আমি তখন কুড়ি-একুশ। বিপ্লবের রঙিন আবহ চার পাশে। কিছুটা তারই সঙ্গতে বোধহয় আমারও মুখ ভর্তি দাড়িগোঁফ। স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র। কিন্তু পড়াশোনার পাশাপাশি নাটকের নেশাও তত দিনে পেয়ে বসেছে। সেই নেশার ঘোরেই কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে শ্যামবাজারে ‘নান্দীকার’-এর অফিসে যাওয়া, সাক্ষাৎকার-পর্ব পেরিয়ে সেখানে যোগ দেওয়া। ন’মাসের প্রশিক্ষণ শেষে এল মাহেন্দ্রক্ষণ।
নাটকের নাম ‘ফুটবল’। কিন্তু প্রথম মঞ্চে ওঠার দিনেই ঠাকুমা মারা গেলেন। বাড়িতে অশৌচ। অথচ নাটকে চোদ্দো-পনেরো বছরের এক কিশোরের চরিত্রে অভিনয় করব। তাই চরিত্রের প্রয়োজনে ফুটপাতের ক্ষৌরকারের কাছে কেটে ফেলতে হল সযত্নলালিত দাড়ি-গোঁফ। নিজেকে চিনতেই পারছি না যেন। অভিনয়ের পালা শেষ হল। কিন্তু এ বার চিন্তা হল, বাড়ি ফিরব কী ভাবে, অশৌচের রীতি-ভঙ্গ হয়েছে যে! বাড়ি-ভর্তি লোকজন।
মুখে হাত চেপে কোনও রকমে বাড়ি ঢুকলাম ঠিকই, কিন্তু অনিবার্য ভাবে ধরাও পড়লাম। মুহূর্তে যেন ঠাকুমার মৃত্যুশোকের থেকেও বড় হয়ে দেখা দিল আমার এই নিয়ম-ভঙ্গ। আর ব্যক্তি ‘আমি’র সেই দিনই প্রথম টের পাওয়া, নাটক আমাকে এ ভাবে ক্রমাগত সাজাতে থাকবে— নিজের বলতে যা কিছু আছে, তা কেড়ে নেবে। আর যা কিছু নেই, তা আমার মধ্যে চালান করে দেবে!
আসলে সন্তান, স্বামী, বাবা, নামধাম, অভিনেতা, বৃত্তি— এই সামাজিক পরিচয়ের চিহ্নগুলো গায়ে মেখে সাজঘরে ঢুকি ঠিকই, কিন্তু সেই প্রবেশের মুহূর্ত থেকেই ওই পরিচয়গুলি ছাড়তে শুরু করি। সাজঘরের দড়িতে ঝোলানো জামাকাপড়, টেবিলে রাখা শিরস্ত্রাণ, মদের গেলাস, কোথাও রাখা তরোয়াল, বন্দুক— অর্থাৎ যে অনুষঙ্গগুলির হাত ধরে মঞ্চ নামের আলাদা জগতে ক্রমে প্রবেশ করি, সেগুলিই তখন যেন আমার অন্দরমহলকে জুড়তে থাকে। তাই যে জীবন আমি ছেড়ে আসছি, আর যেখানে আমি পৌঁছতে চাইছি, এই দুইয়ের মাঝে থাকা এক ‘নো-ম্যান’স ল্যান্ড’-এর নাম সাজঘর! এই ভূখণ্ডে জবাবদিহি বা কাগজ চাওয়া নেই। আছে শুধু আগের দেশের সব কিছু ছেড়ে দেওয়া, আর নতুন দেশের সবটা গ্রহণ করা।
এই বর্জন-গ্রহণের নিয়ত ধারাপাত বুঝিয়ে চলে, সাজঘরে অভিনেতার নিজস্ব চেহারা থাকতে নেই। কারণ, মঞ্চের আঁতুড়ঘর সাজঘরই আমাকে একটা চেহারা দেবে। সাজঘরের আয়নারও যে একটা আকাঙ্ক্ষা থাকে, সে যেন বলে, ‘মুখটা পাল্টে দিয়ে তোমাকে একটা নতুন জন্ম দেব!’ তাই বার বার মনে হয়, সাজঘরে ঢুকতে হলে একটু বেশি পরিষ্কার হয়ে যেতে হয়। ক্যানভাসের মতো ‘পরিষ্কার’ মুখ ও শরীরেই যে নতুন রং ফুটে ওঠে ভাল, খসে পড়ে আমার নিজস্ব সামাজিক রংগুলো।
ছবি: কুনাল বর্মণ
সাজঘর: আমার আমি
প্রেক্ষাগৃহ-ভেদে সাজঘরের নিজস্ব চরিত্র, আলোর ঔজ্জ্বল্য, উষ্ণতা বা শীতলতা আলাদা। কিন্তু ওই যে দেওয়া-নেওয়া, সেই দুইয়ের মাঝে সাজঘর বড় জীবন্ত এক জন। তার গায়ে এক আশ্চর্য গন্ধ— পোড়ার গন্ধ? এই পোড়ানো আক্রান্ত করে না, মাদকতার মায়া তৈরি করে— পুড়তে থাকে আমাদের জাগতিক জীবনের প্রবণতা, আকাঙ্ক্ষা। সাজঘর উত্তেজনা দেয়, মঞ্চের জন্য তৈরি করে দেয়, কিন্তু নিজে বড়ই উদাসীন, নির্লিপ্ত, রহস্যের আলেয়ায় ঘেরা। তাই সে একটি চরিত্র হলেও, তার প্রকৃতি ঠিক কেমন, সাজঘরের সঙ্গে প্রায় চল্লিশ বছর ঘর-বসত করেও এই প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
এই চরিত্রের নানা রূপ মানব-জনমের অসংখ্য অনুভূতিকে সচেতন করে তোলে, নিত্য আবিষ্কারও করে। কখনও সে আমার সঙ্গে কথা বলে, কখনও যন্ত্রণার মাঝে হয়ে ওঠে পরম মিত্র, কখনও বা কঠিন শিক্ষাও সহজ আখরে বুনে দিয়ে যায়। বুঝিয়ে দেয় জীবন-মৃত্যুর সারাৎসার ও বৈপরীত্যগুলিও।
আর এগুলো চলতে থাকে আমাকে তার উল্টেপাল্টে দেখার মধ্যে দিয়েই— অভিনয়ের জন্য কুড়ি বছর বয়সে জিঙ্ক অক্সাইড লাগিয়ে সাদা চুল করেছি, আর এখন তার উল্টোটা। অর্থাৎ, যা আমি হতে চাই এবং যা আমি হতে চাই না, এই দুইয়ের মাঝে স্মিত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সাজঘর। কখন যেন শুরু হয়ে যায় কথোপকথনও। জামাকাপড়, পরচুল বা দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে এক জীবনের পরিচয় ছেড়ে নতুন পরিচয়কে গ্রহণের মাধ্যমে সাজঘর আমাদের মঞ্চের জন্য প্রস্তুত করে। সেই প্রস্তুতি নিয়েই মঞ্চে গিয়ে হাসব-কাঁদব, চিৎকার করব... কিন্তু যখন মঞ্চ ছেড়ে সাজঘরে ফিরে চেয়ারে বসি বা আয়নার সামনে দাঁড়াই, সাজঘর যেন আমাকে প্রশ্ন করে, ‘কেমন লাগল?’
বলি, ‘দারুণ। একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল জানো...’
কথোপকথন চলতে থাকে। তারই মাঝে ওই গোঁফ, পরচুল খুলতে খুলতে বা মুখের রংটা ঘষে ফেলে দিতে দিতে অনিবার্য জীবনের যা ‘নিজস্ব দাগ’, তার কাছে ফিরে আসি আমরা। এই অনিবার্য জীবনে তো অনিচ্ছাকৃত অনেক ভুল থাকে। মঞ্চেও ভুল হয়। মঞ্চে যাওয়ার আগে শিল্পী যখন সংলাপগুলো ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন, সাজঘরই তখন তাঁকে যাচাই করে বলে যায়, ‘কেমন সুন্দর বলছে দেখো।’ কিন্তু ওই শিল্পীই, আমরা প্রত্যেকেই মঞ্চে হোঁচট খাই কখনও-কখনও। তখন সাজঘরে ফিরে নিজেকে চাবকাই, রক্তাক্ত হই। সাজঘর তখন যেন আমার এই না-পারা, যন্ত্রণাগুলিকে আপন করে। আমার লুকোতে চাওয়া যা কিছু বা যা কিছু দুর্বলতা, সেই সব কিছুকে যেন হিঁচড়ে বার করে আগল ছাড়াই স্নেহের পরশে ভরিয়ে তুলে পরম বন্ধু হয়ে ওঠে সে।
এই বন্ধুই কখনও বা বুঝিয়ে দেয় জীবনভরা বৈপরীত্যের চিহ্নগুলি। এটা প্রথম টের পেয়েছি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সাজাহান’ নাটকে ঔরঙ্গজেবের চরিত্রে অভিনয়ের সময়। নাটকে সাজাহানের পরিণতির জন্য দায়ী ঔরঙ্গজেব। সাজঘরেএক দিন আচমকা দেখি, সাজাহানের পোশাকের উপরে অর্ধেকটা জুড়ে মেলা রয়েছে ঔরঙ্গজেবের পোশাক। মনে হল যেন, সাজাহানের বুকের উপরে চেপে বসে আছে ঔরঙ্গজেব!
