শিল্পীরা কেবল লিখবেন সরল পাঠ্যপুস্তক, না পারলে অন্তত লোকশিক্ষের মানেবই। তাতেও ভুলভ্রান্তি হতেই পারে, তাই লেখার সময় হেডমাস্টার বেত উঁচিয়ে বসে থাকবে পিছে। ‘বৈশাখ মাসে তাতে হাঁটুজল থাকে’? এ কী লিখেছ হে, পরিষ্কার ডিভিসির অবমাননা। ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’? সে আবার কী, নাবালকরা ফিজিয়োলজি ভুল বুঝবে। এই ভাবে নয়া অবতারের বেত্রসঞ্চালনে শিল্প হয়ে উঠবে গঙ্গাজলের মতো পূতপবিত্র, সহজপাঠের মত সরল। হাংরি আর বিবর জমানার মোকদ্দমাবাজ সেই অদ্ভুত প্রজাতি আবার উঠে আসবে শিরোনামে। সম্ভবামি যুগে যুগে, অর্থাৎ কল্কি যুগ যুগ জিও।

Advertisement

bsaikat@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন