বয়স সবে আঠেরো, যখন এল আমার বাড়িতে। এমন ফর্সা রং আর তকতকে স্কিন যে কোনও কাজের মেয়ের হতে পারে, আমি কখনও দেখিনি। যে দিন আমার মাসতুতো দিদি নিয়ে এল ওকে, দেখেই বুক ধড়াস করে উঠল আমার, এ তো বসন্তের কোকিল। বেশি দিন থাকবে না আমার বাড়ি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিয়ে।
তারও কোনও রাখঢাক ছিল না। ‘দ্যাখো দিদি, বিয়ে তো করতেই হবে। সারা জীবন কি লোকের বাড়ি কাজ করে কাটাব? আমার সংসার হবে না বুঝি? আর কাজ করছি কী জন্য? বিয়ের টাকা, পণের টাকা আর গয়নার জন্য টাকা তো চাই।’ রেগে উঠি আমি, ‘পণ দিবি?’ ‘আমাদের তো আর শহরে বাড়ি নয় দিদি, আমাদের দিতেই হবে। আর পণ ছাড়া আমার বিয়ে কে দেবে বলো? তুমি নেবে দায়িত্ব?’ চুপ করে থাকলাম। তার পর একটু রসিকতাও করলাম, ‘তোর না গায়ের রং ফর্সা, তোর বিয়েতে পণ লাগবে?’ ‘লাগে গো দিদি, সব ছেলের বাড়ি চামার।’ তা হলে বিয়ে করবি কেন? ‘ওটাই নিয়ম।’ ভব্যিযুক্তর মতো বলে ও।
এর পর নিটিরপিটির করে আমার বাড়িতে মিশে যায়। সাংঘাতিক পেছনে লাগি, আবার ওর মারাত্মক রাগও সয়ে নিই। ও দারুণ এগ রোল করত। সাংঘাতিক পরিষ্কার করে কাজ করত। আবার মুড অফ থাকলে আমিই ভয় পেতাম। রোদ-বৃষ্টির মতো মিলেমিশে গেল আমার ‘কাজের মেয়ে’।
মাঝে মাঝে বলতাম, ‘হ্যাঁ রে, একটা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করা! সব টাকা বাড়িতে দিয়ে দিচ্ছিস যে!’ বলত, ‘আমার গয়নার জন্য দিচ্ছি গো দিদি। আমাদের বাড়ির কাছে এক জন স্যাকরা আছে, তার কাছে মা টাকা জমাচ্ছে।’ ছ্যাঁৎ করে ওঠে বুক। ‘বলিস কী! সে যদি পরে স্বীকার না করে?’ ‘মা তো লিখিয়ে নিয়েছে কত টাকা জমা হচ্ছে। এক জোড়া দুল হয়ে গেছে, গলারটা করতে দিয়েছে।’
আমার খটকা লাগে। জিজ্ঞেস করি, ‘এত দিন যে বাড়ি গিয়ে থাকিস, এক বার গয়নাগুলো তো নিজের চোখে দেখে এলে পারিস।’ ‘দুলগুলো তো মা আমার মাসির স্টিলের আলমারিতে রেখে এসেছে। আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূর তো মাসির বাড়ি, তাই যাওয়া হয়নি। এ বার তো গিয়ে চুড়ির ডিজাইন দিয়ে এলাম।’
তার পর যা হয়। এক বার বাড়ি গেল, এবং আর এল না। কোনও ফোন না, কিচ্ছু না। আমার মাসতুতো দিদি অনেক পাত্তা লাগিয়ে খবর আনল, দু’দিন আগে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রায় বছর দুয়েক ছিল। ছোট একটা বাড়ির মেয়ের মতোই খলবল করত। ও দিকে আমার বাড়ি ফের লোকের সমস্যা। ফের মাসতুতো দিদির শরণাপন্ন। দিদি অনেক খোঁজ করে ওরই এক পিসিকে জোগাড় করল। সে এল দেখা করতে।
ওর কথা জিজ্ঞেস করলাম। বলল, ‘কী বলব দিদি, কী তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিয়ে দিল। মেয়েটার গায়ে একটা গয়না অবধি উঠল না।’ আমি অবাক। ‘সে কী! ও যে মা’র কাছে টাকা জমিয়ে গয়না করাচ্ছিল!’ পিসি বলল, ‘এমন মা-বাপ দেখিনি। তোমাদের এখান থেকে মেয়ে টাকা পাঠিয়েছে, ওরা তা খরচ করে দিয়েছে। মেয়ের টাকাগুলো খেয়ে উড়িয়ে দিল। যখন বিয়ে হল মেয়েটার, খালি কান, খালি গলা, কেবল হাতে দু’গাছা চুড়ি। বিয়ের দিন এমন কনে মানায়? সবই অদৃষ্ট।’
আমার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। হঠাৎ এ বাড়িতে ওর খিলখিলে চলাফেরাগুলো আর আশায় ঝলমলে চোখদুটো মনে পড়তে লাগল।