এমনই তো হয় রোজ। হ্যাঙ্গারে বা দড়িতে রাখা নাটকের রাজার পোশাকের গায়ে লেপ্টে থাকে তারই ঘোর কোনও শত্রুর পোশাক। দুই পোশাকে এমন গায়ে-গায়ে বন্ধুত্ব হল কী করে? আবার, একটি নাটকে অভিনয়ের সময়ে দেখেছি, সংশ্লিষ্ট নাট্যদল আমার পোশাকটা সযত্নে ইস্ত্রি করে আলাদা করে রেখেছে। কত যেন ‘দাম’ তার। অথচ, চরিত্রটি এক জন ভিক্ষাজীবীর। একটু পরেই ওই পোশাকটি পরেই চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করব— এক ধাক্কায় এক জন ‘কম দামি’ মানুষ হয়ে উঠব আমি। কখনও বা, ধরা যাক সহজাত ভাবে একটু দাম্ভিক কোনও অভিনেতা সাজঘরে তাঁর দম্ভ প্রকাশ করছেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই মঞ্চে গিয়ে তাঁকে বিনয়ী, চাটুকার ইত্যাদি হতে হবে। এই অভিনেতাকে ধাক্কাটা কে দেয়, নাটকের আখ্যান? না কি সাজঘর?
আসলে সাজঘর আমাদের জন্য সব কিছুই সাজিয়ে রাখে। ধরা যাক, একটু রক্তের রং সাজানো আছে। মুহূর্তের মধ্যে তা মুখে লেপে দেওয়া হল। বুঝলাম, এক দিন আমাকে এই আঘাতটা বাস্তবেও বইতে হবে। এ ভাবেই বাস্তবে যা কিছুর মুখোমুখি হতে হবে, অর্থাৎ হাসি-কান্না, জীবন-মৃত্যু, সব কিছুই প্রস্তুত রেখেছে সাজঘর। এক বার ধাক্কাটা লেগেছিল বাস্তবেও। ‘নান্দীকার’-এর জাতীয় নাট্যোৎসব। রতন থিয়াম উপস্থিত। নাটক চলছে। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে এক অভিনেত্রী অভিনয় করতে করতে মঞ্চ থেকে পা ফস্কে মাটিতে পড়ে গেলেন। সংজ্ঞা হারালেন। তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে আমরা সাজঘরে রাখলাম। আমরা স্থির। নির্দেশক রতন থিয়াম কিছু বৈজ্ঞানিক উপায়ে জ্ঞান ফেরানোর মরিয়া চেষ্টা চালাতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে পরিস্থিতি একটু থিতু হল। অভিনেত্রী চোখ মেলে তাকালেন। বুঝলাম, নির্দেশকের কাজ শুধু অভিনেতাকে সাজঘর থেকে মঞ্চে পাঠানো নয়। বরং তিনি যখন মঞ্চ থেকে সাজঘরে ফেরত আসেন, তাঁর মধ্যে এক রাশ প্রাণবায়ু চারিয়ে দেওয়াটাও দায়িত্ব। মনে হল, ‘সাজঘরে শুধু রং দেওয়া হয় না, বলিরেখা আঁকা হয় না। এখানে শুদ্ধতম প্রাণবায়ুও পাওয়া যায়।’
শুধু এমনই নয়। সাজঘরে বসে দেখি, এক জন অভিনেতা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। কিন্তু একটু পরেই মঞ্চে গিয়ে তাঁর চরিত্রটির মৃত্যু হবে। দর্শকের হৃদয় খানখান করে মঞ্চের আলো-আবছায়ার মাঝে সেই অভিনেতা আবার বীরদর্পে ফিরে এলেন সাজঘরে। দেখতে দেখতে মনে হল, বাস্তবেও মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু আমরা এর মুহূর্তটা জানি না। মঞ্চ বা সাজঘরে মুহূর্তটা জানি, এটুকুই ফারাক। কিন্তু সেই ফারাকটাকে যদি দূরে রাখি, তা হলে প্রশ্ন জাগে, আমাদের জীবন-মৃত্যুর এই যে হাত ধরাধরি, সেটাও কি সাদা-কালোর মতো করে বুঝিয়ে দেয়, বা এক অর্থে প্রস্তুতির মহড়া দিইয়ে নেয় এই সাজঘর?
ছবি: কুনাল বর্মণ
সাজ-কথার রংবাজি
অভিনেত্রীর সংজ্ঞা হারানো বা সাজঘরে তাঁর শুশ্রূষার মতো অনেক ঘটনা দর্শক জানতে পারেন না। কিন্তু সাজঘর সম্পর্কে দর্শকের এক ধরনের কৌতূহল কাজ করে সব সময়। এই সূত্রে একটা মজার কথা খুব মনে পড়ে। দেবব্রত বিশ্বাসের আত্মজীবনী অবলম্বনে তৈরি ব্রাত্য বসুর ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ নাটকের অভিনয়-পর্ব তখন। আমি রূপটান নিয়ে অ্যাকাডেমির ভিতর দিকের সাজঘরে বসে আছি। আর দর্শক চাইলেই ঢুকে থাকতে পারেন, এমন বাইরের দিকেও একটা সাজঘর আছে। ব্রাত্য ও অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীও সেখানে রয়েছেন। তা সেই বাইরের দিকের সাজঘরটিতে দুই তরুণ ঢুকে আমার খোঁজ করেছেন।
ব্রাত্য জানতে চান, ‘কেন?’
তরুণদের উত্তর, ‘আমাদের খুব আগ্রহ নাটক শুরুর আগে দেবশঙ্কর হালদার কী করেন, ওঁকে এই সময়টা দেখতে কেমন লাগে?’
তাতে ব্রাত্যের সরস বক্তব্য, ‘উনি এখন অন্য সাজঘরে রয়েছেন। এই সময়ে উনি উত্থিত পদ্মাসনে বসেন! ওঁকে এখন বিরক্ত করা যায় না।’
দুই তরুণ গোল-গোল চোখ করে খুবই বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা, তাই নাকি!’
ওঁরা ভাবলেন, সত্যিই আমি হয়তো নাটক শুরুর আগে মনঃসংযোগের আগে উত্থিত পদ্মাসনে বসে থাকি।
এমন না-জানার জন্যই অভিনেতার জীবনে এত আনন্দ। মনে হয়, সাজঘর আমাকে সেই আড়ালটা দেয়, যেখানে আমার নিজস্ব সবটাকে অক্লেশে, লজ্জাহীন ভাবে খুলে রেখে আমি একটা নতুন জীবনের পরিচয়ে জড়িয়ে পড়ি। এই সূত্রে খুব মনে পড়ে একটি সংলাপ। ‘আন্তিগোনে’ নাটকে থিবজ়-এর রাজা ক্রেয়ন সাজি। সেখানে রাজা আন্তিগোনেকে বলছে, “যে নাটকের নায়িকার ভূমিকায় তুমি অভিনয় করার জন্য মরে যাচ্ছো, সেই নাটকের সাজঘরে কী ঘটেছিল তোমার জানা দরকার।”
এই ‘জানা’টা বড় আপন করে জেনেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ‘সওদাগরের নৌকা’য় তাই সাজঘরই চরিত্র হয়ে উঠে যেন সংলাপও বলেছে, “আমি একটা ঘর চেয়েছিলাম। তিন দেওয়ালওয়ালা ঘর। আশা ছিল, তার চতুর্থ দেওয়াল আমি নিজে হব। একটা সাজঘর...।” প্রত্যেক অভিনেতা আসলে সাজঘরই হতে চান। আমরা যে থিয়েটারে নাটক মঞ্চস্থ করি, তার তিন দিকে দেওয়াল বা পর্দা থাকে, সামনেটা খোলা। সেখানেই থাকে ওই চতুর্থ দেওয়াল। এটাই তো প্রতিটি অভিনেতার হতে চাওয়া, যে অদৃশ্য দেওয়াল ভেদ করে দর্শক চলে যান, সেটাই অভিনেতার পরম প্রাপ্তিও। অজিতেশকেই এক বার অভিনয় শেষে সাজঘরে তুলো দিয়ে রং তুলে ফেলতে দেখে এক কবি বলেছিলেন, “মনে হল যেন মেঘের তুলো দিয়ে উনি ঘষে ঘষে রং তুলছেন...।”
এই যে রং, নকল গোঁফ-দাড়ির সঙ্গে লেগে থাকা আঠা, সব কিছুর মধ্যেই সাজঘর একটা বার্তা দেয়। সে বার্তা শুনতে চাইলে বোঝা যায়, আমরা ওই যে রংটা তুলে ফেলি, তার সঙ্গেই ক্রমে আমার যা ‘নিজের রং’, তা-ও একটু পরিষ্কার হয়ে ওঠে। দুই রঙের এমন বন্ধুতা সাজঘর ছাড়া আর কোথায়? সাজঘরে ফেলে আসা রংটা ‘আমার রং’কে বলতে থাকে, ‘আমার পালা শেষ হল। এ বার তুমি রংবাজি করো!’ তাই বোধহয় গোঁফ-দাড়ির আড়ালেও সাজঘরের আয়নার দিকে তাকালে নিজের মুখটা যেন লুকোচুরি করে নিয়ত! এই লুকোচুরির শুরুটা অজানতেই ছোটবেলায় শুরু হয়েছে। তখন আমি পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণি। স্কুলে গরমের ছুটি। দুপুরবেলা। বাবা অভয় হালদার ছিলেন যাত্রাভিনেতা। যাত্রা দলের ম্যানেজারিও করতেন। সেই সূত্রে এক বার বাড়িতে ট্রাঙ্ক রাখা। চুপি চুপি আমরা ভাইবোনেরা সেই ট্রাঙ্ক খুলে ফেললাম। তার মধ্যে থাকা সাজবার উপকরণ দিয়েই আমার প্রথম সাজের শুরু। সেই আমার প্রথম নাটকও। ভালবাসারও শুরু, সাজঘরের রংবাজিকে।
কিন্তু ভালবাসার সঙ্গে তো অনেক সময় আশঙ্কাও থাকে। সাজঘরে তা-ও টের পাই বার বার। সাজঘর থেকে যে পোশাকটা পরে মঞ্চে গেলাম এবং তার পরে অভিনয় শেষে পোশাকটা সাজঘরেই খুলে ফেললাম। কিন্তু এমনও তো এক দিন হতে পারে, ওই পোশাকটা গায়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে গেল, খুলল না! কী হবে তা হলে? অভিনয় শেষে সাজঘরে এসে কিছুটা যেন অযত্নে, তাড়াহুড়োয় মঞ্চের পোশাকটা খুলে ফেলার প্রবণতা থাকে। তখন কি পোশাকগুলোও অভিমান করে? সাজঘরকে সাক্ষী রেখে বলে, ‘গ্রহণ করেছিলে আদরে। আর এখন কাজ শেষে অনাদরে বর্জন করছ!’ সাজঘর তখনই আমাকে মনে করিয়ে দেয়, এই যে বর্জন, তাতে কিন্তু আবার পরের দিনের আসন্ন গ্রহণের সম্ভাবনাটাও রয়েছে।
ছবি: কুনাল বর্মণ
নৈঃশব্দ্য ও সংলাপ
যেখানে এই বর্জন-গ্রহণ, সেই জায়গাটা অর্থাৎ সাজঘরটাকে সহশিল্পী বা ‘বড়’ শিল্পীদের সঙ্গে ‘ভাগ’ করে নেওয়া— এই ব্যাপারটা কিন্তু অনেক পরে শুনেছি। অতীতে সাজঘরের মধ্যে কখনও একটা পর্দার আড়াল রেখে বড় অভিনেতার নিভৃতির ব্যবস্থা, বা তাঁর জন্য আলাদা সাজঘর, এগুলো দেখেছি ঠিকই। কিন্তু তুলনায় তা কম। কিন্তু মঞ্চজীবনের প্রথম দিকে এই সাজঘর ‘ভাগ’ করাটা আলাদা করে টের পাইনি। কারণ, এক জন ‘বড়’ শিল্পীর পোশাকের সঙ্গে একই সারিতে আমার পোশাকও ঝুলতে থাকে, কখনও বা পাখার হাওয়ায় দু’টো পোশাক লেপ্টে থাকে একে অপরের গায়ে। ফলে, মনে হয়েছে, আমরা সবাই আসলে একই সারিতে দাঁড়িয়ে। ধরা যাক, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একটি চেয়ারে বসে সাজলেন। ওঁর সাজা শেষে উঠে গেলেন। আমি বা আমাদের মতো অনেকেই ওই চেয়ারটাতেই সাজতে বসলাম। এটাই কি সাজঘর ভাগ করে নেওয়া? আমি ব্যক্তিগত ভাবে সাজঘরে সবার সঙ্গে বসে, সবার মাঝেই রূপটান দিতে স্বচ্ছন্দ।
এর সূত্রেই সাজঘরে কথাবার্তা কেমন হবে, তা নিয়ে কিছুটা চর্চা হতে পারে। সাজঘরে মনঃসংযোগের দিকে তাকিয়ে নৈঃশব্দ্যের শিক্ষা দিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। কিন্তু সেটা ধূপ-ধুনো দেওয়ার মতো উপাসনাগৃহ নয়। আমার মতে, সাজঘরে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের স্বাভাবিক থাকাটাই সব থেকে বড় বিষয়। কথাবার্তাও হোক, তবে সেটা যেন বাজার না হয়ে যায়। সেটা হলে মঞ্চে নির্দিষ্ট সময়ে ঢুকতে দেরি হয়ে যেতে পারে। আর সাজঘরে কয়েকটা কোণ থাকে, যেখানে এত আড়াল যে, সেখানে থেকে মঞ্চে কোনও দিন পৌঁছনো যাবে বলে মনে হয় না। ফলে, সেখানে দাঁড়াতে নেই।
সাজঘরে স্বাভাবিক থাকার সূত্রে একটা দৃশ্য মনে পড়ে। ‘নান্দীকার’-এর নাট্যোৎসব চলছে। রবীন্দ্র সদন। বেশ অল্প বয়স তখন আমার। চা-জলখাবার কিছু লাগবে কি না জানতে গিয়েছি সাজঘরে। সাজঘরের মাঝে একটা সোফা। দরজাটা ঠেলে ঢুকতেই দেখি উৎপল দত্ত। আমাকে দেখে মুখে আঙুল দিয়ে ‘শ্শ্...’ আওয়াজ করে চুপ থাকতে বললেন। আমি তখনও কথা শুরুই করিনি। তাকিয়ে দেখি, সহ-অভিনেতারা ইতিউতি বসে রয়েছেন। উৎপলবাবু একটু কুঁজো হয়ে, কিছুটা যেন উইকেটকিপারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। কিরণ মোরে কী ভাবে ক্যাচ ফস্কেছেন, তার দৃশ্যায়ন চলছে! বলছেন, ‘ডান দিকে বলটা যাচ্ছে, ডাইভ দিতে হত এই ভাবে...’। বলেই ডাইভ দিয়ে সোফায় গিয়ে পড়লেন উৎপলবাবু। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তও সাজঘরে নিষ্ঠা রেখে অবিরল মজা করতে ভালবাসতেন। আবার, ‘ফেরা’ নাটকে সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে দেখেছি, উনি ওঁর পার্ট শেষ করে মঞ্চের পাশে উইংয়ে একটা চেয়ার নিয়ে বসে পুরো নাটকটা দেখছেন। কিন্তু সাজঘরে প্রায়ই বলতেন, ‘দেবু তোমার ওই গল্পটা শোনাও তো!’ সেই মজার গল্প শুনে খুব হাসতেন। ওঁর থেকে যেটা সবচেয়ে বড় শিক্ষা— সাজঘরে গল্পের মাঝেও ওঁর সময়নিষ্ঠা। সাড়ে ছ’টায় নাটক, উনি প্রস্তুত সাড়ে পাঁচটায়।
আবার উল্টো দিকে সাজঘরের অনিশ্চয়তা নিয়ে একটা গল্প শুনেছি। আন্তর্জাতিক স্তরের এক বড় অভিনেতা। তিনি সাজঘর থেকে মঞ্চে যেতে খুবই ভয় পেতেন। রোজই ভাবতেন সংলাপ ভুলে যাবেন, মঞ্চে ঠিকমতো অভিনয়টা করতে পারবেন না। তা উনি বাড়ি থেকে কয়েকটা গামলা আনতেন। আর সাজঘর থেকে মঞ্চ পর্যন্ত সেই গামলার দল শোভা পেত, যাতে ওঁর বমি পেলে সমস্যা না হয়! যদিও কোনও দিনই গামলার সদ্ব্যবহার করতে হয়নি।
অভিনেত্রীদের সাজঘর স্বাভাবিক কারণেই আলাদা। তবে কখনও সেই ঘরের দরজাটা খোলা থাকলে দেখেছি, ‘নাচনী’ নাটকে অভিনয়ের জন্য অনেক আগে সাজঘরে চলে এসেছেন স্বাতীলেখাদি। নিজেই পরম যত্নে তিলে তিলে সেজে উঠছেন। আর সেজে উঠেই উনি ছেলেদের সাজঘরে এলেন। আয়নায় দেখলেন নিজেকে। উনি যেন আমাদেরও বলতেন, ‘যদি কিছু বেশি-কম বলার থাকে, এখনই বলো।’ স্বাতীলেখাদির মতো সহজ মানুষ খুব কমই দেখেছি। সহজেই রাগতেন, আবার সহজে ভালওবাসতেন। রাগ হলে সাজঘরে সবার সামনেই বকাবকি, এ-ও হয়েছে বহু বার। কিন্তু মান-অভিমানের পালার পরে স্নেহও জুটেছে অকাতরে। সাজঘর এ ভাবেই যেন নানা চরিত্রকেও নিজের মতো করে জায়গা করে দেয়।
আলির হাতে বিশ্বামিত্র
কিন্তু এই সাজঘরের সাজ, এর নেপথ্যে কারা? একটা সময় আমরা নিজেরাই সাজতাম। কী ভাবে সাজতে হয়, তার পাঠও পেয়েছিলাম। ভালওবাসি খুব সাজতে। ক্রমে রূপটান-শিল্পীদের সংখ্যা বাড়ল। শক্তি সেন, রণজিৎ চক্রবর্তী, মহম্মদ আলি— এমন কত নাম। তখনও তেমন ‘ব্রাশ’ ব্যবহার করতেন না ওঁরা। আঙুলের সাহায্যেই রং দিয়ে আমাদের সাজাতেন। প্রত্যেকের হাতের যেন আলাদা স্পর্শ। ঠিক যেন কুমোরটুলির শিল্পীদের মতো, এক-এক জনের তৈরি মূর্তির আলাদা-আলাদা বিশেষত্ব। এই বিশেষত্বের মাঝেই হয়তো বা কখনও ধরা দেয় আমার দেশ, রাজ্যের মূল শক্তি, সম্প্রীতির জোরটাও। সেই শক্তিতেই হয়তো মহম্মদ আলির হাতে সেজে ওঠে রামের চরিত্র। কখনও বা মহাভারত-আশ্রিত ‘মাধবী’ নাটকে মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে সাজাচ্ছেন উনি। এমন সাজের মাঝে রূপটান-শিল্পীরা প্রায়ই বলেন, “আপনাকে একদম ঠাকুরের মতো দেখাচ্ছে।” যেন উনি ঠাকুর দর্শন করেছেন!
ঠাকুর-দর্শন কি না জানা নেই, সাজঘর এ ভাবেই আমাদের জীবনদর্শনকে নির্মাণ করে তিলে তিলে। ‘সওদাগরের নৌকা’য় একটা সংলাপ আছে— “ভগবান বড়ো সেয়ানা সাজ-মাস্টার...।” আমরা হয়তো এই মাস্টারের পাঠশালাতেই জীবন-নাটকে অভিনয় করে চলেছি প্রতিনিয়ত!
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে